সোনালী মিত্র নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

সোনালী :  ” প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” এর পরে মলয় রায়চৌধুরীর সেই কবিতা আর এলো কই যে আগামী প্রজন্ম মনে রাখবে ? নাকি বিতর্ক হয়েছিল বলে কবিতাটা বিখ্যাত হয়েছিল ? নাকি মলয় রায়চৌধুরীর সব প্রতিভা ঢাকা পড়ে গেলো ”প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” এর সৌজন্যে ?

মলয় :  ওটা ছিল মূলত দ্রুতির কবিতা ; আক্ষেপানুরাগের কবিতা । ওই কবিতার দরুন পঁয়ত্রিশ মাস ধরে আদালত-উকিল-চাকুরি থেকে সাসপেনশানের কারণে অর্থাভাব ইত্যাদির ফলে দ্রুতির রেশ আক্রান্ত হয়েছিল । কলকাতায় তো আমার মাথাগোঁজার ঠাঁই ছিল না, কেননা আমরা তখন পাটনায় থাকতুম । সুবিমল বসাক ছাড়া অন্যান্য বন্ধুরাও কলকাতায় তাদের আস্তানায় রাতে থাকতে দিত না । উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খণ্ডহরে রাতে থাকলে সকালে কলকাতা আদালতে যাবার জন্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, যার সময়ের ঠিক ছিল না । ইলেকট্রিক ট্রেন তখন সেরকমভাবে আরম্ভ হয়নি । সে কি দুরবস্হা । টয়লেট করতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার ট্রেনে ; রাত কাটাতুম সুবিমলের জ্যাঠার স্যাকরার এক-ঘরের দোকানে, বৈঠকখানা পাড়ায় । একই শার্ট-প্যাণ্ট পরে দিনের পর দিন কাটাতে হতো ; স্নান রাস্তার কলে, সেগুলোও আবার এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে বসতে হতো । কবিতা লেখার মতো মানসিক একাকীত্বের সময় পেতুম না মাসের পর মাস । 

‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা তখন বিখ্যাত হয়নি ; হয়েছে এই বছর পনেরো-কুড়ি হল । তখন তো ভয়ে লোকে হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করত না, কবিতাটা নিয়ে আলোচনা তো দূরের কথা । আমার মনে হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ওদেশে কবিতাটা প্রকাশের ব্যাপারে বা হাংরি আন্দোলন নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে ভীতি ছিল না । ঢাকায় মীজানুর রহমান ওনার পত্রিকায় ধারাবাহিক আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ প্রকাশ করেছিলেন । আশির দশকে আমার বেশির ভাগ লেখা প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় । বাংলাদেশের কবিদের দেখাদেখি পশ্চিমবঙ্গে বছর দশেক পরে কবিতাটা প্রকাশের সাহস যোগাতে সক্ষম হন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা । এখন তো কলকাতার সংবাদপত্রের পুস্তিকাতাও প্রকাশিত হতে দেখি । ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’ ইত্যাদি যে পত্রিকাগুলো সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রকাশ করত, তাতেও ওরা আমার কবিতা প্রকাশ করতে বা আমার নামোল্লেখ করতে ভয় পেতো ; এমনকি হাংরি শব্দটা এড়াবার জন্য ক্ষুধার্ত শব্দটা প্রয়োগ করা আরম্ভ করেছিল । আসলে শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ আদালতে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গিয়ে আত্মঅবমাননার গাড্ডায় পড়েছিল ।

আমার মনে হয় তোদের নাগালে আমার বইপত্র পৌঁছোয় না বলে কেবল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ দ্বারা প্রভাবিত রয়েছিস । আমার উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ আর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ তো বেশ বৌদ্ধিক রেসপন্স পেয়েছে, বিশেষ করে কম বয়সী অ্যাকাডেমিশিয়ানদের থেকে । নয়তো কেনই বা বিষ্ণুচন্দ্র দে আমার কবিতা নিয়ে পিএচডি করবেন, উনি ওনার গবেষণাপত্র গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেছেন । স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় এম ফিল করবেন ? মারিনা রেজা ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণার জন্য আসবেন ? আরও কয়েকজন তরুণ-তরুণী গবেষণা করছেন । অধ্যাপক দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা বিনির্মাণ করে অ্যাকাডেমিশিয়ানদের সাইটে আপলোড করেছেন । পড়ে দেখতে পারিস । তুই দিল্লিতে থাকিস বলে আমার বইপত্র পাস না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইটালি থেকে গবেষণার জন্য আসছেন ড্যানিয়েলা লিমোনেলা ।

সোনালী :  হাংরি আন্দোলন নতুনধারার কবিতার জগতে বিপ্লব এনেছিল । কিছুদিন ফুল ফুটবার পরেই রোদের তাপে মিইয়ে গেলো ! মতপার্থক্য জনিত কারণেই কি আন্দোলন শেষ হয়ে গেলো ? পৃথিবীতে সমস্ত আন্দোলনই প্রথমে আগুন লাগিয়ে দেয় মানুষের বুকে , আবার আগুন নিভিয়েও দেয় আন্দোলনের হোতারা , হাংরি ও এর ব্যতিক্রম হোল না কেন?

মলয়: হ্যাঁ, পৃথিবীর সব আন্দোলনই একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে ; তার কাজ হয়ে গেলে মিলিয়ে যায় ; আন্দোলন মাত্রেই সমুদ্রের আপওয়েইলিং । হাংরি আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় একের পর এক কতোগুলো আন্দোলন হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে । তারা মিডিয়া প্রচার পায়নি বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি । আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলুম, যে কারণে এই মাস তিনেক আগেও বিবিসির প্রতিনিধি এসে একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে নিয়ে গেলেন আর প্রসারণ করলেন । গত বছর আমেরিকা থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একটা ফিল্ম তৈরি করে নিয়ে গেলেন ; হাংরি আন্দোলন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দেবার সময়ে ওনার কাজে লাগে ফিল্মটা। হাংরির পর তো কবিতার আর গদ্যের ক্রিয়েটিভ ধারাই পালটে গেছে ।

সোনালী :  আপনারা কবিতা আন্দোলন করে কি করতে চেয়েছিলেন ? এতদিন পরে পেছনের দিকে তাকালে কি মনে হয় অল্পবয়সে হুজুকে চেপেছিল আপনাদের সাহিত্য সাধনা ? আপনারা যা চেয়েছিলেন তার কতখানি সফলতা অর্জন করেছিলেন ? যদি সফলতা অর্জন করে থাকেন তাহলে ধরে রাখতেই বা পারলেন না কেন ?

মলয় : না, আমাদের আন্দোলন কেবল কবিতার আন্দোলন ছিল না । গদ্য-নির্মাণ আর ছবি-আঁকারও আন্দোলন ছিল । ছবি আঁকায় ১৯৭২ সালে অনিল করঞ্জাই ললিত কলা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন । বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ গল্পের বইটা সেই ষাটের দশকেই প্রশংসিত হয়েছিল ; এখন তো ওর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে, আর পাঠকদের দ্বারা সমাদৃত হচ্ছে । হাংরি আন্দোলনের কারণে পাঠবস্তু মুক্ত হয়ে গেছে যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে; কবিতা আর গল্প লেখা হচ্ছে মুক্ত-সূচনা, মুক্ত-সমাপ্তি এবং মুক্ত আঙ্গিক নিয়ে ; মানের নিশ্চয়তা এড়াতে পারছে ; অফুরন্ত মানে গড়তে পারছে; সংকরায়ণ ঘটাতে পারছে; ‘আমি’কে বহুমাত্রিক আর বহুস্বরিক করে তুলতে পারছে ; শিরোনামের পরিবর্তে রুবরিক প্রয়োগ করতে পারছে ; ভঙ্গুরতা আনতে পারছে ; মাইক্রোন্যারেটিভকে গুরুত্ব দিতে পারছে; ফ্লাক্স তৈরি করতে পারছে । এ থেকেই তো বোঝা যায় যে পরের পর প্রজন্মে সফলতা ক্রমশ চারিয়ে যেতে পেরেছে ।

সোনালী : হাংরি ভূত কি গায়ে চেপে বসে আছে এখনও আপনার পরিচয়ের সঙ্গে ? এখন ও যা লেখেন মানুষ তুলনা টানে হাংরি কবিতার সঙ্গে , এটাকে উপভোগ করেন না খারাপ লাগে ? জীবনের এইপ্রান্তে এসে কি মনে হয় হাংরি আন্দোলন অন্যকোন ভাবে পরিচালনা করা যেত যাতে এই সময়েও সমান প্রাসঙ্গিকতা থাকত ?

মলয়: হাংরি আন্দোলনের তো কেউ পরিচালক ছিলেন না । আমাদের আন্দোলনের কোনো সম্পাদকীয় দপতর, হেড কোয়ার্টার, হাই কমাণ্ড, পলিট ব্যুরো জাতীয় ব্যাপার ছিল না । যাঁর যেখান থেকে ইচ্ছে বুলেটিন বা পুস্তিকা প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিল । বাঙালির সাহিত্য চেতনায় এই ব্যাপারটা ছিল অভাবনীয় । প্রথম দিকে হ্যাণ্ডবিলের আকারে বেরোতো আর ফ্রি বিলি করা হতো ; যিনি বের করতেন তিনিই বিলি করতেন । কবিতার পোস্টারের প্রচলনও আমরাই সর্বপ্রথম করি, তখনকার দিনে উর্দু লিথোপ্রেসে অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার ছাপিয়ে । দেয়ালে সাঁটার কাজটা করতেন ত্রিদিব মিত্র আর ওনার প্রেমিকা আলো মিত্র । এখন যেটা হয়েছে তা হাংরি নাম ঘাড়ে চেপে যাওয়ার নয় । যা মাঝে-মাঝে নজরে পড়ে তা হল, মলয় রায়চৌধুরী নামটা আমার লেখার আগেই পাঠকের কাছে পৌঁছে একটা ইমেজ গড়ে ফেলার । এর জন্য আমার কিছু করার নেই । জনৈকা পাঠিকা লিখে জানিয়েছিলেন যে আমার কবিতাগুলোকে তিনি প্রিডেটর মনে করেন, এবং আমাকে নয়, আমার কবিতার সঙ্গে তাঁর সুপ্ত যৌনসম্পর্ক গড়ে ওঠে তা তিনি টের পান । অর্থাৎ এ-ক্ষেত্রে আমার নামকে অতিক্রম করে তিনি আমার কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েছেন । এই তরুণীর চরিত্রটিকে আমি ‘ভালোবাসার উৎসব’ কাব্যনাট্যে ব্যবহার করেছি । হাংরির ভুতপ্রেত আমার চেয়ে পাঠক-পাঠিকার ওপর চেপে বসেছে বেশি করে । আর হাংরি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে তুই পাঁচ দশক পর বিষয়টা নিয়ে উৎসাহী কেন ?

সোনালী : স্পষ্টত তখন হাংরি আন্দোলন নিয়ে বাংলার কবিদল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল , যারা সঙ্গে থাকব বলেও পরে সরে গিয়েছিলেন , যারা কিছুদিন থাকবার পরে সরে গিয়েছিলেন , যারা প্রথম থেকেই বিরুদ্ধে ছিলেন , তাদের প্রতি আপনার কখনও কি মনে হয়েছে যে শিল্প-সাধনার স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিলেন তারা ? কিংবা তাদের সেই সাহস ছিল না ?

মলয় : দু’ভাগ নয়, অনেক ভাগ । লেখালেখির জগতে এই ধরণের ঘটনা আকছার ঘটে । এটা ব্যক্তিচরিত্রের ব্যাপার, শিল্প-সাধনার নয় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে ওসকাচ্ছিলেন হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়া যাবার জন্য । তাঁরা বেরিয়ে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের সাক্ষী হয়ে যেতেই উনি ফিরে এসে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন আর নিজের বন্ধুদের ছবিটা বাঙালির ইতিহাসে নোংরা করে দিলেন । মীজানুর রহমান ‘হাংরি কিংবদন্তি’ ধারাবাহিক প্রকাশ করার পর গ্রন্হাকারে বের করতে চাইছিলেন, কিন্তু সেখানেও শামসুর রাহমানের মাধ্যমে তাঁকে বিরত করা হয় ; করেছিলেন ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিরা । স্ট্যালিন যখন পরাবাস্তববাদীদের জেলে পুরছিলেন তখন কয়েকজন কমিউনিস্ট হয়ে-যাওয়া পরাবাস্তববাদী স্ট্যালিনকে সমর্থন করেন । হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায় হত্যা নিয়ে আল মাহমুদ আর নির্মলেন্দু গুণ মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে বসে রইলেন । আল মাহমুদ একজন মৌলবাদী, তাঁর আচরণ বোঝা যায় । নির্মলেন্দু গুণ মুখ খুললেন না ভয়ে, এসট্যাবলিশমেন্ট তাঁকে সাহিত্যের ইতিহাস থেকেই লোপাট করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় । পশ্চিমবঙ্গেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে, কিন্তু ‘পরিবর্তনওয়ালা’ কবি-সাহিত্যিকরা মুখে লিউকোপ্লাস্ট চিপকে লুকিয়ে পড়েন । শিল্প-সাধনার স্বাধীনতা তখন কোথায় যায় ?

সোনালী :  মলয় রায়চৌধুরী একটা ব্র্যান্ড । মলয় রায়চৌধুরী তকমা ছেপে গেলে অনেক কিছু করে ফেলা যায় যা একটা সাধারণ শিল্পীর দ্বারা সম্ভব নয় ! আপনার কি মনে হয়নি এতদিন যা লিখেছেন , যা লিখছেন এসব যেন কিছুই নয় , চরম কিছু বাকি রয়ে গেলো যা এখনও লেখা হোল না ! শেষ সময়ে এসে কি পেছনে তাকিয়ে হাঁটেন না সামনের পথ তৈরি করার খেলাতে মেতে আছেন ?

মলয় : হ্যাঁ, আসল লেখা এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি ; মগজের মধ্যে ঘটে চলে অনেকরকমের ভাবনাচিন্তা। ব্র্যাণ্ড কিনা তা জানি না । আমার কতো প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, কাব্যনাট্য গ্রন্হাকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে । ব্র্যাণ্ড হলে তো কোনো না কোনো প্রকাশক রাজি হতেন প্রকাশ করতে । কেউই রাজি হন না । অনেকে ছাপার জন্য টাকা চেয়ে বসেন । টাকাই যদি দিতে হয় তো নিজেই ছাপিয়ে ফ্রি বিলি করা ভালো, যেমন রবীন্দ্রনাথ করতেন । কেননা প্রকাশকরা টাকা নিয়ে নাকি যথেষ্ট কপি ছাপেন না, শুনেছি কয়েকজন তরুণ কবি-সাহিত্যিকের কাছে । পেছনে ফিরে তাকাই না । আমি বইপত্র সংগ্রহ করি না, নিজের বইও আমার কাছে নেই, তাই আগের লেখাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটা অবিরাম ছিন্ন হয়ে চলেছে । আমার বইয়ের কোনো লাইব্রেরি নেই । বই-পত্রিকা পড়ি, আগ্রহী পাঠকদের বিলিয়ে দিই ।

সোনালী : যৌবনে শুভা শেষ জীবনে অবন্তিকা’র মধ্যে দিয়ে প্রেমের ভিন্নতা খুঁজতে চাওয়া কি কোন ভুল সংশোধন ? নারীকে যখন ভোগ্য , পুরুষকে ও যখন ভোগ্য ভেবে সমস্ত নৈরাশ্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় , তখন কি মনে হয়নি শ্মশানের পাশেই হাসনুহানা গাছে কত ফুল ফুটে আছে , সেই ফুলের শোভা ও নৈরাশ্যর মতই ভীষণ সত্য , ফুলকে উপেক্ষিত করা যায় ?

মলয় : শুভা যৌবনের নয় ; বয়ঃসন্ধিকালের । আমার “রাহুকেতু” উপন্যাস পড়লে তুই আমার জীবনের কয়েকজন নারীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারবি । “ভালোবাসার উৎসব” কাব্যনাট্যেও আছেন তাঁরা । আমার ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ বইতে একটি নারী চরিত্র আছে যে একজন আধচেনা পুরুষের হাত ধরে বলে ওঠে, ‘চলুন পালাই’ । এটা আমার জীবনে একজন নারীর প্রবেশের প্রয়াস ছিল । অবন্তিকা একটি নির্মিত প্রতিস্ব । এর আগে রামী, বনলতা সেন, নীরা, নয়ন, সুপর্ণা ইত্যাদি ছিল কবিদের নিজস্ব নারী । অবন্তিকা সেরকম নারী নয়, সে স্বাধীন, পাঠকের কাছে, আলোচকের কাছে, নির্দ্বিধায় যায় । অবন্তিকা আমার স্লেভগার্ল নয় ।

সোনালী : এই সময়ের কবিতার ভবিষ্যৎ কি ? এই সময়ের কবিতা কোনপথে এগিয়ে গেলে হাংরি যেখানে শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করা যাবে ? নাকি এখনকার কবিরা গোলকধাঁধায় পড়েছে , কি করবে না করবে কিছুই যেন লক্ষ্য নেই তাদের সামনে ? নাকি এখনকার কবিতা সমাজ রাষ্ট্র সময় থেকে সরে যাওয়া কোন জাফর শা ? কোন উত্তাপ লেগে নেই তাদের হৃদয়ে ?

মলয় : এখন তো অনেকের কবিতা পড়ে আমার হিংসে হয়; অসাধারণ কবিতা লিখছেন এখনকার কবিরা । মনে হয় শব্দ বাক্য ছন্দ সবই তো রয়েছে, আমি কেন এদের মতন লিখতে পারছি না । যেমন রাকা দাশগুপ্ত, সাঁঝবাতি, মুজিবর আনসারী, বিভাস রায়চৌধুরী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, বিদিশা সরকার, বহতা অংশুমালী, মিচি উল্কা প্রমুখ । সব নাম এক্ষুনি মনে আসছে না ।

সোনালী : কবির চেতনায় কোন না কোন পূর্বজ কবির একটি আদর্শগত ধারাপাত থেকে যায়, এটা প্রাচীন কাল থেকেই লক্ষণীয় ,কবি অগ্রজ কোন কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ? আসলেই কে কাউকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যায় সাধনায় ? যদি যায় কতদূর গিয়েই বা ফিরে আসা উচিত নিজের চেতনায় ?

মলয় : শৈশবে আমাদের পরিবারে শিউনন্দন কাহার আর বাবার ফোটোগ্রাফি দোকানে রামখেলাওয়ন সিং ডাবর, দুজন কাজের লোক ছিল । শিউনন্দন নিরক্ষর হলেও পুরো রামচরিতমানস মুখস্হ ছিল । রামখেলাওয়ন রহিম, দাদু আর কবির থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারত । তারা কাজের লোক ছিল বলে সরাসরি বকুনি দিতে পারত না, কিন্তু রামচরিতমানস বা রহিম-কবির-দাদু থেকে কোট করে জানিয়ে দিত আমরা কী ভুল করছি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা”র ‘এই অধম ওই অধম’ অংশে আমি তাঁদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিষেধ করার কিছু উদাহরণ দিয়েছি । অগ্রজ কবিদের বদলে এই দুই জনের প্রভাব আমার ওপর গভীরভাবে পড়েছিল । তাছাড়া, আমাদের বাড়িতে প্রথম স্কুলে পড়তে ঢুকেছিলেন আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী । আমাদের পরিবার সেই অর্থে শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান পরিবার ছিল না । বাবা-মা আর জেঠা-কাকারা কেউই স্কুলে পড়েননি । বাবা-জেঠারা সুযোগ পাননি কেননা ঠাকুর্দা ছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার-আর্টিস্ট, বেশির ভাগ সময় কাটাতেন প্রিন্সলি স্টেটের সদস্যদের পেইনটিং আঁকায় ; উনি সপরিবারে মুভ করতেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় । আমার বাবা তো জন্মেছিলেন লাহোরে । গোঁড়া বামুন পরিবার ছিল বলে ঠাকুমা আর বড়োজেঠা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মনে করতেন বেমমো ; বহুকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ছিল আমাদের বাড়িতে ।

সোনালী : প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে নাকি একজন নারী শক্তি বিরাজ করেন ।আপনার কলমের প্রাণোচ্ছল পরিনতির জন্য কোন নারীশক্তিকে কি আধার মানতে চান ?কবি কলম দূর্ধষ রোম্যান্টিক, এই রোম্যান্টিসিজম এখনো কি প্রেমে পড়তে বাধ্য করে ?আপনার কলমে যে নারীদের পাই তারা কি শুধুই কল্পনারী নাকি বাস্তবেও তাদের ছোঁয়া আছে ?

মলয় : না, আমার পেছনে কোনো নারী নেই, মানে প্রেমিকা-নারী নেই । তবে সাপোর্ট সিস্টেম হিসাবে মা ছিলেন । যে নারীদের আমার লেখায় পাস, তারা কল্পনারী নয়, বাস্তবের নারী, একমাত্র অবন্তিকা হল বিভিন্ন নারীর উপাদান নিয়ে নির্মিত একটি প্রতিস্ব । ‘চলুন পালাই’ পর্ব থেকে আমি আর প্রেমে পড়তে চাই না । রোম্যান্টিক হওয়াটাই আমাকে বিপদে ফেলেছে বারবার । বড্ড ডিসট্র্যাকশান হয় প্রেমে । বুড়ো হয়ে গেছি বলে বলছি না, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ।

সোনালী : একদম সর্বশেষ প্রশ্নটা করেই ফেলি , আগামীদিনে আপনার পরিকল্পনা কি ? নতুন কি কোন পরিকল্পনা আছে লেখালেখি নিয়ে ? পাঠকরা কি নতুন স্বাদের কিছু পেতে চলেছে আপনার কলম থেকে ? 

মলয় : তোরা তো আমার লেখাপত্র যোগাড় করে পড়িস না । কমার্শিয়াল পত্রিকায় আমার লেখা বেরোয় না যে হাতে পাবি। ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে লেভেল-জামপিং আর ফ্রো-টু আঙ্গিক দেবার কাজ করেছি । ‘ঔরস’ উপন্যাসে ফর্ম ভেঙে মানুষের পাশাপাশি মাছিদেরও টিভি সাংবাদিকের চরিত্র দিয়েছি । ‘গল্পসংগ্রহ’তে বিভিন্ন জীবজন্তু পাখিপাখালিকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মানুষের ভূমিকা দিয়েছি । চটকল আর পাটচাষের দুর্দশা নিয়ে ‘নখদন্ত’ উপন্যাসটায় ডায়েরি, নোটস, সত্য ঘটনা আর কাহিনির মিশেল দিয়েছি । ‘জঙ্গলরোমিও’ নামে একটা উপন্যাস পুজোর সময় প্রকাশিত হবার কথা, যার গল্প একদল ক্রিমিনালদের নিয়ে, সেখানে কারোর নাম উল্লেখ করা হয়নি, তাদের সংলাপের ঢঙই তাদের পরিচয়। এলেকট্রা কমপ্লেক্স নিয়ে একটা নভেলাও প্রকাশিত হবে পুজোর সময় বা পরে, তাতেও ফর্মের নিরীক্ষা করেছি ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

मलय रॉयचौधरी के साथ टीएससी साक्षात्कार

16 जून 2016 को कैफ़े डिसेन्सस द्वारा

सनफ्लावर कलेक्टिव द्वारा 

…………………………………………………………..

मलय रॉयचौधरी एक भारतीय बंगाली कवि और उपन्यासकार हैं जिन्होंने 1960 के दशक में हंगरीवादी आंदोलन की स्थापना की थी। 2003 में धर्मवीर भारती की ‘सूरज का सातवां घोड़ा’ का अनुवाद करने के लिए उन्हें साहित्य अकादमी पुरस्कार से सम्मानित किया गया, लेकिन उन्होंने इसे स्वीकार करने से इनकार कर दिया। उन्होंने द सनफ्लावर कलेक्टिव से अपने काम, हंग्रीलिस्ट मूवमेंट, एलन गिन्सबर्ग, आंदोलन से जुड़े अन्य लेखकों, राजनीति और आंदोलन के दौरान अन्य कवियों, प्रकाशकों और प्रतिष्ठान के साथ मतभेदों के बारे में विस्तार से बात की। 

……………………………………………………………….

द सनफ्लावर कलेक्टिव: जैसा कि आपने हाल ही में एक साक्षात्कार में कहा था, युवा कवि फिर से पश्चिम बंगाल में खुद को हंगरलिस्ट कह रहे हैं। जीत थायिल भारत में गिंसबर्ग के समय पर बीबीसी डॉक्यूमेंट्री बना रहे हैं जिसके लिए वह आपसे मिले थे। डेबोरा बेकर ने अभी कुछ समय पहले ही इस बारे में एक किताब लिखी थी। अंतरराष्ट्रीय स्तर पर, हाल के वर्षों में बीट्स के बारे में कई फिल्में तेजी से स्क्रीन पर आईं। क्या आप इसे उन दो आंदोलनों के पुनरुद्धार के रूप में देखते हैं जो अनजाने में जुड़े हुए थे?

………………………………………………………………

मलय रॉयचौधरी: मुझे ऐसा नहीं लगता. शैलेश्वर घोष, सुभास घोष, बासुदेब दासगुप्ता कुछ साल पहले अपनी मृत्यु से पहले, हंगरलिस्ट पत्रिकाओं, क्षुधरता और क्षुधार्त खाबोर का संपादन कर रहे थे। प्रदीप चौधरी अभी भी फू और स्वकाल का प्रकाशन कर रहे हैं । रसराज नाथ और सेलिम मुस्तफा अभी भी अनार्य साहित्य का प्रकाशन कर रहे हैं । रत्नमय डे अभी भी हंग्रीलिस्ट फोल्डर प्रकाशित कर रहे हैं । उपन्यास और लघु कथाएँ लिखने पर ध्यान केंद्रित करने से पहले आलोक गोस्वामी ने कॉन्सेंट्रेशन कैंप प्रकाशित किया था। अरुणेश घोष ने जिराफ़ का प्रकाशन जारी रखाकुछ साल पहले उनकी मृत्यु हो गई। चूँकि ये पत्रिकाएँ बांग्ला में हैं और ये सोशल मीडिया पर सक्रिय नहीं हैं, इसलिए आप इनके बारे में नहीं सुनते। प्रदीप चौधरी ने हंग्रीलिस्ट कार्यों का फ्रेंच में बहुत अनुवाद किया है।
………………………………………………………………..

जो व्हीलर और जीत थायिल से पहले, एक अन्य निर्माता, डोमिनिक बर्न आए थे और उन्होंने हमारे आंदोलन पर विशेष रूप से एक रेडियो कार्यक्रम बनाया था। मरीना रेज़ा हमारे आंदोलन पर शोध के लिए वेस्लीयन विश्वविद्यालय से आई थीं। डेनिएला लिमोनेला इसी उद्देश्य से इटली से आई थीं। एक्सेटर विश्वविद्यालय ने अपने एक्सपोज़ ऑनलाइन समाचार पत्र में मेरा एक साक्षात्कार प्रकाशित किया है । मृगांकशेखर गांगुली ने मेरी कविता ‘स्टार्क इलेक्ट्रिक जीसस’ पर आधारित एक फिल्म बनाई है। बांग्लादेशी न्यूज पोर्टल पर इस कविता के पक्ष और विपक्ष में एक दशक से बहस चल रही है.

………………………………………………………………

डेबोरा बेकर न तो किसी हंगरीवादी से मिलीं और न ही कोलकाता के लिटिल मैगज़ीन लाइब्रेरी रिसर्च सेंटर में उपलब्ध किसी लिखित सामग्री से सलाह लीं। अधिकांश जानकारी ग़लत और मनगढ़ंत है, हालाँकि वह बांग्ला पढ़ने और लिखने का दावा करती है। इस अनुसंधान केंद्र में हंगरीलिस्ट पत्रिकाओं, बुलेटिनों, घोषणापत्र और पुस्तकों पर एक विशेष खंड है।

…………………………………………………………………

आईआईटी, खड़गपुर, जादवपुर विश्वविद्यालय, रवीन्द्र भारती विश्वविद्यालय, विश्व भारती विश्वविद्यालय, कलकत्ता विश्वविद्यालय और असम विश्वविद्यालय के छात्र अकादमिक दिनचर्या के रूप में एक दशक से अधिक समय से हमारे काम पर पीएचडी और एम फिल आदि कर रहे हैं।

………………………………………………………………

बीट्स, विशेषकर एलन गिन्सबर्ग में शैक्षणिक रुचि जारी है। उन्होंने स्टैनफोर्ड यूनिवर्सिटी से अपने संग्रह बेचकर मिले मिलियन डॉलर से सभी बीट्स के हित और अपने काम की देखभाल के लिए एक ट्रस्ट की स्थापना की थी। जब मैं कोलकाता में रहता था तो ट्रस्टियों में से एक बिल मॉर्गन ने मुझसे मुलाकात की थी।

………………………………………………………………..

हम, हंगरीवादी, अंग्रेजी और हिंदी में अपने काम का एक संकलन भी नहीं निकाल पाए हैं, क्योंकि प्रकाशकों की ओर से हमारे काम में कोई व्यावसायिक रुचि नहीं है। और हममें से कोई भी अच्छा करने में सक्षम नहीं है। हिंदी प्रमुख भारतीय भाषा है, इसलिए साहित्य अकादमी को एक संकलन प्रकाशित करने में रुचि दिखानी चाहिए थी।

…………………………………………………………………

टीएससी: गिन्सबर्ग इस बात से चिंतित थे कि बीट्स को अमेरिका में उतना अकादमिक ध्यान नहीं मिला जिसके वे हकदार थे। जहां तक ​​भारतीय शिक्षा जगत का सवाल है, क्या आप हंगरीवादियों के बारे में भी ऐसा ही महसूस करते हैं? चित्रकार करनजाई के मामले में, ऐसा प्रतीत होता है कि कुछ समय बाद आलोचकों ने भी उन्हें त्याग दिया, जिसके कारण उन्हें काफी कटुता का सामना करना पड़ा। इस पर आपके विचार क्या हैं?

…………………………………………………………………

एमआरसी:हां, उन्हें अपने जीवनकाल में यह चिंता जरूर रही कि अमेरिकी प्रतिष्ठान उन्हें सरकारी और अकादमिक मान्यता देने के लिए तैयार नहीं है। हालाँकि, वर्तमान में कवियों की अगली पीढ़ी के कारण बीट्स पर बहुत सारे अकादमिक कार्य किए जा रहे हैं, जिन्होंने उनमें रुचि ली। भले ही बीट्स सत्ता-विरोधी थे, वे अमेरिकी पूंजीवादी दुनिया के विशिष्ट उत्पाद थे। गिन्सबर्ग ने अपनी विरासत को आगे बढ़ाने के लिए एक विशाल फंड के साथ अपना ट्रस्ट बनाया। केराओक की पांडुलिपि रोल 2.40 मिलियन डॉलर में बेची गई, जो उनके ट्रस्टियों द्वारा अनंत काल तक उनकी विरासत को आगे बढ़ाने के लिए पर्याप्त थी। बीट्स को नियमित रूप से प्रकाशित करने के लिए फेरलिंगहेट्टी ने वेस्ट फ्रंट पर सिटी लाइट्स बुकस्टोर खोला। ग्रीनविच विलेज में, उनके पास समर्थन के लिए बार्नी रॉसेट का ग्रोव प्रेस, जेम्स लाफलिन का न्यू डायरेक्शन और विलेज वॉयस अखबार था।

………………………………………………………………

जैसा कि मैंने अभी आपको बताया, हंगरीवादी कवियों और लेखकों पर लगातार अकादमिक काम हो रहा है। साहित्य अकादमी ने उत्पलकुमार बसु, संदीपन चट्टोपाध्याय, बिनॉय मजूमदार, शैलेश्वर घोष और सुबिमल बसाक को पुरस्कार से सम्मानित किया है। चूंकि मैं साहित्यिक और सांस्कृतिक पुरस्कार स्वीकार नहीं करता, इसलिए मैंने उनका पुरस्कार लेने से इनकार कर दिया था. मुद्दा यह है कि हमें कोलकाता में फेरलिंगहेट्टी या जेम्स लॉफलिन जैसे प्रकाशक नहीं मिलते जो हमारे कार्यों को सामने ला सकें और वितरण की व्यवस्था कर सकें। और हमें ऐसे अनुवादक नहीं मिलते जो हमारी रचनाओं का अनुवाद करके भारतीय पत्रिकाओं में प्रकाशित करें। कोलकाता में अभी भी हमारे खिलाफ एक मजबूत लॉबी है, हालांकि सुनील गंगोपाध्याय के निधन के बाद यह कमजोर हो गई है; फिर भी सुनील के प्रशिक्षित शिष्य अभी भी सक्रिय हैं।

………………………………………………………………

1972 में कम उम्र में ललित कला अकादमी पुरस्कार प्राप्त करने के बाद, अनिल करंजई ने नक्सली आंदोलन के प्रति सहानुभूति रखना शुरू कर दिया; बनारस में उनके स्टूडियो में पुलिस ने तोड़फोड़ की। दमन से बचने के लिए उन्होंने एक अमेरिकी महिला से शादी की और वाशिंगटन डीसी में रहने चले गये। जल्द ही उनका पश्चिमी दुनिया से मोहभंग हो गया और कुछ साल बाद उस महिला को तलाक देकर वापस आ गए। वह सामाजिक गतिविधियों में शामिल हो गए और उन गंदी साजिशों से दूर रहे जिनका सहारा उस समय चित्रकारों ने लेना शुरू कर दिया था। करुणा निधान भी बनारस से भागकर पटना चले गए, जहां मेरे बड़े भाई समीर ने उनके लिए रंगीन मछलियों की दुकान खोली। जब अनिल दिल्ली लौटे तो करुणा भी उनके साथ हो गईं। दिल्ली के चित्रकारों के सर्कस से बचने के लिए अनिल ने जूलियट रेनॉल्ड्स से शादी की और देहरादून में बस गए। उस सर्किट में स्थापना-विरोधी लेखक और कलाकार इन दिनों दुर्लभ हैं।

…………………………………………………………………

टीएससी: शक्ति चट्टोपाध्याय के आंदोलन छोड़ने पर आपके क्या विचार हैं?

…………………………………………………………………

एमआरसी: शक्ति चट्टोपाध्याय ने मेरे खिलाफ गवाही दी क्योंकि शक्ति को चाईबासा में समीर की भाभी शीला से प्यार हो गया था। उसे लगा कि वह समीर की वजह से शीला से शादी नहीं कर सकता, क्योंकि वह नहीं चाहता था कि उसकी शादी एक बेरोजगार शराबी से हो। शीला उस समय पटना विश्वविद्यालय में स्नातकोत्तर अध्ययन के लिए हमारे पटना आवास पर रह रही थी, जिसने शक्ति की आग में घी डालने का काम किया।

…………………………………………………………………

इसने, एक अखबार समूह के निर्देशों के साथ, जो हमारे खिलाफ था, और जिसने शक्ति को उप-संपादक की नौकरी की पेशकश की, उसे आंदोलन छोड़ने के लिए मजबूर किया। अब, सुनील गंगोपाध्याय की मृत्यु के बाद, जब सुनील के अपने दोस्तों को लिखे पत्र प्रकाशित हो रहे हैं, तो पता चलता है कि सुनील अपने दोस्तों को हंगरीवादी आंदोलन छोड़ने के लिए उकसा रहे थे, क्योंकि सुनील ने सोचा था कि भूखावादी आंदोलन शुरू करने का मेरा एकमात्र उद्देश्य उनके ‘कृत्तिबास’ को नष्ट करना था। समूह। इनमें से लगभग सभी पत्र मेरे ख़िलाफ़ ज़हर उगलते हैं। इन पत्रों में सुनील ने लिखा था कि सत्ता-विरोधी लेखक बनने के लिए आपको प्रतिष्ठान से जुड़ना होगा और अंदर से काम करना होगा।

…………………………………………………………………

टीएससी: क्या प्रभाव की चिंता जैसा कुछ है जो दो आंदोलनों के बीच संबंध को सूचित करता है? अपने इंडियन जर्नल्स में , गिन्सबर्ग ब्लेक के दृष्टिकोण का पालन करना जारी रखते हैं। उन्होंने हारमोनियम का उल्लेख किया है लेकिन ऐसा कोई संकेत नहीं है कि उन्होंने इसके बारे में पहली बार हंगरीवादियों के माध्यम से सीखा था। आपको क्या लगता है कि किस बिंदु पर उन्होंने ब्लेक के दृष्टिकोण को त्याग दिया और भारतीय प्रभावों को आगे बढ़ने दिया? क्या आप कुछ विशिष्ट उदाहरण दे सकते हैं? मैं समझता हूं कि पद्य को मापने की इकाई के रूप में उनका सांस का उपयोग एक हो सकता है?

………………………………………………………………

एमआरसी: मुझे नहीं लगता कि हम एक-दूसरे के आंदोलनों को प्रभावित करने के बारे में चिंतित थे। LIFE मैगजीन को दिए एक इंटरव्यू में गिंसबर्ग ने कहा था कि जब वह भारत से लौटते समय ट्रेन में सफर कर रहे थे तो ब्लेक की आंखों की रोशनी चली गई और वह रोने लगे।

………………………………………………………………

जब वह बोधगया गए थे, तो उन्हें एक पत्थर का टुकड़ा मिला था, जिस पर बुद्ध की छोटी-छोटी प्रतिकृतियाँ अंकित थीं। उन्होंने मुझे बताया था कि वह दो पत्थरों पर बैठकर बकवास कर रहे थे, क्योंकि उस समय जापानियों ने बोधगया का विकास नहीं किया था और वह लगभग एक गाँव था। उन्होंने कहा कि यह बुद्ध का दिव्य निर्देश था; इस प्रकार उनकी रुचि बौद्ध धर्म में हो गई और वे रहस्यवाद से दूर हो गए। पुरातात्विक प्रतिबंधों के कारण, वह पत्थर को संयुक्त राज्य अमेरिका नहीं ले जा सका। उन्होंने हमारे पटना स्थित आवास पर अपने टूथ ब्रश से उस पत्थर को साफ किया था.

………………………………………………………………..

गिंसबर्ग के ट्रस्टियों में से एक, बिल मॉर्गन, जो मुझसे मिलने आए थे, ने कहा था कि पचास से अधिक प्रतियां थीं जिनमें से संपादित पृष्ठ उनके भारतीय पत्रिकाओं में शामिल थे । गिन्सबर्ग की भारतीय एजेंटों द्वारा जासूसी की गई थी और उनमें से कुछ एजेंटों ने यह पता लगाने के लिए कि वह क्या रिकॉर्ड कर रहा था, उसकी कुछ प्रतियां उसके कंधे के स्लिंग-बैग से निकाल लीं। गिन्सबर्ग ने खुद मुझे इसके बारे में बताया। हारमोनियम कहानी पचास प्रतियों में से एक में रही होगी।

……………………………………………………………….

सुनील गंगोपाध्याय, जो इंडियन जर्नल्स के संपादन के समय संयुक्त राज्य अमेरिका में थे , ने इस पुस्तक से हंगरीवादी आंदोलन को बंद करने की पूरी कोशिश की। बिल मॉर्गन ने मुझे बताया था कि गिन्सबर्ग न्यू जर्सी में अपनी सौतेली माँ को नियमित रूप से पैकेट भेजते थे ताकि वह उनके तहखाने की अलमारियों में कागजात व्यवस्थित कर सकें। गिन्सबर्ग के पास देश के हिसाब से अलमारियाँ थीं। उन्होंने हमारे अधिकांश घोषणापत्र एकत्र किए और वे स्टैनफोर्ड विश्वविद्यालय में उपलब्ध हैं।

………………………………………………………………..

टीएससी: अपने इंडियन जर्नल्स में , गिंसबर्ग ने आपके आंदोलन का जिक्र नहीं किया है, हालांकि वह इसके बारे में जानते थे और गहरी रुचि रखते थे। क्या आपको लगता है कि यह जानबूझकर किया गया था? क्या आपको लगता है कि उन्होंने सामान्य तौर पर कविता और कला के संबंध में आपकी तकनीकों और दृष्टिकोणों को अपनाया?

……………………………………………………………..

एमआरसी: मुझे लगता है कि मैंने अभी-अभी आपके प्रश्न का उत्तर दिया है।

…………………………………………………………………

टीएससी: गिन्सबर्ग ने बॉम्बे में भी कवियों से मुलाकात की, जिनमें कोलटकर और अन्य शामिल थे। तो फिर यह कैसे कहा जा सकता है कि वह मुख्यतः हंगरीवादियों से प्रभावित थे?

………………………………………………………………

एमआरसी: एक-दो दिन के लिए उनकी अन्य भारतीय भाषाओं के कवियों से मुलाकात हुई; लेकिन वह लगभग दो वर्षों तक कोलकाता में रहे, बंगाली कविता पाठ में भाग लिया, देशी शराब के अड्डे खलासीटोला गए, जहां बंगाली कवियों ने दौरा किया, सोनागाछी में बंगाली कवियों ने दौरा किया, और धूम्रपान जोड़ों में बंगाली कवियों ने दौरा किया।

…………………………………………………………………

टीएससी: आपने यहां रहते हुए भिखारियों की तस्वीरें खींचने के लिए गिंसबर्ग की आलोचना की है। क्या यह आपके पुराने मित्र से बड़े मोहभंग का हिस्सा है? क्या आपको लगता है कि दिन के अंत में, वह अन्य श्वेत पर्यटकों की तरह ही सतही था?

…………………………………………………………………

एमआरसी: हां, जब फेरलिंगहेट्टी ने मुझे भारतीय पत्रिकाओं की एक प्रति भेजी तो मुझे काफी शर्मिंदगी महसूस हुई। मैंने यह पुस्तक अपने पिता को नहीं दिखाई, जिन्होंने गिंसबर्ग को भिखारियों, कोढ़ी, लंगड़े पुरुषों, नग्न साधुओं आदि की तस्वीरें लेने के लिए डांटा था। मैंने अन्य देशों का दौरा किया है और कुछ लोगों की गरीबी का मजाक बनाने के बारे में कभी नहीं सोचा था। उनके इंडियन जर्नल में गिंसबर्ग की एक तस्वीर है जिसमें वो खुद एक भिखारी के भेष में एक भिखारी के पास बैठे हुए हैं.

………………………………………………………………..

गिन्सबर्ग ने संयुक्त राज्य अमेरिका में कई फोटो प्रदर्शनियाँ लगाईं, जिनमें भारतीय भिखारियों, कुष्ठरोगियों, निराश्रितों, लगभग नग्न साधुओं, सड़कों पर गायों, आवारा कुत्तों, बकरियों आदि पर प्रकाश डाला गया। इन प्रदर्शनियों के कार्ड संरक्षकों को बेचे गए। जब वह बांग्लादेश युद्ध (1971) के दौरान भारत में दोबारा आए, तो उन्होंने युद्ध क्षेत्र से भाग रहे शरणार्थियों की तस्वीरें खींचीं। उनके अंदर एक विशिष्ट श्वेत पर्यटक था। शायद इमलीतला झुग्गी बस्ती में मेरे बचपन ने मुझे सबसे गरीब आदमी का सम्मान करना सिखाया।

……………………………………………………………..

टीएससी: क्या आप हमें हंगरीवादियों की राजनीति के बारे में बता सकते हैं? क्या उस समय नक्सलियों और भुखमरीवादियों के बीच सीधे संबंध थे?

……………………………………………………………

एमआरसी: भूखवादी आंदोलन 1961 में शुरू हुआ था; सत्तर के दशक में नक्सली आंदोलन की शुरुआत हुई. मैं आपको पहले ही अनिल करंजई और करुणा निधान की दुर्दशा के बारे में बता चुका हूं। मेरी पहली किताब मार्क्सवाद पर थी। सैलेश्वर घोष, सुभाष घोष, आलोक गोस्वामी साहित्यिक लाभ के लिए सीपीआई (एम) में शामिल हुए थे। जब मैंने सोवियत प्रतिष्ठान की गतिविधियों के साथ-साथ सीपीआई (एम) के गुंडों की गतिविधियों के बारे में पढ़ना शुरू किया तो मेरा मार्क्सवाद से मोहभंग हो गया। अजीब बात है कि सीपीआई (एम) ने पिछली बंगाल सरकारों की तरह ही जानलेवा गतिविधियों का सहारा लिया। अब नई बंगाल सरकार ने उन्हीं गुंडों को अपने साथ मिला लिया है और उन्हीं जानलेवा गतिविधियों का सहारा ले रही है।

………………………………………………………………..

टीएससी: लैंगिक जागरूकता की कमी के कारण बीट्स की आलोचना की गई। आपकी राय में इस मामले में हंग्रीलिस्ट्स का प्रदर्शन कैसा है? क्या वहां महिला भूखी पीढ़ी की लेखिकाएं और कलाकार थीं? साथ ही, क्या आंदोलन ने जाति संबंधी मुद्दों के प्रति चेतना प्रदर्शित की?

…………………………………………………………………

एमआरसी: उस समय युवा साहसी महिला लेखिकाएं दुर्लभ थीं। हमारी एक महिला सदस्य थी, अलो मित्रा, जिसने बाद में त्रिदिब मित्रा से शादी की। वे मिलकर दो हंगरीलिस्ट पत्रिकाओं का संपादन करते थे, एक बंगाली में थी, जिसका नाम था, UNMARGA और दूसरी अंग्रेजी में थी जिसका नाम था, WASTE PAPER । साहित्य में निम्न और पिछड़े वर्ग के लेखकों और कवियों को लाने वाले हम पहले व्यक्ति थे। हमसे पहले काव्य पत्रिकाओं के पन्नों पर एक भी कवि नजर नहीं आता था। देबी रॉय, सुबिमल बसाक, अबनी धर, रसराज नाथ निम्न या पिछड़े वर्ग से हैं।

…………………………………………………………………

टीएससी: हमें अपनी काव्य प्रक्रिया के बारे में कुछ बताएं? आपको क्या प्रभावित और प्रेरित करता है? क्या कठोर वास्तविकता से जुड़ी कविताएँ लिखने की प्रक्रिया दर्शकों और संपादकों के क्रोध का सामना करने से अधिक कठिन है?

………………………………………………………………..

एमआरसी:मेरी कविता की शुरुआत एक अजीब तरीके से हुई। एक ब्राह्मण परिवार होने के नाते, हमारे इमलीतला घर में हमें मुर्गी के अंडे खाने की अनुमति नहीं थी। मुझे अक्सर हमारे शिया मुस्लिम पड़ोसी से बत्तख के अंडे लाने के लिए भेजा जाता था। मैं दस साल का था। उनके घर की बड़ी लड़की जिसे मैं कुलसुम आपा कहता था, पंद्रह साल की थी. वो मुझे ग़ालिब और फ़ैज़ अहमद फ़ैज़ सुनाती थीं, जिन्हें मैं समझ नहीं पाता था; लेकिन उन्होंने मुझे वो कविताएँ समझायीं। उसने अप्रत्यक्ष रूप से, उन कविताओं के माध्यम से मुझे बताया कि वह मुझसे प्यार करती है। एक दिन जब मैंने खुशबू के कारण उनके घर में पक रहे मांस की मांग की तो उसने मुझे शारीरिक संबंध बनाने के लिए प्रेरित किया। मांस अद्भुत था और उसने अपनी जीभ से मेरे होंठों को चाट कर साफ़ कर दिया। कुछ दिनों बाद मेरे लिंग पर दर्दनाक खरोंचों के कारण मैं डर गया और कुलसुम आपा के घर जाना बंद कर दिया. हालाँकि, कविताओं का प्रभाव बना रहा। मैंने इस यौन संबंध के बारे में अपनी दादी को बताया था, जिन्होंने मुझसे कहा था कि मैं इस बारे में जीवन में कभी किसी से बात न करूं. मुझे अब भी कुलसुम आपा की याद आती है. जब मैं आखिरी बार इमलीतला गया था, तो मैंने परिवार से पूछताछ की और बताया गया कि उन्होंने अपना घर बेच दिया है और इमलीतला छोड़ दिया है। मेरा अगला प्रभाव फिर से राम मोहन रॉय सेमिनरी में नमिता चक्रवर्ती नाम की उच्च कक्षा की लड़की थी, जो बंगाली अनुभाग के लिए लाइब्रेरियन बन गई। मुझे उससे बहुत प्यार था. उन्होंने मुझे मार्क्सवाद से परिचित कराया और मुझे रवीन्द्रनाथ टैगोर और जीबनानंद दास सहित ब्रह्मो लेखकों और कवियों के कार्यों से परिचित कराया। एक दिन मैंने उसकी टेबल पर एक चिट रखी थी जिसमें मैंने लिखा था ‘आई लव यू’. उन्होंने वह चिट सुरक्षित रख ली थी और कई वर्षों के बाद मेरी एक मौसी को दिखाई, जब मेरा नाम पत्रिकाओं और अखबारों में छपने लगा। कुलसुम आपा और नमितादी दोनों के चेहरे पर डिम्पल थे। इमलीतला घर में, हमारे दो नौकर थे, शिवनन्नी और राम खेलावन, जिन्हें भोजन, पोशाक और आश्रय के रूप में भुगतान किया जाता था। चूँकि वे नौकर थे इसलिए वे हम बच्चों को सीधे डाँट नहीं सकते थे। शिवनान्नी को रामचरितमानस कंठस्थ था। रामखेलावन को कबीर, रहीम और दादू के दोहे मालूम थे। दोनों ने उद्धरणों के माध्यम से फटकार लगाई और पंक्तियों को भी समझाया। शिवनन्नी एक खेल खेलती थी, जिसका नाम था, रामशलाका, यानी एक धातु की छड़ी। आपको अपनी आँखें बंद करनी हैं, एक पन्ना खोलना है और रामशलाका को एक पंक्ति में रखना है। शिवनान्नी ने रेखा के आधार पर बताया कि हमारा दिन कैसे बीतेगा. पिताजी इमलीतला को बुरा प्रभाव मानते थे क्योंकि हम पर मुफ्त सेक्स, ताड़ी, भांग, देशी शराब आदि का चलन था। उन्होंने दरियापुर में एक घर बनाया और हम वहां चले गए। मेरे बड़े भाई समीर को स्कूल के बाद की पढ़ाई के लिए कोलकाता भेज दिया गया। इससे मुझे मदद मिली. वह कवियों के समूह में शामिल हो गए और मेरे लिए बहुत सारे कविता संग्रह और पत्रिकाएँ लाए। गिन्सबर्ग हमारे दरियापुर स्थित आवास पर आये थे. इससे पहले गिंसबर्ग और ओरलोव्स्की ने सिंहभूम के चाईबासा में समीर से मुलाकात की थी और महुआ पेय का आनंद लिया था। मुझे अपने जीवन में संपादकों की कोई चिंता नहीं है। जब मुझसे अनुरोध किया जाता है तभी मैं उन्हें अपनी कविताएँ और उपन्यास भेजता हूँ। अधिकांश संपादक मुझसे छोटे हैं और वे मेरा सम्मान करते हैं। हाँ, वास्तविकता से निपटना कठिन है। पहले जब मैं कागज पर कलम से लिखता था तो छवियों, शब्दों, पंक्तियों, वाक्यों का एक बैंक रखता था, अब, उंगलियों, विशेषकर अंगूठे के गठिया के कारण, कंप्यूटर के साथ यह प्रक्रिया कठिन हो गई है। चूँकि मैं नींद की गोलियों सहित बहुत सारी दवाएँ लेता हूँ, इसलिए मैं इन दिनों को भूल जाता हूँ।

…………………………………………………………………

टीएससी: भारत में बांग्ला और अंग्रेजी में वर्तमान लेखन परिदृश्य के बारे में आपकी क्या राय है? क्या ऐसे कोई लेखक हैं जिन्हें आप विशेष रूप से पसंद करते हैं?

…………………………………………………………………

एमआरसी: मुझे इस बारे में ज्यादा जानकारी नहीं है कि अंग्रेजी में भारतीय लेखन में क्या हो रहा है। जहां तक ​​बांग्ला लेखन का सवाल है, लघु पत्रिका जगत में बहुत सारी रोमांचक चीजें हो रही हैं। हर साल कोलकाता पुस्तक मेले के अलावा एक लिटिल मैगजीन मेला भी आयोजित किया जाता है। जिला मुख्यालयों पर पुस्तक मेले भी आयोजित किये जाते हैं। इससे हमें रचनात्मक लेखन की विस्तृत श्रृंखला की झलक मिलती है। जिन कवियों को मैंने हाल ही में नए तरीके से लिखते हुए देखा है, उनमें राका दासगुप्ता, श्रीदर्शिनी चक्रवर्ती, मितुल दत्ता, बारिन घोषाल, धीमान चक्रवर्ती, अनुपम मुखोपाध्याय और बहता अंशुमाली जैसे कुछ नाम शामिल हैं।

……………………………………………………………..

टीएससी: क्या आप भारत और अन्य जगहों पर दक्षिणपंथी और अन्य असहिष्णु ताकतों के सामान्य उदय के बारे में चिंतित हैं?

…………………………………………………………..

एमआरसी: हाँ, मैं पूरे भारत में हो रही नवीनतम घटनाओं से बहुत परेशान हूँ। ऐसा प्रतीत होता है कि धोखेबाजों द्वारा चलाई गई बेकार सरकार, नम्र और असहाय लोगों के खून के प्यासे कट्टरपंथी अपराधियों से प्रभावित सरकार से बेहतर थी। मुझे आश्चर्य है कि इस देश ने कभी हमें खजुराहो, पुरी के मंदिर, मीनाक्षी मंदिर, कोणार्क, अजंता, एलोरा कैसे दिए थे; अश्वमेध यज्ञ के बाद राजा किस प्रकार मांस और मदिरा का आनंद लेते थे।

…………………………………………………………………

टीएससी: क्या सुनील की कविताओं में नीरा और जिसका नाम आपकी कविता, “कृपया मेरी दादी को मत बताना” में आता है, एक ही व्यक्ति हैं? क्या वह असली थी? क्या वह एक लेखिका/प्रकाशक थीं जो जनरेशन के साथ जुड़ी रह सकती थीं? क्या डेबी रॉय की मलार जोन में माला असली है? क्या वह भी जेनरेशन से जुड़ी कवयित्री थीं?

………………………………………………………………

एमआरसी: हां, ये वही नीरा है. सुनील गंगोपाध्याय ने अपनी पत्रिका कृतिबास के लिए मुझसे कभी कोई कविता नहीं मांगी । उनकी मृत्यु के बाद उनकी पत्नी स्वाति गंगोपाध्याय कृतिबास की संपादक बनीं , जिसका संपादन सुनील करते थे। कृतिबास ने मुझसे एक कविता देने के लिए कहा। यह कविता मैंने भेजी थी लेकिन वे इसे कृतिबास में प्रकाशित करने से डर रहे थे । उन्होंने इसे प्रकाशित नहीं किया और मुझसे इसे बदलने के लिए कहा। जाहिर है मुझे मना करना पड़ा. लेकिन यह तथ्य कोलकाता के कवियों और लेखकों के लघु पत्रिका मंडल को पता चल गया। नहीं, देबी रॉय की पत्नी माला कवयित्री नहीं थीं; वह एक गृहिणी थी. हाल ही में उनका निधन हो गया.

…………………………………………………………………

साक्षात्कार पहली बार 10/11/15 को द सनफ्लावर कलेक्टिव में प्रकाशित हुआ था 

…………………………………………………………………

जीवनी:
मलय रॉय चौधरी एक बंगाली कवि और उपन्यासकार हैं, जिन्होंने हंग्रीलिस्ट मूवमेंट की स्थापना की, जिसने 1960 के दशक में बंगाल में कविता जगत में तूफान ला दिया। द हंग्री जेनरेशन एक साहित्यिक/कला आंदोलन था जिसे मलय रॉय चौधरी ने शक्ति चट्टोपाध्याय, समीर रॉयचौधरी और देबी रॉय के साथ मिलकर शुरू किया था।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

द हंगरलिस्ट मूवमेंट इन बंगाल: ए कन्वर्सेशन विद मलय रॉयचौधरी, ज़िनिया मित्रा और जयदीप सारंगी द्वारा।

30806166_10211833416816846_1302726916632029593_o

मलय रॉयचौधरी (1939) एक भारतीय बंगाली कवि, नाटककार, लघु कथाकार, निबंधकार और उपन्यासकार हैं, जिन्होंने 1960 के दशक में हंग्रीलिस्ट आंदोलन की स्थापना की, जिसने अवंत-गार्डे बंगाली साहित्य और चित्रकला के पाठ्यक्रम को बदल दिया। 

उनके सबसे प्रसिद्ध कविता संग्रह मेधार बटानुकुल घुंगुर, जाखम और माथा केते पथाछी जटनो कोरे रेखो हैं; और उनके उपन्यास दुबजले जेतुकु प्रोशवास और नामगंधो। उन्होंने सौ से अधिक पुस्तकें लिखी हैं। 2003 में धर्मवीर भारती के हिंदी कथा साहित्य सूरज का सातवां घोड़ा का अनुवाद करने के लिए उन्हें साहित्य अकादमी पुरस्कार दिया गया, जो इस क्षेत्र में भारत सरकार का सर्वोच्च सम्मान है। हालाँकि, उन्होंने इस पुरस्कार और अन्य को स्वीकार करने से इनकार कर दिया। 

यह साक्षात्कार कार्यकर्ता-लेखक के साथ ईमेल के आदान-प्रदान द्वारा निष्पादित किया गया है।

  1.   बीबीसी के एक साक्षात्कार में एलन गिन्सबर्ग ने अपना परिचय देते हुए अपनी धार्मिक और यौन प्राथमिकताओं के बारे में बताया। उनका कहना है कि वह निश्चित रूप से एक मशहूर कवि हैं, निश्चित रूप से यहूदी हैं, निश्चित रूप से समलैंगिक हैं, निश्चित रूप से ध्यान का अभ्यास करने वाले अमेरिकी हैं। बंगाली कविता में सबसे महत्वपूर्ण आंदोलनों में से एक का नेतृत्व करने वाले मलय रॉयचौधरी अपना परिचय कैसे देंगे?

मलय: गिन्सबर्ग एक बहुत अमीर देश से थे, उनके पिता खुद एक कवि थे और काफी संपन्न थे; इस प्रकार गिन्सबर्ग को पता था कि उन्हें भावी पीढ़ी को याद रखने के लिए क्या छोड़ना चाहिए। वे जिस भी देश में जाते थे, अपने से संबंधित सभी पेपर कटिंग, पत्रिकाएँ आदि अपनी सौतेली माँ को भेज देते थे जो उन्हें देश के अनुसार अपने तहखाने में व्यवस्थित कर देती थीं। उन्होंने अपनी पुस्तकों, कविता पाठों, तस्वीरों और रिकॉर्डों सहित इन वस्तुओं की बिक्री से लाखों कमाए। शुरू से ही लेखन जगत में उनके मित्र थे। उसका मित्र बरोज बहुत अमीर था, फेरलिंगहेट्टी एक प्रकाशक था। जहां तक ​​मुझे पता है भारत से लौटने के बाद उन्होंने तिब्बती बौद्ध धर्म अपना लिया और मृत्यु के बाद बौद्ध रीति से उनका अंतिम संस्कार किया गया; उनकी राख को उनके माता-पिता की कब्रों के बीच रखा गया है, कुछ रेड इंडियन जनजातियों को दे दिया गया है और अमेज़ॅन नदी पर छिड़क दिया गया है। 

मैं पटना के इमलीतला इलाके में एक झुग्गी बस्ती में रहने वाले बीस सदस्यों के एक बहुत ही गरीब परिवार से आता हूं, जिसमें सभी निवासी गरीब महादलित (जिन्हें बचपन में अछूत कहा जाता था) और लखनऊ के हरम के नवाबों के वंशज थे। मेरे पिता एकमात्र कमाने वाले सदस्य थे और लुका-छिपी खेलने के दौरान हमें किसी भी घर में प्रवेश करने पर कोई प्रतिबंध नहीं था। मेरे बड़े चाचा पटना संग्रहालय में एक छोटे कर्मचारी थे और मुझे अपनी छुट्टियों के दौरान संग्रहालय के सभी कमरों को मुफ्त में देखने का अवसर मिला। मेरे परिवार में कोई भी बुजुर्ग स्कूल नहीं गया था और मेरा बड़ा भाई समीर स्कूल और कॉलेज जाने वाला पहला सदस्य था। समीर की साहित्य में रुचि के कारण हमें कलकत्ता (अब कोलकाता) से कविता, उपन्यास, नाटक, आलोचना की पुस्तकें मिलने लगीं और मेरा परिचय साहित्य से हुआ। साहित्यिक परिवार से न होने के कारण मैंने खुद को लिखे गए पत्रों, हंगरीलिस्ट बुलेटिनों और पत्रिकाओं के साथ-साथ अपनी पुस्तकों को भी संरक्षित नहीं किया है। मैं कभी नहीं जानता था कि जब आप मशहूर लेखकों से मिलेंगे तो आपको उनके साथ तस्वीरें खिंचवानी होंगी। स्कूल में (राम मोहन रॉय सेमिनरी- एक गैर-हिंदू स्कूल) मुझे ब्रह्म समाज लेखकों को पढ़ने के लिए महिला लाइब्रेरियन नमिता चक्रवर्ती द्वारा निर्देशित किया गया था। इमलीतला में मुझे फ़ैज़ और ग़ालिब से एक शिया मुस्लिम लड़की ने मिलवाया था (मैं बत्तख के अंडे खरीदने के लिए उनके घर जाती थी) जो उनकी कविताएँ सुनाती थी जो मुझे उस समय समझ में नहीं आती थी, हालाँकि मुझे उसकी सुरीली प्रस्तुति पसंद थी। यह लड़की पहली थी जिसे मुझसे प्यार हुआ और मुझे स्त्री शरीर के रहस्यों से परिचित कराया गया। यह मेरी विषमलैंगिक यात्रा की शुरुआत थी और मैं अब भी विषमलैंगिक हूं। मैं इस अर्थ में हिंदू हूं कि मेरा जन्म एक हिंदू ब्राह्मण परिवार में हुआ था – मैं खुद को सहज हिंदू कहता हूं, मैं दिवाली के दौरान होली और आतिशबाजी का आनंद लेता था। हालाँकि, ब्रह्मो स्कूल में शिक्षा प्राप्त करने के बाद ये सभी चीजें ख़त्म हो गईं; मेरे माता-पिता के पास भी धार्मिक गतिविधियों को समर्पित करने के लिए अतिरिक्त समय नहीं था। मैं निश्चित रूप से बंगाली हूं और निश्चित रूप से भारतीय हूं। वास्तव में कुछ विदेशी देशों का दौरा करने के बाद मुझे एहसास हुआ कि मैं केवल भारत में ही घर जैसा महसूस करता हूं।

  1.   आपके मन में हंगरीवादी कविता का विचार कैसे आया? यह इतना महत्वपूर्ण काव्य आंदोलन कैसे बन गया?

मलय: मैं आपको सही करना चाहूंगा कि हंगरीवादी आंदोलन कविता तक ही सीमित नहीं था। हमारे पास उपन्यासकार, नाटककार और चित्रकार थे। अनिल करंजई को उनकी पेंटिंग के लिए ललित कला अकादमी पुरस्कार से सम्मानित किया गया था। करुणा निधान मुखोपाध्याय ने पोस्टर बनाए और सुबिमल बसाक ने हंगरीलिस्ट बुलेटिनों के लिए कुछ चित्र बनाए, जिन्होंने साठ के दशक के दौरान हंगामा मचा दिया। 

यह मुख्य रूप से इसलिए महत्वपूर्ण हो गया क्योंकि हमने तीस के दशक की आधुनिक कविता और कथा शैली के ख़िलाफ़ लिखना शुरू किया। उन्होंने नज़रुल इस्लाम और जसीमुद्दीन को त्याग दिया था; मधुसूदन दत्ता को भी किनारे किया जा रहा था. हमने कहा कि तीस के दशक के आलोचकों ने अब्राहमिक सिंगल लाइन प्रोग्रेस के संदर्भ में सोचा था जबकि ब्रह्मो टैगोर, क्रिश्चियन मधुसूदन और मुस्लिम जसीमुद्दीन ने तीन अलग-अलग रास्तों में अपनी शाखाएं खोली थीं; साहित्य और इतिहास की पश्चिमी अवधारणाओं के संदर्भ में कविता की कल्पना करना गलत था। अंग्रेजी घोषणापत्र विश्व के विभिन्न साहित्यिक केन्द्रों तक भी पहुंचे और युवा लेखकों ने उन्हें अपनी पत्रिकाओं में छापा। लॉरेंस फर्लिगेटी ने हमारी कविताएँ सिटी लाइट्स जर्नल के तीन अंकों में प्रकाशित कीं । डिक बाकेन ने अपनी पत्रिका सॉल्टेड फेदर्स का एक विशेष हंग्रीलिस्ट अंक प्रकाशित किया ।मार्गरेट रैंडल ने लैटिन अमेरिका में, कार्ल वीस्नर ने जर्मनी में, जॉर्ज डाउडेन ने इंग्लैंड में, गॉर्डन लास्लेट ने ऑस्ट्रेलिया में दुनिया फैलाई। 

  1. हम जानना चाहेंगे कि इस आंदोलन की कल्पना कैसे की गई। क्या आपने कोई घोषणापत्र तैयार किया? क्या यह केवल कलकत्ता केन्द्रित था?

मलय: हंगरीवादी आंदोलन की कल्पना मेरे पटना आवास पर हुई थी जब 1961 में समीर और शक्ति आये थे और देबी रॉय भी मुझसे मिलने आये थे। मैंने उन्हें विभाजन के बाद के दुःस्वप्न की पृष्ठभूमि में स्पेंगलर और चौसर की विचारधारा के बारे में समझाया, जिसका सामना बंगाली समाज उस समय कर रहा था। शरणार्थी तत्कालीन डलहौजी स्क्वायर पर लगभग हर रोज विरोध प्रदर्शन करते थे, रेलवे स्टेशनों पर निराश्रितों की भीड़ लगी रहती थी और हमें हेनरी लुई विवियन डेरोजियो के कट्टरपंथ की याद आती थी। पहला घोषणापत्र समीर के जन्मदिन यानी 1 नवंबर 1961 को प्रकाशित हुआ था.

  अधिकांश अंग्रेजी घोषणापत्र मेरे द्वारा लिखे गए थे। मैं उस समय पटना में रह रहा था और बंगाली प्रेस उपलब्ध नहीं थी। जाहिर है कि पटना में छपे शुरुआती घोषणापत्र अंग्रेजी में थे। मुझे लगता है मैंने लगभग दस से बारह अंग्रेजी में लिखे। मैं उन्हें पैक करता था और देबी रॉय को भेजता था जो उन्हें कलकत्ता कॉफी हाउस, विश्वविद्यालयों, समाचार पत्र कार्यालयों, पत्रिका संपादकों आदि में वितरित करते थे। चूंकि प्रारंभिक घोषणापत्र अंग्रेजी में थे, इसलिए हम फणीश्वर जैसी अन्य भाषाओं के लेखकों का ध्यान आकर्षित कर सकते थे। नाथ ‘रेणु’, रामधारी सिंह ‘दिनकर’, एसएच वात्स्यायन ‘अज्ञेय’, धर्मवीर भारती (जिनका सूरज का सातवां घोरामैंने बांग्ला में अनुवाद किया), नागार्जुन, कमलेश्वर, श्रीकांत वर्मा, खुशवंत सिंह, उमाशंकर जोशी, अरुण कोलटकर, मुद्राराक्षस, धूमिल, सर्वेश्वर दयाल सक्सेना और अन्य। उस समय हिंदी, मलयालम, गुजराती, असमिया पत्रिकाओं ने हमारे आंदोलन के बारे में लिखा और हमारी तस्वीरें प्रकाशित कीं। यहां तक ​​कि नेपाली अखबारों और पत्रिकाओं ने भी हमारे बारे में लिखा; हम नेपाली कवियों पारिजात, बसु शशि, रमेश श्रेष्ठ और अन्य के मित्र बन गए और उनके निमंत्रण पर 1965 में तीन महीने के लिए नेपाल गए थे। हम काठमांडू में हिप्पी कॉलोनी में रहते थे।

नहीं, यह कलकत्ता-केंद्रित नहीं था। मैं और सुबिमल बसाक पटना से आये। बनारस से अनिल करंजई और करुणानिधान मुखोपाध्याय, बालुरघाट से शैलेश्वर घोष और सुभाष घोष, त्रिपुरा से प्रदीप चौधरी और अरुण बनिक, सिलीगुड़ी से आलोक गोस्वामी, अशोकनगर से अबानी धर और बासुदेब दासगुप्ता, बांकुरा से सुबो आचार्य और रामानंद चट्टोपाध्याय, मिदनापुर से संभू रक्षित। जलपाईगुड़ी से समीरन घोष।

  1.     क्या आप बंगाल के अन्य शहरों और गांवों तक पहुंच सकते हैं? कोई भी घटना जो आप हमारे साथ साझा करना चाहेंगे…

मलय : हाँ. मैंने आपको अभी बताया है कि प्रतिभागी विभिन्न स्थानों से आए थे और हम जिलों तक पहुंच सकते हैं। चूँकि कलकत्ता में अधिकांश लेखक हमारे ख़िलाफ़ थे, वे प्रिंटिंग प्रेसों में जाते थे और उनसे कहते थे कि वे हमारे बुलेटिन, किताबें और पत्रिकाएँ न छापें। हमें उन्हें मुद्रित करने के लिए बेरहामपुर, मुर्शिदाबाद में एक प्रेस की व्यवस्था करनी पड़ी और हमने उन्हें कलकत्ता लाने की व्यवस्था की। मनीष घटक, जिनका उपनाम जुबानाश्व था, वहां रहते थे और उन्होंने प्रेस की पहचान करने में मदद की। आप जानते होंगे कि मनीष घटक ऋत्विक घटक के बड़े भाई और महाश्वेता देवी के पिता हैं। प्रेस का संचालन अदरीश बर्धन के बड़े भाई द्वारा किया जाता था; अदरीश बर्धन जासूसी और बच्चों की किताबों के जाने-माने लेखक हैं।

  1.     ‘हंग्री जेनरेशन’ बिल्कुल भी रिचर्ड ह्यूल्सनबेक के यादृच्छिक पेपर चाकू शब्द की तरह नहीं था। आपने यह शब्द जेफ्री चौसर के “इन सोवर हंग्री टाइम्स” से लिया है। क्या भूखवादी आंदोलन में ‘भूख’ के अन्य अर्थ हैं?

मलय: हाँ, बाद के वर्षों में, अदालती मामले के दौरान और उसके बाद, कुछ हंगरीवादियों ने अपना दृष्टिकोण समझाने की कोशिश की। जो लोग वाम मोर्चे का हिस्सा बने, उन्होंने बताया कि हंगरीवादी पश्चिम बंगाल के भूखे लोगों की बात करते थे, शरणार्थी जिस भूख से पीड़ित थे। सुभाष घोष सीपीएम कार्ड धारक बन गए और खुदारो को सामने लाए और बासुदेब दासगुप्ता ने भूख या खुदा पर जोर देने के लिए खुदार्तो खाबोर का संपादन किया । जब मैंने चौसर से उधार लिया तो मैं हंग्री टाइम के बारे में सोच रहा था। समय अधिक महत्वपूर्ण था.

  1.     ओसवाल्ड अर्नोल्ड गॉटफ्राइड स्पेंगलर का ऐतिहासिक सिद्धांत क्या था जिस पर हंगरीवादी आंदोलन आधारित था? क्या अन्य सिद्धांतकार भी थे जिन्होंने आपके आंदोलन को प्रभावित किया?

मलय: स्पेंगलर के अनुसार, दुनिया की हर संस्कृति एक जीव की तरह विकसित होती है। यह विचार अब्राहमिक वंशीय काल या प्रगति से बिल्कुल अलग था जिस पर मार्क्सवाद आधारित है। स्पेंगलर ने संस्कृति की कल्पना एक छोटी चीज़ के रूप में की, यह बढ़ती है, खिलती है और खुद को मजबूत करती है, प्रतिभाएँ पैदा करती है और अंततः गिरावट के चरण में प्रवेश करती है और हमेशा के लिए ख़त्म हो जाती है। स्पेंगलर ने दुनिया भर की कई संस्कृतियों और पूरे इतिहास में इस जैविक प्रक्रिया को मान्यता दी। हमने भूखवाद को इस आधार पर विकसित किया कि बंगाली अब 19वीं सदी के बंगाल के महान लोगों, जैसे टैगोर परिवार, बंकिमचंद्र, विद्यासागर, राम मोहन रॉय, सत्येन्द्र नाथ बोस, अनिल कुमार गेन, प्रशांत चंद्र महालनोबिस, प्रफुल्ल चंद्र रे जैसी प्रतिभाएं पैदा नहीं कर पाएंगे। , देबेंद्र मोहन बोस, जगदीश चंद्र बोस, ज्ञान चंद्र घोष, गोपाल चंद्र भट्टाचार्य, किशोरी मोहन बंद्योपाध्याय, ज्ञानेंद्र नाथ मुखर्जी और मेघनाद साहा और अन्य। और धीरे-धीरे टुटपुंज राजनेताओं से घिरी एक मुरझाती सामाजिक-सांस्कृतिक अर्थव्यवस्था का सामना करना पड़ेगा। मुझे किसी अन्य सिद्धांतकार की याद नहीं आती। हालाँकि, वाम मोर्चा शासन के दौरान सीपीएम की पकड़ उपनगरों में इतनी मजबूत हो गई कि बासुदेब दासगुप्ता, सुभाष घोष, शैलेश्वर घोष, आलोक गोस्वामी वाम मोर्चे में शामिल हो गए। अगरतला में सीपीएम में शामिल हुए अरुण बानिक की राजनीतिक गुंडों ने हत्या कर दी.

  1. “मैं अपने अय्याश सबर्ना चौधरी पूर्वजों के बारे में सोच रहा हूं” हमें अपने पूर्वजों के बारे में कुछ बताएं।

मलय : मेरे पूर्वज गंगोपाध्याय थे। मुगल सम्राट जहांगीर ने रॉय की उपाधि दी और बाद में अकबर ने चौधरी की उपाधि दी। लक्ष्मीकांतो पहले व्यक्ति थे जिन्होंने गंगोपाध्याय के स्थान पर अपने नाम के साथ रॉयचौधरी उपाधि का प्रयोग किया। चूंकि गंगोपाध्याय “सवर्ण गोत्र” हैं, इसलिए परिवार को सबर्णा चौधरी कहा जाता है। सभी जमींदारों की तरह सबर्ना चौधरी भी कई पत्नियों, मालकिनों और बच्चों के साथ आनंद का जीवन जीते थे और अपनी संपत्ति उड़ाते थे। वे उन गांवों के मूल जमींदार थे जो बाद में कलकत्ता बन गए। सुतनुती, गोविंदपुर और कालिकाता के तीन गांव एक खास महल या शाही जागीर या खुद मुगल सम्राट की संपत्ति का हिस्सा थे, जिनकी जागीरदारी थीअधिकार सबर्ना रॉयचौधरी परिवार के पास थे। ब्रिटिश बस्ती दूसरों के कब्जे वाले अड़तीस गाँवों से घिरी हुई थी। हालाँकि 1717 में, ब्रिटिश ईस्ट इंडिया कंपनी को मुगल सम्राट फर्रुखसियर द्वारा जमींदारी अधिकार प्राप्त करने या किराए पर लेने की अनुमति दी गई थी, लेकिन वह जमींदारों या स्थानीय जमींदारों से जमीन खरीदने में असमर्थ थी। यहां तक ​​कि सबर्ना रॉयचौधरी परिवार भी अंग्रेजों को इन गांवों में बसने या व्यापार करने की अनुमति देने के लिए उत्सुक नहीं था, लेकिन यह सुनिश्चित करने के लिए कि सौदा विफल न हो, अंग्रेजों ने मुगल दरबार में रिश्वत दी थी। हाली शहर से बरिशा जाने से ठीक पहले, रॉयचौधरी परिवार को उनकी इच्छा और विरोध के विपरीत, 1698 में कालिकाता पर अपना अधिकार ईस्ट इंडिया कंपनी को हस्तांतरित करना पड़ा। अंततः अंग्रेजों को ‘किराये का अधिकार’ या रुपये के वार्षिक किराए पर तीन गांवों का पट्टा मिल गया। 1,300. दस्तावेज़ फ़ारसी में था. विलेख की एक प्रति बरिशा में सबर्ना संग्रहालय में देखी जा सकती है।

 गाँव ब्रिटिशों को हस्तांतरित होने के बाद सबर्ना चौधरी काफी गरीब हो गए। उन्होंने भी अंग्रेजों की बजाय सिराज उद दौला का साथ दिया और ईस्ट इंडिया कंपनी से सोने के टुकड़े प्राप्त करने में असफल रहे। अब पूरी दुनिया में लगभग 30,000 सबर्ना चौधरी हैं। एक बड़ी संख्या अब निम्न मध्यम वर्ग की है; मेरा परिवार उनमें से एक था। मेरे दादाजी ने लाहौर में फोटोग्राफी व्यवसाय में हाथ आजमाने के लिए अपना परिवार छोड़ दिया, जहाँ मेरे पिताजी का जन्म हुआ था।

  1. हमें उन कवियों के बारे में बताएं जिन्हें पढ़ना आपको पसंद था और जिन कवियों ने आपको प्रभावित किया। क्या आप निकानोर पारा की विरोधी कविता से प्रभावित थे?

मलय: नहीं, मैंने साठ के दशक में निकानोर पारा को नहीं सुना या पढ़ा था जब आंदोलन शुरू हुआ था। ‘श्रुति ‘ नामक एक अन्य बंगाली काव्य समूह ने विरोधी कविता और ठोस कविता पर काम किया। उनके प्रमुख कवि परेश मंडल, सजल बंदोपाध्याय, पुष्कर दासगुप्ता आदि थे। मैंने पर्रा को अस्सी के दशक में पढ़ा था। मैंने किसी पन्ने पर छपी कविता की शक्ल के बजाय कुछ कहने और उसे कहने वाली आवाज़ को अधिक महत्व दिया। इमलीतला में हमारे घर और पिताजी की फोटोग्राफी की दुकान पर काम करने वाले दो कर्मचारी थे, शिवनंदन कहार और रामखेलावन सिंह डाबर। वे तुलसीदास, कबीर, रहीम और दादू को उद्धृत करके हमें उपदेश देते थे- इन दोनों का मेरे साहित्यिक जीवन पर महत्वपूर्ण प्रभाव था।

मुझे जिबनानंद दास, शक्ति चट्टोपाध्याय, अल महमूद की सोनाली केबिन, रिंबाउड की ए सीज़न इन हेल (जिसका मैंने बंगाली में अनुवाद किया है), बौडेलेयर की द फ्लावर्स ऑफ एविल और पेरिस स्पलीन (जिसका मैंने बंगाली में अनुवाद किया है), सर्वेश्वर दयाल सक्सेना की खुटियन पार पढ़ना पसंद है। तांगे लोग, पाब्लो नेरुदा की प्रेम कविताएँ। लेकिन विभिन्न बीमारियों के कारण समय की कमी के कारण अब मुझे पढ़ने का समय नहीं मिल पाता। मेरे अपने लेखन में बहुत समय लगता है। 

  1. क्या आप प्रभाव की किसी चिंता से पीड़ित थे?

मलय: नहीं, मैं नहीं करता. हालाँकि, मेरे सभी कार्यों पर लगाए गए हंग्रीलिस्ट लेबल से मैं चिढ़ जाता हूँ। मैंने 100 से अधिक कविता संग्रह, उपन्यास, लघु कहानी संग्रह, निबंध संग्रह, नाटक प्रकाशित किए हैं और कई पश्चिमी कवियों का अनुवाद किया है। दुर्भाग्य से आलोचकों द्वारा इन पर अधिक चर्चा नहीं की जाती है।

  1. जबकि एलन गिन्सबर्ग के साथ आपकी दोस्ती को व्यापक रूप से कवर किया गया है, हम ऑक्टेवियो पाज़ और अर्नेस्टो कार्डेनल के साथ आपकी बैठकों के बारे में ज्यादा नहीं सुनते हैं। क्या आप कृपया हमें उनके साथ अपनी बातचीत के बारे में और बता सकते हैं?

मलय : गिन्सबर्ग के साथ दोस्ती की चर्चा इसलिए हुई क्योंकि उन्होंने भारत और विदेश में कई प्रभावशाली लोगों के साथ मेरा मुकदमा चलाया, जो बंगाल में किसी अन्य लेखक ने नहीं किया। बल्कि बंगाली पत्रिकाओं ने हमारे आंदोलन के खिलाफ लिखा, जिसमें सुनील गंगोपाध्याय की कृतिबास और सागरमोय घोष की देश शामिल थीं । गिन्सबर्ग ने अबू सईद अय्यूब को, जब वह भारतीय सांस्कृतिक स्वतंत्रता कांग्रेस के प्रभारी थे, गुस्से में पत्र लिखा और मेरी मदद करने से इनकार कर दिया। 

उस समय ऑक्टेवियो पाज़ राजदूत थे और पटना आए हुए थे। वह गवर्नर हाउस में रह रहे थे और शायद जानते थे कि मैं उनसे वहां मिलना पसंद नहीं करूंगा। वह पटना के जिला मजिस्ट्रेट के साथ पुलिसकर्मियों की एक टीम के साथ मेरे आवास पर आये। मेरे इलाके के लोगों को लगा कि मुझे फिर से राज्य विरोधी गतिविधि के लिए गिरफ्तार किया जा रहा है। हमारी चर्चा बांग्ला साहित्य और हम क्या करने का प्रयास कर रहे थे, इस तक ही सीमित थी। न मैंने उनसे पत्र-व्यवहार किया, न उन्होंने। मैं उस समय अपनी अदालती परीक्षाओं के बीच में था और पत्राचार के लिए अधिक समय नहीं दे सका। 

मैं अर्नेस्टो कर्डेनल से 1987 में मिला था जब वह निकारागुआ के संस्कृति मंत्री थे। वह मुंबई आये थे और मैं उनसे उनके होटल के कमरे में मिला था. वह हमारे आंदोलन के बारे में जानना चाहते थे क्योंकि वहां की स्पेनिश और पुर्तगाली लघु पत्रिकाओं के कारण यह खबर लैटिन अमेरिका तक पहुंची थी। TIME पत्रिका के स्पैनिश भाषा संस्करण में भी वही खबर छपी थी जो TIME के ​​अंग्रेजी संस्करण में हमारी तस्वीरों के साथ छपी थी। मैं सैंडिनिस्टा के बारे में बात करना चाहता था लेकिन पाया कि वह इस विषय पर अनिच्छुक था। मेरे पास उनके दो लंबे पत्र थे जिन्हें मैंने संरक्षित नहीं किया है। 

  1. कला में अश्लीलता पर आपके क्या विचार हैं? इसका आरोप एलन गिन्सबर्ग पर लगा है. इसका आरोप सआदत हसन मंटो पर लगा है. जेम्स जॉयस, डीएचलॉरेंस, गुस्ताव फ्लेबर्ट, चार्ल्स बौडेलेयर, हेनरी मिलर, अरुंधति रॉय और कई अन्य लोगों को अधिकारियों की झुंझलाहट का सामना करना पड़ा है। क्या आपको लगता है कि समाज अभी भी उस प्राचीन धारणा को नकारता है कि कला को उपदेशात्मक होना चाहिए?

आपने पश्चिमी दर्शकों के लिए गिन्सबर्ग द्वारा भारतीय भिखारियों और कोढ़ियों की तस्वीरें क्लिक करने पर खुले तौर पर अपना असंतोष व्यक्त किया है। क्या आपको लगता है कि यह एक तरह से अश्लील है?

मलय: समस्या यह है कि जब अंग्रेजों ने भारत में अपना खुद का पाठ्यक्रम पेश किया तो हमने कला के बारे में पश्चिमी दुनिया के दृष्टिकोण से सोचना शुरू कर दिया, विशेष रूप से ईसाई। हम अपने अलंकारशास्त्र, रसशास्त्र और रसों को भूल गये। आदि रस की जेम्स लॉन्ग ने अश्लील कहकर निंदा की थी और उनके कारण जिसे अब बटाला साहित्य के नाम से जाना जाता है, वह लुप्त हो गया है। जेम्स लांग ने रसमंजरी की भर्त्सना कीभरतचन्द्र का. जब अश्लीलता की चर्चा होती है तो कोई कालिदास, जयदेव, विद्यापति, चंडीदास और अन्य पूर्वजों की चर्चा नहीं करता। अब वापस जाना संभव नहीं है क्योंकि हम प्रतीकों, छवियों, सॉनेट्स आदि में फंस गए हैं। अश्लीलता के आरोपों को प्रतिष्ठान में शक्तियों द्वारा लेबल किया जाता है, आम पाठकों द्वारा नहीं। आपने जिन सभी नामों का उल्लेख किया है उन पर प्रतिष्ठान द्वारा हमला किया गया था। बुद्धदेव बसु की रात भोरे बृष्टि और समरेश बसु की बीबर और प्रजापति को अश्लीलता के आरोप में अदालत में घसीटा गया। अचिंत्य सेनगुप्ता ने कहा था कि जिबनानंद दास ने अपनी कविता कैम्पी में अश्लीलता के आरोप में 1949 में सिटी कॉलेज में व्याख्याता की नौकरी खो दी थी।. कला वही होनी चाहिए जो हमारे प्राचीन भारतीय पूर्वजों ने हमें बताई थी; खजुराओ को देखें (विदेशी आक्रमणकारियों द्वारा नष्ट कर दिया गया था जिनके पास एक अलग विश्व दृष्टिकोण था) पुरी मंदिर और कोणार्क या मीनाक्षी मंदिर की मूर्तियां। अधिकांश सुन्दर मूर्तियाँ आक्रमणकारियों द्वारा नष्ट कर दी गईं। अब वे ताज महल को नष्ट करने की बात कर रहे हैं जैसा कि उन्होंने बामियान बुद्ध के मामले में किया था।

हाँ, मेरे पिताजी उन तस्वीरों के कारण गिन्सबर्ग से बहुत नाराज़ थे। गिन्सबर्ग ने पश्चिमी पाठकों के उपभोग के लिए उन्हें अपने इंडिया जर्नल्स में शामिल किया। गिन्सबर्ग एक प्राच्यविद्यावादी साबित हुए। मैं इसे अश्लील नहीं कहूंगा. उन्होंने भारत को एक नियमित पश्चिमी व्यक्ति की नजर से देखा। 

  1. आप क्या सोचते हैं कि हंगरीवादियों ने अपनी खुद की आवाज कैसे विकसित की? यह कविता में पिछली आवाज़ों से किस प्रकार भिन्न थी? क्या आपको लगता है कि आंदोलन के कारण बंगाली कविता में काफी बदलाव आया है?

मलय : निश्चित रूप से बांग्ला कविता बदल गई है। हंगरीवादी आंदोलन से पहले और बाद में लिखी गई कविताओं को देखें। हमने कविता के केंद्र को परिभाषित करने वाले शीर्षक को हटा दिया। शीर्षक अब एक रुब्रिक था और कविताओं में कोई केंद्र नहीं था; कविता पूरे काम में फैली हुई थी। हमने खुलेपन, बहु-निकास, मुक्त रूप, हेटरोटोपिया, एक कविता में केवल एक आवाज की अनुपस्थिति, सीमांतता, तोपों से विराम, अर्थ का प्रसार, विखंडन, स्तर कूद, तार्किक दरारें पेश कीं। राइज़ोमैटिज़्म, प्रतीकों से बचाव, प्रवाह, केन्द्रापसारकता, जटिलता, सूक्ष्म-आख्यान, इंटरलॉकिंग, संकरण आदि।

  1. क्या आपको लगता है कि आदर्शवाद जीवन में महत्वपूर्ण है? कला में? क्या आप समय-समय पर सत्ता में बैठे लोगों के साथ सुर मिलाने वाले कलाकारों से निराश महसूस करते हैं?

मलय : मैं इसे आदर्शवाद नहीं कहूंगा. मैं इसे राय कहूंगा; एक लेखक की समाज, राजनीति, अर्थव्यवस्था, संस्कृति, लेखन और जीवन के अन्य क्षेत्रों पर अपनी राय होनी चाहिए। यह मेरे निराश होने का प्रश्न नहीं है। मुझे तब अजीब लगा जब सुभाष घोष जैसे कुछ भूखे लोग सीपीएम कार्ड धारक बन गए, चंदननगर की सड़कों पर अपने नारे लगाने शुरू कर दिए, मोटे लकड़ी के डंडों के साथ सीपीएम के झंडे लहराए, अपने क्षेत्र में सीपीएम अखबार गणशक्ति का वितरण शुरू किया, सक्रिय हो गए उनकी मोहल्ला समिति के सदस्य। इसी तरह शैलेश्वर घोष बुढ़ापे में तृणमूल कांग्रेस में शामिल हुए और उन्हें शिक्षा मंत्री के साथ फोटो खिंचवाने में खुशी महसूस हुई। बड़ी संख्या में लेखक और कवि सत्ता प्रतिष्ठान में शामिल हो गए – जब उन्होंने सत्ता विरोधी आवाज की बात की तो वे किसके खिलाफ थे? मैं उन्हें राक्षसों द्वारा मोहित किया हुआ पतित मानता हूँ।

  1. हम अनमार्गा और वेस्टपेपर के बारे में जानते हैं । हमें अन्य छोटी पत्रिकाओं के बारे में बताएं जो भूखवादी कविता को प्रकाशित और प्रचारित करती हैं।

मलय: मैंने ज़ेबरा का संपादन किया , दो अंक प्रकाशित हुए। अब (2019) अविष्कार प्रकाशन ने ज़ेबरा का एक संयुक्त अंक प्रकाशित किया है । सुबिमल बसाक ने प्रतिद्वंदी प्रकाशित की , कई अंक प्रकाशित हुए। एक अंक में संदीपन चट्टोपाध्याय द्वारा अपने सभी मित्रों को लिखा गया पत्र प्रकाशित हुआ था, जिससे सुनील गंगोपाध्याय नाराज हो गये थे. देबी रॉय ने चिन्हो प्रकाशित किया । प्रदीप चौधरी ने फू प्रकाशित किया ; यह अभी भी प्रकाशित हो रहा है, हालांकि ज्यादातर प्रदीप के फ्रांसीसी कवि मित्रों की अनुवादित रचनाएँ हैं। प्रदीप काफी समय से फ्रांस में थे। रवींद्र नाथ टैगोर के वंशजों में से एक को समर्पित कविता लिखने के लिए प्रदीप को विश्व भारती से निष्कासित कर दिया गया था। संभु रक्षित ने ब्लूज़ प्रकाशित किया , जिसका उन्होंने नाम बदल दियामहापृथिबी जो अभी भी प्रकाशित हो रही है। अलोक गोस्वामी ने एकाग्रता शिविर प्रकाशित किया। राजा सरकार ने धृतराष्ट्र का प्रकाशन किया। समीरन मोदक नाम का एक शोधकर्ता सभी हंगरीलिस्ट पत्रिकाओं को इकट्ठा करने और एक सर्वग्राही निकालने की कोशिश कर रहा है। हमारे अधिकांश बुलेटिन एक पृष्ठ के पत्रक होते थे और हमने उन्हें संरक्षित करने के बारे में नहीं सोचा था।

  1. शक्ति चट्टोपाध्याय के समूह छोड़ने के बारे में कुछ बताएं?

मलय: शक्ति बेरोजगार था और तीन साल तक समीर के साथ चाईबासा की झोपड़ी में रहता था। इसी दौरान उसे समीर की साली शीला से प्यार हो गया। वास्तव में हे प्रेम हे नोइहशब्दो में उनकी सभी प्रेम कविताएँ इसी अवधि के दौरान लिखी गईं। शक्ति अपना ज्यादातर समय समीर के ससुराल में बिताता था। शक्ति ने चाईबासा काल के दौरान अपने प्रेम जीवन पर आधारित उपन्यास किन्नर किन्नरी लिखा है। चूंकि वह नौकरी पर नहीं थे और ज्यादातर समय नशे में रहते थे, इसलिए शीला के पिता ने उन्हें पटना विश्वविद्यालय से बंगाली साहित्य में मास्टर ऑफ आर्ट्स की पढ़ाई करने के लिए पटना भेज दिया। शक्ति ने सोचा कि समीर और उसके ससुराल वाले शीला की शादी मुझसे कराने की कोशिश कर रहे हैं और बहुत क्रोधित हुए। दरअसल उस समय मैं एक लड़की से प्यार करता था जो उस कविता का केंद्र है जिसके लिए मुझे गिरफ्तार किया गया था। 

  1. क्या आपको लगता है कि कविता में समाज को बदलने की ताकत है?

मलय: नहीं, कविता अपने आप में समाज को बदलने वाली नहीं है। जब यह विद्रोही जनता के लिए एक शक्तिशाली शक्ति बन जाती है तो यह परिवर्तन में योगदान देती है। बांग्लादेश के मुक्ति संग्राम के दौरान जसीमुद्दीन, अल महमूद, समसुर रहमान, शाहिद कादरी, रफीक आज़ाद, निर्मलेंदु गून, रुद्र मुहम्मद शाहिदुल्लाह, अबुल हसन जैसे कवियों ने प्रेरक कविताएँ लिखीं। 

आप शायद जानते होंगे कि 2011 में माइकल रोथेनबर्ग और टेरी कैरियन ने 100 थाउजेंड पोएट्स फॉर चेंज या 100TPC नामक एक आंदोलन शुरू किया था। लेकिन वे यह भी जानते थे कि कविता अपने आप में दुनिया को बदलने वाली नहीं है। परिवर्तन के लिए 100 हजार कवियों के नाम में “परिवर्तन” की अवधारणा सामाजिक परिवर्तन को संदर्भित करती है, लेकिन अन्यथा इसे व्यापक रूप से परिभाषित किया गया है और यह व्यक्तिगत आयोजकों या कवियों की परिभाषाओं पर निर्भर है। 100TPC घटनाएँ आवश्यक रूप से राजनीतिक या दार्शनिक अभिविन्यास साझा नहीं करती हैं। 100TPC “परिवर्तन” को केवल “शांति और स्थिरता के दिशानिर्देशों के अंतर्गत” आने के रूप में वर्णित करता है। यह भारत में भी आयोजित किया जाता है लेकिन मुझे उनके मामलों के बारे में पता नहीं है।

  1. आपकी कविता का ब्रांड आज कितना प्रासंगिक है?

मलय: पिछले कुछ वर्षों में मेरी कविता बदल गई है। मेरा प्रत्येक संग्रह आवाज, रूप और सांस-विस्तार के मामले में एक महत्वपूर्ण मोड़ है। मैं टैगोर, जीबनानंद, शक्ति या जॉय गोस्वामी जैसा कोई ब्रांड विकसित नहीं कर सका।

  1. क्या आप भूखावादी कवियों को ‘क्रोधित’ एवं ‘उग्र’ मानते हैं?

मलय : जब आप अपने लेखन में समाज के बारे में बात करते हैं तो ‘क्रोध’ स्पष्ट रूप से कविता के मानस में प्रवेश करता है। सभी हंगरीवादी कविताएँ ‘क्रोधित’ और ‘आग लगने वाली’ नहीं हैं। सुबिमल बसाक और त्रिदीब मित्रा की लिखी कविताएँ गुस्से वाली हैं। सुबो आचार्य और प्रदीप चौधरी द्वारा लिखित बातें इकबालिया हैं। संभु रक्षित शब्दों और वाक्यों के साथ लगातार प्रयोग करते रहे हैं। देबी रॉय ने अपनी कविताओं में लेवल जंपिंग और तार्किक दरारों का इस्तेमाल किया, जिनमें से अधिकांश सामाजिक-राजनीतिक हैं। स्थापना के खिलाफ विचार कहानियों और उपन्यासों में अधिक तीखे हैं, विशेष रूप से सुबिमल बसाक, बासुदेब दासगुप्ता, अबनी धर, आलोक गोस्वामी और सुभाष घोष की कहानियों में। 

  1. कोई पछतावा…..

मलय: हां, मुझे अपने बीमार पिता को 1987 में मुंबई ले आना चाहिए था, जो मैंने नहीं किया क्योंकि मुझे लगा कि वह पटना में समीर के परिवार के साथ खुश थे। लेकिन अपने आखिरी पत्र में उन्होंने लिखा कि वह बिल्कुल भी खुश नहीं हैं और समीर की पत्नी और बच्चे उनके साथ अच्छा व्यवहार नहीं कर रहे हैं। मेरी माँ की मृत्यु के बाद पिताजी अकेले महसूस करने लगे। वह मेरे बेटे से बहुत प्यार करता था।

  1. क्या आप कृपया हमारे साथ कोई ऐसी कविता साझा करेंगे जो आपका प्रतिनिधित्व करती हो।

मलय: मैं वह कविता साझा करना चाहता हूं जिसके लिए मुझे कोलकाता में 35 महीने तक कष्ट सहना पड़ा, सोने के लिए जगह नहीं थी, खाना नहीं मिला, पुलिस कार्रवाई के कारण ज्यादातर दोस्त गायब हो गए आदि। कविता है ‘स्टार्क इलेक्ट्रिक जीसस’ (या मूल बांग्ला में प्रचंड बोइद्युतिक छुतर )

ओह, मैं मर जाऊँगा, मैं मर जाऊँगा, मैं मर जाऊँगा

मेरी त्वचा धधक रही है

मुझे नहीं पता कि मैं क्या करूंगा, कहां जाऊंगा, ओह, मैं बीमार हूं

मैं सारी कलाओं पर लात मार दूँगा और चला जाऊँगा शुभा

शुभा मुझे जाने दो और अपने लबादे में रहने दो

अँधेरे की उजड़ी छाया में भगवा पर्दा नष्ट हो गया

मेरे द्वारा अन्य लंगर उठवाने के बाद आखिरी लंगर भी मुझे छोड़ रहा है

मैं अब और विरोध नहीं कर सकता, मेरे कॉर्टेक्स में लाखों शीशे टूट रहे हैं

मुझे पता है, शुभा, अपना मैट्रिक्स फैलाओ, मुझे शांति दो

प्रत्येक नस आंसुओं की धारा हृदय तक ले जा रही है

मस्तिष्क के संक्रामक चकमक पत्थर अनन्त बीमारी से विघटित हो रहे हैं

अन्य तुमने मुझे कंकाल के रूप में जन्म क्यों नहीं दिया

मैं दो अरब प्रकाश वर्ष दूर जा चुका हूँ और भगवान के नितंब को चूम चुका हूँ

लेकिन मुझे कुछ भी अच्छा नहीं लगता, कुछ भी अच्छा नहीं लगता

एक से अधिक चुंबन से मुझे उबकाई महसूस होती है

मैं मैथुन के दौरान महिलाओं को भूल गया हूं और संग्रहालय में लौट आया हूं

सूर्य के रंग के मूत्राशय में

मैं नहीं जानता कि ये घटनाएँ क्या हैं लेकिन ये मेरे भीतर घटित हो रही हैं

मैं सब कुछ नष्ट और चकनाचूर कर दूँगा

शुभा को मेरी भूख में खींचो और ऊपर उठाओ

शुभा देनी होगी

ओह मलय!

कोलकाता आज गीले और फिसलन भरे अंगों का जुलूस लगता है

लेकिन मुझे नहीं पता कि अब मैं अपने साथ क्या करूंगा

मेरी स्मरण शक्ति ख़त्म होती जा रही है

मुझे मृत्यु की ओर अकेले ही चढ़ने दो

मुझे मैथुन और मरना नहीं सीखना पड़ा

मुझे आखिरी बूँदें बहाने की ज़िम्मेदारी नहीं सीखनी पड़ी

पेशाब करने के बाद

अँधेरे में शुभा के पास जाकर लेटना नहीं सीखना पड़ा

फ़्रांसीसी चमड़े का उपयोग सीखना नहीं पड़ा

नंदिता की छाती पर लेटे हुए

हालाँकि मैं अलेया की स्वस्थ भावना चाहता था

ताजा चीन-गुलाब मैट्रिक्स

फिर भी मैंने अपने मस्तिष्क की प्रलय की शरण में समर्पण कर दिया

मैं यह समझने में असफल हो रहा हूं कि मैं अब भी क्यों जीना चाहता हूं

मैं अपने अय्याश सबर्ना-चौधरी पूर्वजों के बारे में सोच रहा हूं

मुझे कुछ अलग और नया करना होगा

मुझे आखिरी बार त्वचा जैसे मुलायम बिस्तर पर सोने दो

शुभा का दामन

मुझे अब उस पल की तेज धार वाली चमक याद है, जब मैं पैदा हुआ था

मैं मरने से पहले अपनी मौत देखना चाहता हूं

दुनिया को मलय रॉयचौधरी से कोई लेना-देना नहीं था

शुभा मुझे कुछ पल के लिए अपने पास सोने दो

हिंसक चांदी जैसा गर्भाशय

मुझे शांति दो, शुभा, मुझे शांति दो

मेरे पाप से प्रेरित कंकाल को अपने मौसमी रक्तप्रवाह में नए सिरे से धोने दो

मुझे अपने गर्भ में अपने वीर्य से स्वयं को रचने दो

अगर मेरे माता-पिता अलग-अलग होते तो क्या मैं ऐसा होता?

क्या मलय उर्फ ​​मी बिल्कुल अलग शुक्राणु से संभव था?

क्या मैं अपने पिता की अन्य स्त्रियों के गर्भ में मलय होती?

क्या मैंने अपने लिए एक पेशेवर सज्जन व्यक्ति बनाया होता?

शुभा के बिना मेरे मृत भाई की तरह?

ओह, उत्तर दो, किसी को इनका उत्तर देने दो

शुभा, आह शुभा

मुझे अपने सिलोफ़न हाइमन के माध्यम से पृथ्वी को देखने दो

फिर से हरे गद्दे पर आ जाओ

जैसे कैथोड किरणें चुंबक की चमक की गर्मी से सोख ली जाती हैं

मुझे 1956 के अंतिम निर्णय का पत्र याद है

आपके भगनासा का परिवेश सुशोभित हो रहा था

उस समय कून के साथ

पसलियों को तोड़ने वाली महीन जड़ें तुम्हारी छाती तक उतर रही थीं

मूर्खतापूर्ण उपेक्षा के बायपास में फूला हुआ मूर्खतापूर्ण रिश्ता

आआआआआआआआआआ

मुझे नहीं पता कि मैं मरने वाला हूं या नहीं

हृदय की अथाह अधीरता के भीतर बर्बादी गरज रही थी

मैं विघ्न डालूँगा और नष्ट कर दूँगा

मैं कला के लिए सभी को टुकड़ों में बांट दूँगा

कविता के लिए आत्महत्या के अलावा कोई रास्ता नहीं है

शुभा

मुझे आपके लेबिया मेजा के चिरस्थायी असंयम में प्रवेश करने दीजिए

निराशाजनक प्रयास की बेतुकीता में

मतवाले हृदय के सुनहरे क्लोरोफिल में

मैं अपनी माँ के मूत्रमार्ग में क्यों नहीं खो गया?

मेरे पिता के आत्म-सहवास के बाद मुझे उनके मूत्र में क्यों नहीं भगाया गया?

मुझे डिंब-प्रवाह या कफ में क्यों नहीं मिलाया गया?

उसकी आँखें मेरे नीचे लेटकर बंद हो गईं

जब मैंने देखा कि शुभा पर आराम हावी हो रहा है तो मुझे बहुत दुख हुआ

महिलाएं असहाय रूप दिखाने के बाद भी विश्वासघाती हो सकती हैं

आज ऐसा लगता है कि वुमन एंड एट जैसा विश्वासघाती कुछ भी नहीं है

अब मेरा क्रूर हृदय असंभव मृत्यु की ओर दौड़ रहा है

छेदी हुई धरती से पानी की लहरें मेरी गर्दन तक आ रही हैं

मैं मर जाऊँगा

अरे ये मेरे अंदर क्या हो रहा है

मैं अपना हाथ और हथेली बाहर निकालने में असफल हो रहा हूं

मेरी पतलून पर सूखे शुक्राणुओं से पंख फैल रहे हैं

300000 बच्चे शुभा की गोद के जिले की ओर सरक रहे हैं

लाखों सुइयां अब मेरे खून से कविता तक दौड़ रही हैं

अब मेरे जिद्दी पैर फिसलने की कोशिश कर रहे हैं

शब्दों के सम्मोहक साम्राज्य में उलझे मौत-हत्यारे सेक्स-विग में

मैं जिस कमरे का निरीक्षण कर रहा हूं उसकी प्रत्येक दीवार पर हिंसक दर्पण लगाना

कुछ नग्न मलय को मुक्त करने के बाद, उसकी अस्थापित हाथापाई।

(कॉपीराइट: ज़िनिया मित्रा और जयदीप सारंगी)



Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

অরিন্দম দেবনাথ-এর নেয়া সাক্ষাৎকার

উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় মলয়ের রায় চৌধুরীর অবদান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ  সম্বন্ধিত একটি সাক্ষাৎকার

কবি মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন সমূহ

অরিন্দম. স্যার উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি শুধু এনলাইটেনমেন্ট এর ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসাকেই  ব্যক্ত করতে চান? আপনার কবিতা আমরা বারবার দেখেছি যে “Art for Art’s sake” এই ধারণাটি আপনি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলেছেন|  বাংলা কবিতায় উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি  বোঝাতে চান যদি এ সম্পর্কে একটু আলোকিত করেন ?

মলয় : দ্যাখো, আমি উত্তর আধুনিক শব্দটা প্রয়োগ করার বদলে অধুনান্তিক অভিধা ব্যবহার করি। অধ্যাপক প্রবাল দাশগুপ্ত বলেছেন, আধুনিকতার পরের বাস স্টপ অর্থাৎ অধুনান্তিক, ব্যাপারটা সময়ের নয়, পরিসরের, স্হানিকতার। ধারণাটা লাতিন আমেরিকার ভাবুক ফেদেরিকো দ্য ওনিসের, যিনি প্রথম পোস্টমডার্ন শব্দটা ব্যবহার করেছিলে, তিনি বলেছেন যে স্পেন আর পর্তুগালের সাম্যাজ্য থেকে বেরিয়ে যাবার পর লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যে লাতিন আমেরিকার সব কয়টি দেশে শিকড় নিয়েছে যার সঙ্গে ইউরোপীয় আর মার্কিন সংস্কৃতির মিল নেই। পর্তুগাল আর স্পেন সেখানে খুনোখুনি করেও এনলাইটেনমেন্টের মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। সেখানকার খ্রিস্টধর্মে প্রবেশ করেছে আফ্রিকা থেকে আনা ক্রীতদাসদের সংস্কৃতি আর আদি উপজাতিদের সংস্কৃতি। সারা ভারতে তেমনই ইংরেজরা যাবার পরে আমরা দেখছি একধরণের মিশেল ঘটে চলেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে।ইউরোপ-আমেরিকা যাকে বলছে পোস্টমডার্ন বৈশিষ্ট্য, আমরা সেই বৈশিষ্ট্যের মানুষ নই। লাতিন আমেরিকায় ম্যাজিক রিয়ালিজম সম্ভব হয়েছে। ভারতের সালমান রুশডি তা ভারতের জন্য সম্ভব করেছেন। বাংলায় অজিত রায়, সুবিমল বসাক, সুবিমল মিশ্র, রবীন্দ্র গুহ করেছেন ।

আর্ট ফর আর্ট সেকের ধারণাও ইউরোপের চাপানো । আমাদের দেশে, বিদেশিরা এসে যাকে বলল আর্ট, তা কেবল আর্টের জন্য নয় । পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দেবতারা পরাবাস্তব আদল-আদরার কিন্তু তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের দ্বারা পূজ্য। অজন্তা-ইলোরা, তাজমহল, দিল্লির জামা মসজিদ, দক্ষিণ ভারতের অপূর্ব মন্দিরগুলো, খাজুরাহোর মন্দিরগুলো এমনকি রাজা রবি বর্মার আঁকা দেবী-দেবতারা আর্ট ফর আর্ট সেক নয়। আর্ট শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘শিল্প’ উনিশ শতকে তৈরি। আমেরিকান আর ইউরোপীয়রা তাই আমাদের দেবী-দেবতার মূর্তি কালোবাজারে কিনে আর্ট হিসেবে নিজের বাড়িতে সাজিয়ে রাখে।বহু মন্দির থেকে দেবতার মূর্তি লোপাট হয়ে সথবির নিলামে উঠেছে।

বাংলায় আর অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় যে কবিতা এখন লেখা হচ্ছে তা স্বাধীনতার আগে লেখা কবিতা থেকে একেবারে আলাদা। বিস্ময়কর বাঁকবদল ঘটে গেছে। তাছাড়া এখন হাজার হাজার কবিরা কবিতা লিখছেন। মডার্ন বা আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্প থাকতো নিটোল, প্রতীকী, একক, সমগ্র,  ব্যাখ্যাযোগ্য। বোঝা যেত যে কবির হাতে ছিল অফুরন্ত সময় এবং তাঁর জীবনের গতি এখনকার তুলনায় ছিল মন্থর। অধিকাংশ মডার্ন কবিতা তাই এক-স্হিতি, এক-অভিজ্ঞতা, এক-ছবি নির্ভর ছিল। বস্তু, স্হান, প্রাণি, সংস্হা, আইডিয়া ও সময়, যে ছয়টি জিনিসকে দিয়ে অভিজ্ঞতা-বিশেষটি গড়ে ওঠে, তার যে-কোনওটির একটির প্রতি আলোকপাত করে তিনি তাকে রচনার বিষয় ঘোষণা করতেন। বাস্তবের যে-প্রতিমা তিনি নিজের মস্তিষ্কে নথিবদ্ধ করে রাখতেন তা সংখ্যায় অল্প ছিল বলে যেটা চাই তা প্রয়োগ করতে পারতেন। তাছাড়া, ভাষার চেতনার তুলনায় তিনি নিজের চেতনা নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।ভাষার চেতনা তুমি পাবে জীবনানন্দ দাশ, শম্ভু রক্ষিত, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখের কবিতায়।

অধুনান্তিক কবিতায় চিত্রকল্প হয়ে গেছে ভঙ্গুর। তার কারণ বাস্তব জগৎ থেকে প্রতিমায় ঠাসা সংকেত অত্যন্ত দ্রুত বেগে একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে কবির পঞ্চেন্দ্রিয়ে। প্রতিমা বহনে সক্ষম উদ্দীপকগুলোকে ঘনঘন সক্রিয় হয়ে উঠতে হচ্ছে। আধুনিক কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের রচনার সঙ্গে অধুনান্তিক কবি জহর সেনমজুমদারের পাঠকৃতি তুলনা করলেই টের পাওয়া যাবে ব্যাপারটা। প্রক্রিয়াটি কালিক ও অনিবার্য। এতে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, এসমস্ত চিন্তা অবাস্তব। আধুনিকের তুলনায় অধুনান্তিক এগিয়ে যাচ্ছে মনে করার কারণ নেই।

অরিন্দম.উত্তর আধুনিক কবিতার যে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠতে পারে  এ বিষয়ে আপনার কবিতা আমাদের  পথপ্রদর্শক| কিন্তু সেই প্রতিবাদ কি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক? বর্তমান মতাদর্শহীনতার যুগে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রীয়  কর্তৃত্ববাদকে অস্বীকার করা কবিতার মাধ্যমে কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে ?

 মলয়: কেন হবে না । ভারভারা রাও তো কতোদিন ধরে জেলে আটক রয়েছেন। মুম্বাইতে জাতীয় তদন্ত সংস্থার অফিসে নিরন্তর জিজ্ঞাসাবাদের পর, কবির কলা মঞ্চের দুই কর্মী – সাগর গোর্খে আর রমেশ গাইচোরেকে  ২০১৮ সালে এলগার পরিষদের মামলার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷নেহরু বিরোধী কবিতার জন্য জেল হয়েছিল  মাজরুহ সুলতানপুরীর যিনি মুম্বাই ফিল্মের জন্য অজস্র গান লিখেছিলেন।অন্ধ্র প্রদেশের বিপ্লবী লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,  কুটুম্ব রাও, নাট্যকার রচককোণ্ডা বিশ্বনাথ শাস্ত্রী, কবি ও ঐতিহাসিক কে.  রমনা রেড্ডি, জ্বলামুখী, নিখিলেশ্বর, নাগনা নুনি এবং চেরাবন্দ রাজু (দিগম্বর কবি হিসাবে পরিচিত) এবং আরও কয়েকজন।  অর্ধ শতাব্দী ধরে এটি দক্ষিণ ভারতে দলিত সাহিত্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। বুঝতেই পারছ যে ওনাদের কাজ আর্ট ফর আর্ট সেক নয়। রাষ্ট্র কবিতাকে ভয় পায়, তা সে নজরুলের কবিতা হোক, শম্ভু রক্ষিতের কবিতা হোক বা মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা হোক ।

কলিম খান, জহর সেনমজুমদার, প্রভাত চৌধুরী প্রমুখ ভাবুক ও কবিদের মতে আধুনিকতার স্বনির্ভর, আত্মগঠনকারী অহং ভেঙে পড়েছে, এবং অন্তর্হিত হচ্ছে। অশোক বিশ্বনাথন তাঁর বক্তৃতায় বাংলাসাহিত্যের ভঙ্গুর আত্মপরিচয়ের উদ্ভব চিহ্ণিত করেছিলেন ফালগুনী রায়ের কবিতায়। ফ্রাঙ্কফার্ট স্কুলের ভাবুকরা, এবং বদরিলার, বলেছেন যে, এখনকার আমলাতান্ত্রিক, গণমাধ্যম-প্রদূষিত, ভোগবাদী ভিড়ের চাপে ব্যক্তি নস্যাৎ হয়ে গেছে, উবে গেছে। এইরকম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অহং ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে রুপান্তরিত হয়েছে হইচইপূর্ণ অস্হিরতায়, অসংলগ্নতায়। আধুনিকতার উদ্বেগের জায়গায় এসেছে পোস্টমডার্ন হিস্টিরিয়া। স্বাভাবিক যে পোস্টমডার্ন কবিতা থেকে উদ্ভূত হবে থ্রিল। আধুনিক কবিতার মতন ‘বুঝতে পারার’ বা মানে বের করার সম্ভাবনা তাতে থাকবে না। নয়ের দশকের অধিকাংশ কবি তাই আহ্লাদ যোগান, মানে যোগান না। আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠানরূপে বিরোধীতাকারী শুভঙ্কর দাশ বা দীপঙ্কর দত্ত এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য । কবিতায় পোস্টমডার্ন মনস্তাত্বিক পীড়াগুলোকে, কবিরুল ইসলামের একরৈখিক ও প্রভাত চৌধুরীর বহুরৈখিক পাঠকৃতির তুলনামূলক আলোচনাকালে, সুজিত সরকার চিহ্ণিত করেছিলেন ‘লজিক্যাল ক্র্যাক’ রুপে । লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তিফাটল, এই শব্দবন্ধটি সমীর রায়চৌধুরীর।

বর্তমান উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে আইডেনটিটি আদপে সম্ভব কিনা, তা আধুনিক জওহরলাল নেহেরুর সামনে লালু যাদবকে উপস্হাপন করলে, সরোজিনী নাইডুর সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপস্হাপিত করলে, সুস্পষ্ট হয়। আধুনিক কবি শঙ্খ ঘোষ রুপোর চেনে তামার মাদুলি বেঁধে সাহিত্য অকাদেমিতে কবিতা পড়ছেন এটা ভাবা যায় না, তাঁর আইডেনটিটির কারণে। কিন্তু বাংলা অকাদেমিতে ছয় থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত বহু কবিকে ভিড় করতে দেখা যায় যাঁরা তাবিজ, মাদুলি, গ্রহরত্নের আংটি ভূষিত, এমনকি মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনীতি করেন বা ফেলো ট্র্যাভেলার । তা এই জন্যে যে তাঁদের আইডেনটিটি গুলিয়ে গিয়ে এক অধুনান্তিক আইডেনটিটিহীনতা গড়ে দিয়েছে। তাঁরা নিজেদের আইডেনটিটি চয়ন নিয়েও নিশ্চিত নন। এঁদের কবিতার যে ফ্যান্তাফ্যাচাঙ আলোচনা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় তা ন্যায্য।

অরিন্দম:.আপনার বিভিন্ন কবিতা যেমন “পাঁচ” ,”  সাত”, “একিলিসের গোড়ালিতে নিক্ষিপ্ত তীরের প্রতি”   প্রত্যেকটিতেই কালচারাল ক্যাপিটালিজম এর বিরোধিতা করা হয়েছে| কবিতা কিভাবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে কাউন্টার রেভুলেশন এর কাজ করতে পারে। প্রযুক্তিগত আধিপত্যের প্রভাবে সবকিছু যে একমাত্রিক হয়ে উঠেছে তার ক্ষতিকারক দিকগুলি কে কিভাবে উত্তর আধুনিক কবিতা খণ্ডন করতে পারে?

 মলয়:

অরিন্দম .”আমার মহান পরিনির্বাণ একটি পোস্টমর্ডান কবিতা”- “ও নকশাল ছিল বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা ওই  কেটেছিল” এই বক্তব্য কি নকশাল আন্দোলনের বিপথগামীতা  ও রোমান্টিক  ভাবধারার প্রতি  শর্তহীন সমর্পণকেই নির্দেশিত করেছে| 

 মলয়: নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে আমি তাঁদের বলি এই গানটা শুনতে:

তোরা  যে যা বলিস ভাই,      আমার সোনার হরিণ চাই।          

মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই॥

সে-যে  চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।

সে-যে  নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।

আমি    ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই–

আামি   আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

তোরা  পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে–

যারে    যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।

আমার  যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে–

আমার  ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস, বুঝি মরি তারি শোকে?

আমি    আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।

আমি    আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই॥

এফ গুয়াত্তারি বলেছেন যে, অহংসমূহের বিস্ফোরণে গড়ে উঠেছে পিণ্ডীভূত গণসমূদায়। তারা নানা উদ্ভট প্রণালী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । ব্যা্পারটা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল ফুটবলের বিশ্বকাপের সময়ে কলকাতায়, যখন লুম্পেনরাও সংবাদপত্রের ভাষায় খেলার আলোচনা আরম্ভ করেছিল।সংবাদপত্রের প্রভাবে জেলাগুলোতেও একই ব্যাপার দেখা গিয়েছিল। আর যারা আইন প্রণয়ন করে তাদের কাণ্ডকারখানা তো প্রতিনিয়ত দেখছি বিধানসভায় ও লোকসভায়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পার্ধক্য গুলিয়ে গেছে। পার্টির ক্যাডার বলতে যাদের বোঝায়, তারা ব্যক্তি কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ করে ফেলে তারা নিজেরাই নিজেদের কাজকারবারের দ্বারা। আইডেনটিটি বলতে যে ব্যাপারটা টিকে আছে তা বাজার-আইডেনটিটি, রক্তমাংসের তৈরি ভোগ-বাক্স, মানুষের মতন দেখতে। আধুনিক শিল্প-সাহিত্য, এবং তা থেকে বা তাতে উদ্গত আত্মপরিচয়ের যুগের পর আমরা এসে পৌঁছেচি এক ভিন্ন কালখণ্ডে। এখানে কারোর আত্মপরিচয় নেই।

 সোভিয়েত ব্যবস্হার পতন, বার্লিনের দেয়াল ভেঙে পড়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন, পশ্চিমবাংলা আর ত্রিপুরায় বামপন্হীদের কুর্সিছাড়ার সঙ্গে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা জুড়লে বুঝতে গোলমাল হবে । বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা  মার্ক্সে বিশেষ আগ্রহী নয় ; যারা বিপ্লব করে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখছে তারা লেনিনবাদী বা মাওবাদী । মার্ক্সবাদ  যুক্তি দিয়েছিল যে একটা জাতির উৎপাদন সম্পর্ক জাতিটির ‘অবকাঠামো’ নির্ধারণ করে, যা সর্বহারা শ্রেণী এবং পুঁজিবাদীদের দ্বারা চিহ্ণিত , যেখানে শ্রম শোষণের জন্য একটি প্রবণতা নিয়ে বিরোধ ছিল। এই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ‘সুপারস্ট্রাকচার’ তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠান । পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের (সর্বহারা শ্রেণীর) কাছ থেকে আরো শ্রমের চাহিদা বাড়াচ্ছিলেন , এটি কোনও নির্ণায়কে পৌছায় না ; তখন বিদ্রোহ হবে এবং প্রাক্তন বাহিনী উধাও হয়ে যাবে। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র হবে, যার মাধ্যমে জনসাধারণ দেশ শাসন করবে। যাইহোক, যেমন সিস্টেমের মধ্যে সাধারণত ঘটে, নতুন এলিট সম্প্রদায় তৈরি হলো এবং সব ঝোল তারা নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করতে লাগলো । সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের বদলে একজন মানুষ একনায়ক হয়ে দেখা দিল, এবং প্রতি ক্ষেত্রেই তারা সৈন্যবাহিনীর পুরুষ ।                                     

অরিন্দম:. “আমার মহান পরিনির্বাণ একটি পোস্টমর্ডান কবিতা”-  এখানে বামপন্থীদের রাষ্ট্রবিরোধীতা এবং কিছু তরুণ প্রাণের অকাল প্রয়াণ কে হাতিয়ার করে একশ্রেণীর মানুষের ক্ষমতায় আসীন হওয়া এটা কি মার্কসবাদ এর সঙ্গে অন্যান্য ধারার রাজনীতিকে এক করে দিচ্ছে না? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি যে মার্কসবাদ এর নৈতিকতা ও আদর্শ   পুঁজিবাদ ও উদারনীতিবাদের মতোই শাসক শ্রেণীর বিশেষ শ্রেণীর ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথ হিসাবে কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে বেছে নিচ্ছে না?

মলয়: তুমি “হাংরি যুগ” বইটা পড়লে দেবী রায়ের সঙ্গে আমার এই কথোপকথন থেকে তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে —

হাংরি নামের  আন্দোলন আরম্ভ করার ব্যাপারটা আলোচনা করলুম, চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ আর স্পেংলারের দর্শন খোলোশা করলুম ওর কাছে । হারাধনকে বোঝালুম  ‘হাংরি’ শব্দটা পেয়েছি ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের In Swore Hungry Tyme বাক্য থেকে। আর আন্দোলনের তাত্বিক বনেদ হলো দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West বইটার কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য । 

—হাংরি মানে জানি, কিন্তু ইংরেজ কবির লেখা থেকে কেন ? জিগ্যেস করল হারাধন।

বললুম, এই হাংরি শব্দটা খাওয়ার নয়, সময়ের, খারাপ সময়ের । 

—অনেকে ক্ষুধার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে। ভাববে হাংরি মানে ক্ষুধার্ত।ভাববে আমরা খেতে পাচ্ছি না বলে-বলে লেখালিখি করতে হবে । চোখ কুঁচকে বলল হারাধন ।

—আমি তাই চসারের ‘হাংরি টাইম’ শব্দবন্ধের কথা বলছি ; ভারত আর বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, দেশভাগের পর  একটা খারাপ সময়ের আবর্তে পড়েছে ; সমাজ , সংস্কৃতি , রাজনীতি , ধর্ম , মানুষে-মানুষে সম্পর্ক , জাতিপ্রথা বলো, আমরা উত্তরঔপনিবেশিক ঘুর্ণিতে পাক খাচ্ছি । মানে, এসট্যাবলিশমেন্ট নামের অক্টোপাস বা ক্ষমতার পীঠস্হানগুলো সব কয়টা আঁকশি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। আমরা পীঠস্হানগুলোর সব কটা আঁকশিকে আঘাত করব।

বললুম, বাঙালির সমাজে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, সমাজ,শিল্প ও সাহিত্যের  আন্দোলন শুরু করব আমরা, তার নাম হবে হাংরি  বা হাংরিয়ালিস্ট  । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটাকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধ বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে গ্রাহ্য হবে যেভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি শংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো  হয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেব আমরা ।

  মার্ক্সবাদ শুনলেই পশ্চিমবাংলার পেটমোটা নাড়ুগোপাল টাইপের নেতাদের মুখ ভেসে ওঠে, গ্রামে তিনতলা আধুনিক বাড়ি, শহরে ছেলের জন্যে নার্সিং হোম, মেয়ের জন্যে ইশকুল করে দিয়েছেন জনগণের গ্যাঁড়ানো টাকায় ; সেই সঙ্গে সাঁইবাড়ি হত্যা, মরিচঝাঁপি গণহত্যা, আনন্দমার্গীদের জ্যান্ত পোড়ানো, নানুর গণহত্যা, নন্দীগ্রাম গণহত্যা আর আরও নানান কেলোর কীর্তি । কিংবা সেই সব গালফুলো নেউলে লেখকদের মুখ ভেসে ওঠে যারা রাতারাতি জার্সি পালটে বামপন্হী শাসকদের লেজ ধরে পুরস্কার বা কুর্সি  হাতিয়ে ফালতু বইকেও বেস্টসেলার করে ফেলেছিল । অথচ মার্ক্সবাদ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবলে আটক এই লোকগুলোর রাজনৈতিক কাজকারবারের কোনো সম্পর্ক ছিল  না । 

   কমিউনিজম বলতে বামপন্হীরা যা বোঝানোর চেষ্টা করেন, তা মার্ক্সবাদ নয়, তা লেনিনবাদ আর মাওবাদ । সোভিয়েত রাষ্ট্র কিংবা মাওয়ের চিন,  মার্ক্স-কথিত কমিউনিস্ট দেশ ছিল না। সবচেয়ে মজার যে নব্যপুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ চিন তার একমাত্র দলটাকে বলে কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না । কমিউনিস্ট পার্টি বলতে কী বোঝায় তা লেনিন বাতলে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাই আমাদের দেশের মার্ক্সবাদীরা চোখ খুলে দেখেনি যে জাতিপ্রথা কেমন ভয়ঙ্কর চেহারায় এখানে সক্রিয় । চিনও চেষ্টা করছে জিনজিয়াং প্রদেশে হালাল-প্রথা বন্ধ করতে, নামাজ পড়া বন্ধ করতে ; যারা করছে তাদের পাঠানো হচ্ছে সংশোধনাগারে — এই সমস্ত সংশোধনের কথা মার্ক্স বলে যাননি । তিব্বতে হানদের পাঠিয়ে তিব্বতি তরুণীদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সেখানকার ডেমোগ্রাফি আর সংস্কৃতিকে বদলে ফেলতে চাইছে ।

অরিন্দম:.“একিলিসের গোড়ালিতে নিক্ষিপ্ত তীরের প্রতি”কবিতায় ফেরারি ফৌজে দেশদ্রোহ  শুকে”, “ ইউ-২৩৫,৪০ হাজার কলাসনিকভ” “ঐতিহ্য খানকির বাচ্চা পুরুতমোল্লার  জিভ প্রস্রাবের কল”এই শব্দ বন্ধগুলির ব্যবহার কি প্রথাগত অপ্রথাগত অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাজনীতির ব্যাপক ব্যবহার একইসঙ্গে ধর্মকে রাজনীতির একটি আবশ্যিক অংশ হিসেবে ব্যবহার করা; শুধু কি এর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হবে; নাকি একবিংশ শতাব্দীর “এনোনিমাস”  বা “অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট” এই ধরনের আন্দোলন গুলির মতো বাংলা কবিতা বা উপমহাদেশীয় কবিতা উত্তর আধুনিকতার  ধারক বাহক হিসাবে  ভারতীয় প্রেক্ষিতে কতটা রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কতটা  প্রভাবিত করতে পারে?

মলয়:অতি-উন্নত দেশগুলোয় শিল্পোদ্যোগ-উদ্ভূত পরিস্হিতির কারণে, এবং প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে, ঐতিহ্য সম্পর্কিত স্মৃতিবিপর্যয়ের কারণে, ব্যাক্তির আইডেনটিটি আদপে থাকে কিনা, সেটাই হয়ে উঠেছে দার্শনিক প্রশ্ন। অর্থাৎ অধুনান্তিক ভাবনায়, বৌদ্ধধর্মের মতন, আত্মপরিচয় একটি অলীক ব্যাপার, একটা মিথ। অধুনান্তিকতা কোনো আন্দোলন নয়। আত্মপরিচয়ের যুক্তিবাদী ও সত্তাবাদী ধ্যানধারণাকে স্বীকার করেনা অধুনান্তিক চিন্তাধারা। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের প্রকোপে ব্যক্তি ও কৌমসমাজ এখন দ্রুতিআক্রান্ত। কবি-শিল্পীর অধুনান্তিক আইডেনটিটিহীনতা আমরা এখনকার বাংলা সংবাদপত্রের সিনেমার পাতাটি দেখলে টের পাই, যে পৃষ্ঠাটি মধ্যবিত্ত বাঙালি-সমাজে আধুনিকতার প্রথমার্ধে ছিল প্রায় নিষিদ্ধ, এবং যে পৃষ্ঠাটিতে বর্তমান কালখন্ডে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি, গ্রন্হপ্রকাশ, গুণিজন সম্বর্ধনা বিজ্ঞাপিত হয় — গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে।

জাক দেরিদা, জুলিয়া ক্রিস্তেভা, মিশেল ফুকো প্রমুখ, মনে করেন যে, ব্যক্তির আইডেনটিটি ব্যাপারটি পুরোপুরি ভাষার কারসাজি, সমাজের বানানো। তা একটি অতিমীমাংসিত মায়া। আইডেনটিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয়ের সঙ্কট স্রেফ গাঁজার দম। এঁরা যে কথাগুলো বলেছেন তা বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন বহুকাল আগে বলে গেছেন। তিনি ‘আত্মন’ এর অস্তিত্বকে মানেননি। জায়মান উপলব্ধি ও ক্রিয়া, যা দিয়ে ব্যক্তিজীবন গঠিত, তার মালিকানা হয় না, বলেছিলেন নাগার্জুন। হিন্দুধর্মে আত্মনকে মনে করা হয়েছিল শাশ্বত-একক, এবং আমাদের প্রাগাধুনিক কাব্য রচয়িতারা তার দ্বারা প্রগাঢ়ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু বাংলা কবিতায় নাগার্জুনের বা পোস্টমডার্ন ভাবনা-প্রসূত আইডেনটিটিহীনতা নিয়ে কাজ আমরা দেখেছি উৎপলকুমার বসুর ইদানিংকালের কবিতায়, এবং তাঁর বহু কবিতায় একাধিক কন্ঠস্বরের প্রয়োগ করেছেন তিনি। ওয়ার্ডসওয়র্থ ও প্রমথ চৌধুরীর চিন্তার জারকরসে চোবানো আলোচকরা যে অমন পাঠকৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে অপমানিত বোধ করবেন তা স্বাভাবিক।

বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাত এক সাক্ষাৎকারে  ঝুমুর গান নিয়ে  আলাপচারিতায় সোহম দাসকে বলেছেন, “ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন রাজন্যভাতার বিলোপ হল, তখন ঝুমুরকে মদত দেওয়ার আর কেউ থাকল না। ঝুমুরের শ্রোতা হল সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অনেক গান রচিত হল এবং সেগুলো কিছু নিচুস্তরের যৌন-উত্তেজক  গান  হল। ঝুমুরকে সেই সময়টায় বলা হতে লাগল, ‘মাতালদের গান’। বলা হল, যারা মুনিশ, কামিন, বাগাল, মানে যারা শিক্ষিত লোক নয়, এটা তাদের গান। সেই সময়টাতে ঝুমুর ভীষণ নিন্দিত হতে থাকল। যারা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তারা ঝুমুর সম্পর্কে বলত যে, না, না, ওইসব গান চলবে না। কলকাতারও কিছু পণ্ডিত-শিল্পী ঝুমুরকে ‘যৌনগন্ধী’ গান বলে আখ্যায়িত করল। এটা ঠিক ভদ্র সমাজে চলে না, এরকম একটা গান। আমরা যখন ঝুমুর নিয়ে চর্চা শুরু করলাম, তখন কিন্তু বাড়ির লোকরা আমাদের বাধা দিত। বাবা এসে বলতেন যে, না, না, বাড়িতে এসব ঝুমুর গান নয়, ওসব বাইরে।”

 অর্থাৎ, আদি ঝুমুর গান বিলুপ্ত হয়ে গেল এবং তার জায়গায় দেখা দিল ভদ্রলোকদের ড্রইঙরুমে চলতে পারে এমন সব লিরিক্স, যাকে প্রকৃত ঝুমুর গান বলা যায় না । আদি ঝুমুর পর্বে শিল্পী ও শ্রোতারা ছিলেন প্রান্তিক অর্থাৎ নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষ। ধর্ম ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন অন্ত্যজ। এই সময়ে স্থানীয় কূর্মি, মাহাতো, কুমোর, রাজওয়ার, ঘাটাল, হাড়ি, মুচি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঝুমুর। একই সময় ঝুমুর গান করতেন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।

অরিন্দম:. ২০০১ সালে “হাওয়া-৪৯” পত্রিকায় উৎপল কুমার বসু মলয়ের রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান সম্পর্কে লিখেছিলেন- তিনি উল্লেখ করেন  তথাকথিত বাংলা সংস্কৃতির ঘরে তার লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের ভূমিগুলোকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন| সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে রাজনীতি ঢুকে গেছে এবং প্রতিষ্ঠানকে আমুলে পরিবর্তন করতে হলে রাজনীতি ছাড়া যে গতি নেই এ বিষয়ে আপনি কতটা সহমত| আপনি একবার বলেছিলেন ,“লেখা রাজনীতি ছাড়া কি হতে পারে?- নিম্নবর্গীয় মানুষ তাদের যে কথ্য ভাষা রোজকার জীবনযাপন এবং সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব লেখা দিয়ে গর্জে উঠছে না তার কারণ হিসেবে  আপনার অভিমত কি?

 মলয়: যাঁরা আমার স্মৃতিকথা ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ( চর্চাপদ ) আর ‘ছোটোলোকের জীবন’ (প্রতিভাস) পড়েছেন, তাঁরা আমার শৈশবের ইমলিতলা পাড়ার সঙ্গে পরিচিত । ইমলিতলা ছিল পাটনা শহরের গরিব অন্ত্যজদের, যাদের এখন মহাদলিত বলা হয়, তাদের বস্তি ।   আমার চরিত্রগঠনে বা বিগঠনে খাঁটি অবদান  ইমলিতলার মানুষগুলো  ; সেখানকার অভিজ্ঞতা আমাকে শিক্ষিত করে তুলেছে, শিখিয়েছে মানসিক-ঔদার্য, সারগ্রাহীতা, তার প্রতিটি বাসিন্দা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বেপরোয়া, গোলমালকারী, স্হিতাবস্হাবিরোধী, যারা নিজেদের বলতো “দুনিয়াকা নাসুর”, মানে পৃথিবীর এমন নালি-ঘা, যা সারে না । প্রথমে বিদেশি ও পরে স্বদেশি সরকার তাদের জীবনযাত্রার লড়াইকে মনে করেছে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ, মনে করেছে মৌরসি-পাট্টার শত্রু, তাদের মনে করেছে বিপজ্জনক, অথচ তা ছিল ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা । জীবনকেচ্ছা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতো ইমলিতলা পাড়ায় কিন্তু সেসব নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের মতন কেউই খিক-খিকে হাসি হাসতো না, মাথা ঘামাতো না । 

ইমলিতলা পাড়ায় কবিতা নামে কোনো ব্যাপার ছিল না । ছিল ভোজপুরি বা পাটনাই গান, যাকে কেবল পাড়ার লোকেরা নয়, আমাদের বাড়িতেও অশোভন বা অশ্লীল মনে করা হতো না । আমার মা ওই পাড়ার বুলি রপ্ত করে ফেলেছিলেন, যা, উনি পরে জানতে পারেন, সংস্কৃতিবান হিন্দিভাষীদের কাছে অশোভন, এমনকী অশ্লীল । ইমলিতলার বস্তিবাসীদের জমায়েতে ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়া হতো, শুয়োরের মাংস খাওয়া হতো ; শৈশবে আমি পুরো ইঁদুর-পোড়া  খাইনি, বমি করে ফেলব আঁচ করে, তবু একটুকরো মুখে দিয়ে চেখেছিলুম, বিটকেল সোঁদা গন্ধ ; তবে শুয়োরের মাংস যখনই পাড়ায় রাঁধা হতো, খেয়েছি । দাদা সমীর রায়চৌধুরী ইঁদুর-পোড়া খেয়েছিল, তাড়ি দিয়ে । আমার তাড়ি আর ঠররা খাবার ট্রেনিঙ তো ইমলিতলায় । 

কানা গলির শেষের বস্তিতে শুয়োর মেরে খাওয়া হতো, তাড়ি সহযোগে । সন্ধ্যাবেলায় গনগনে লোহা ঢুকিয়ে গর্তে ফেলা শুয়োর মারার আর্তনাদ পেলে দাদা পরের দিন বলতেন, চল শুয়োরের মাংস খাব তাড়ি দিয়ে, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, ফিরে এসে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিস । সেই সব গরিব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চুরি-ডাকাতি-পকেটমারি করে সংসার চালাতো, তাদের কাউকে গ্রেপতার করার জন্যে পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে দাদা বলতেন চল চল ছাদে চল ; ছাদে গিয়ে দেখতুম সন্দেহজনকরা গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে পেছনের আমবাগানে । পাড়ায় দাদার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে একজনের বাবা পকেটমার ছিল, সেই বন্ধুও বাপের কাছে পকেট মারা শিখছিল, দাদা তাকে বদ্রি পাটিকমার বলে ডাকতেন । দাদা বাড়িতে এসে বলেছিলেন, বদ্রির কুঁড়েঘরে ইশকুলের মতন ব্যাপার, এ-পাড়ার আর অন্য পাড়ার অনেক ছোঁড়া শিখছে, দুআঙুলে পার্স তোলা, আধখানা ব্লেডে কাটা, এইসব ।

অরিন্দম: 8.”কমিউনিজমে দীক্ষা”-এখানে কি ডি ক্লাসিফিকেশন এর কথা বলা হয়েছে “তরুণকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল কমিউনিস্ট হয়ে যা সব ফ্রি পাবি” এটা কি উচ্চবর্ণের মানুষদের আভিজাত্যের ঘেরাটোপে চিরকালীন ভাবে থেকে যাওয়ার প্রচেষ্টা? কারণ তার কয়েকটি লাইন আগেই আমরা দেখেছি তরুণের দাদুর দাদুরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমর্থক ছিল| তাদেরই ঐতিহ্যকে তরুণের মতো বর্তমান প্রজন্মের মার্কসবাদী নেতারা বহন করে চলেছে?

 মলয় :পশ্চিমবাংলার বাঙালির মন থেকে মার্ক্সকে মুছে ফেলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সেই লোকগুলো যারা নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে চালাবার চেষ্টা করেছে, যেমন বামপন্হী দলগুলো, যেমন নকশালপন্হী নেতারা, যেমন জঙ্গলে বিপ্লব করার জন্য লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা । জানি না চারু মজুমদার কেমন করে অনুমান করেছিলেন যে পশ্চিমবাংলায় বিপ্লব হলে তা বহুত্ববাদী গোঁড়া-ধর্ম, কট্টর মৌলবাদ, জাতিপ্রথা ও বিচিত্র-বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থাকা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়বে ; মাওয়ের  চিনের স্প্রিং থাণ্ডার শুনে অনেকের মতো উনিও রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, যদিও তার আগেই চিন ভারতের আকসাই চিন আর তিব্বত দখল করে নিয়েছিল । মাঝখান থেকে উনি পশ্চিমবাংলার কিশোর-তরুণদের ক্রিমি লেয়ারকে লোপাট করতে এমন সাহায্য করলেন যে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা পুরো প্রজন্ম নষ্ট হয়ে গেল । আর পশ্চিমবাংলার পিছিয়ে পড়ার সেটাই প্রধান কারণ । মার্ক্সের চালু করা বামপন্হীদের প্রিয় অভিধা অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার মাঝে একটা বিরাট মধ্যবিত্ত বাফার শ্রেণি সব দেশেই গড়ে উঠেছে, যাদের আবির্ভাবের কথা মার্ক্স অনুমান করতে পারেননি, আর তারা বেশিরভাগই, যাকে বলে সার্ভিস ইনডাসট্রি, তা থেকে মোটা টাকা রোজগার করে, নিজেদের শ্রমিক বলে মনে করে না। এদের, যাদের বলা হয় মিলেনিয়াম জেনারেশন, তারা মার্ক্স পড়েনি, পড়ার আগ্রহও নেই ।

 মার্ক্সবাদ শুনলেই কমিউনিস্ট দেশ, কমিউনিস্ট সরকার, কমিউনিস্ট পার্টির কথা এসে যায় । কিন্তু স্তালিন, মাও, পলপট, পূর্ব ইউরপের চোসেস্কুদের মতন একনায়কদের কথা তো বলেননি মার্ক্স, যারা জনগণকে পেঁদিয়ে, সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে, মাটির তলায় পুঁতে, এলাকা-ছাড়া করে, জলচল বন্ধ করে, সমাজ আর রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেবে ; মার্ক্স যা বলে গেছেন তার বদলে নিজেদের মতামতকে কমিউনিজমের নামে চালাবে ! ওই একনায়কদের নকল করতে গিয়ে, তাঁবেদার স্কুল-শিক্ষক নিয়োগ করে আর পাড়ার ক্লাবের মোহোল্লা কমিটির মাধ্যমে স্তালিনি নেটওয়র্ক বসিয়ে, প্রতিটি পরিবারে ব্যক্তিগত সমস্যায় নাক গলিয়ে পশ্চিমবাংলায় জনগণকে পেঁদানোর খেলায় মেতে ছিল বাঙালি কমিউনিস্টরা,  আর সমাজকে সাজিয়ে তোলার সবচেয়ে ভালো সুযোগটা হারালো, যেমন আফগানিস্তানে ঢুকে কমিউনিস্ট সরকারকে সিংহাসনে বসাবার জন্যে সোভিয়েত দেশ আত্মহত্যার রাস্তায় এগিয়ে গিয়েছিল । সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করেছে, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিলুপ্ত করলেই মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব পরিবর্তন হয় না। বেশির ভাগ মানুষই স্বভাবজাত কারণে সর্বজনীন কল্যাণের দিকে নিজেকে সঁপে দেওয়ার বদলে নিজের হাতে ক্ষমতা ও অগ্রাধিকার চায়, অন্যদের চেয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে চায়। মজার বিষয় হলো এখনো যে দেশগুলো নিজেদের মার্ক্সবাদের অনুসারী বলে দাবি করে, সে দেশগুলোর ইতিহাস বলছে, সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদের প্রবাহ যৌথ মালিকানাভিত্তিক সম্পদ প্রবাহের চেয়ে অনেক জোরালো ছিল।

অরিন্দম: . কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টর প্রেমের কবিতা- এই কবিতায় রক্ত খেতে শেখানো হয়েছিল এটি কি বৌদ্ধিক  আধিপত্যবাদকে বোঝানো হয়েছে একই সঙ্গে মানুষের কালো রক্ত,গরুর সবুজ রক্ত,বাঘের নীল রক্ত -এটা কি সমাজের স্তরবিন্যাস এবং চিরকালীন বিভাজনকেই বোঝাচ্ছেন? ইতালীয় তাত্ত্বিক আন্তনীয় গ্রামচি  পুঁজিবাদ দীর্ঘদিন টিকে থাকার কারণ  হিসাবে  রাষ্ট্রের চারপাশে বর্তমানে একটি বৌদ্ধিক  সমর্থন  কে চিহ্নিত করেছেন| ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বহারা শ্রেণীর বৌদ্ধিক বিপ্লব কেন সফল হলো না?আপনি কি মনে করেন ভারতীয় প্রেক্ষিতে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য রয়েছে নাকি দুটি আসলে  সমার্থক?

 মলয় :আমি হাংরি আন্দোলনের তত্বটা নিয়েছিলুম দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলার থেকে।স্পেঙ্গলারের বক্তব্য হলো : কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটা সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না| যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটা নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটা সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । তোমাকে ভারতীয় প্রেক্ষিতে ভাবতে হবে। স্পেংলার পড়ে বুঝতে পেরেছিলুম যে কেন উনিশ শতকের মতন মণীষী আর বাংলায় সম্ভব নয়।তুমি কাদের সর্বহারা শ্রেনি বলছ জানি না । মুসলমানদের একটা বর্গ আছে যাদের বলা হয় ‘পসমন্দা’ – তারা একেবারে নীচুতলার। তারা কি সর্বহারা ? তেমনই ছত্তিশগড়ের আদিবাসিরা। 

অরিন্দম:  লুই আলথুসার আইডিওলজিক্যাল স্টেট এপারেটাস ও  রিপ্রেসিভ স্টেট এপারেটাস  এর কথা বলেছেন| আপনার “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে”কবিতায় প্রত্যেকটি লাইনে হিংসায় জর্জরিত ক্ষেত্র গুলোকে তুলে ধরা হয়েছে এবং খুব সঠিকভাবেই সন্ত্রাসের চূড়ান্ত সাফল্য এবং সমাজের প্রতিটি অংশ তে সহমর্মিতার অভাব পরিদর্শিত হয়েছে। এই সমাজ থেকে নিস্তারের রাস্তা হিসাবে উত্তরআধুনিক কবিতা কিভাবে কাজ করতে পারে?

 মলয় : অধুনান্তিক কবিতা কীই বা করতে পারে এই দেশে ? এতো ধর্মের, জাত-পাতের, ভাষার, রাজনীতির বিভাজন যেখানে ? একটা ধর্মের ভেতরেও কতো ছোট-ছোট ধর্মের সেক্ট!

অরিন্দম:  “ডায়াসপোরা” – কবিতায় Son of the Soil  নীতির তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে| সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা ও স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার এই দুটি  ধারনা কি বিচ্ছিন্নতার দিকেই আমাদের নিয়ে যায় না?রাষ্ট্র কিভাবে বিভিন্নতা কে রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে  সমতাকে বজায় রাখবে -এ বিষয়ে আপনার কি মতামত?

মলয়:বাংলার বাইরে যারা তারা বাঙালি ডায়াসপোরাবহির্বঙ্গের বর্তমান শেষ প্রজন্মটির পাঠকৃতি সেই অর্থে একটি পৃথক সাহিত্যিক ক্যানন তৈরি করেছে, যে-অর্থে স্পেন থেকে পৃথক লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর সাহিত্য, লখনৌ-ইলাহাবাদ থেকে পৃথক পাকিস্তানের উর্দু সাহিত্য, ফরাসি দেশ থেকে পৃথক আফ্রিকার সাহিত্য, ব্রিটেন থেকে পৃথক ব্রিটেন-বহির্ভূত ইংরেজিভাষী সাহিত্য, চিন থেকে পৃথক তাইওয়ান হংকংয়ের সাহিত্য।  পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্যিক মননবিশ্বে মিল নেই।  ঢাকায় যে-ভাবে নজরুল পাঠ ও বিশ্লেষণ হয়, কলকাতায় হয় তার বিপরীত।  লোকনাথ ভট্টাচার্য ফ্রান্সে ছিলেন বলে তাঁর কবিতার ক্যাননিক্যাল্ পরিবর্তন কলকাতার হজম হয়নি।  জার্মানি থেকে ঘনঘন কলকাতায় এসে কলকাতা-কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে চান করে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখতেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, পাছে পশ্চিমবঙ্গের চালু অনুশাসন থেকে মুক্ত হয়ে যান! বহির্বঙ্গের ডায়াসপোরিক লেখকরা যা করছেন তা ‘ঈর্ষণীয়’ । একজন লেখকের পাঠকৃতি কেবলমাত্র তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি, ভাষা বা ভাষাসমূহের ওপর দখল নয়, এবং কেবল তাঁর অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ নয়, —– ভাষা বা ভাষাগুলো এবং সাহিত্য নামক ক্রিয়াকলাপটিরও হাত আছে লেখক-প্রতিস্ব গড়ার।  উৎস ও স্থানিক কাঠামোভেদে সুবিমল বসাকের গদ্যের সঙ্গে অজিত রায় আর রবীন্দ্র গুহর   লেখক-প্রতিস্বের তফাৎ আছে।

অজিত রায় লিখেছিল, “ডায়াসপোরা তো নিছক স্থানিক নয়, তা মানসিকও বটে —– তার প্রাচীন উদাহরণ যদি হন ঈশ্বর গুপ্ত, তাহলে নতুন দৃষ্টান্ত কমলকুমার, অমিয়ভূষন মজুমদার, উদয়ন ঘোষ, রবীন্দ্র গুহ, অরুণেশ ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাক, কমল চক্রবর্তী, নবারুণ ভট্টাচার্য, দেবজ্যোতি রায়, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং, অত্যন্ত দ্বিধাভরে লিখছি, অজিত রায়।  এঁদের ভাষা ও ভাষা সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা সম্পূর্ণত ডায়াসপোরিক।  অতীতে আমরা আরও দেখেছি, যে বিদ্যাসাগর কথায় কথায় স্ল্যাং বলতেন, স্ল্যাং-এর তরফে তাঁর ঐতিহাসিক পক্ষপাতিত্বের কথাও আমাদের অজানা নয়; —- সেই বিদ্যাসাগরই বাংলা ভাষার বৈজ্ঞানিক বিধিবদ্ধতার ও শিক্ষার প্রকরণ গড়েছিলেন।  তারও আগে বঙ্গলিপি প্রবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্বজ্জন বাঙালি নকশা, প্রহসন, ব্যঙ্গ, স্যাটায়ার, নাটক ইত্যাদি ভাষাশিল্পে জনমনোরঞ্জন ও সামাজিক সমালোচনা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।  শুধুমাত্র কলকাতায় চলে, সেসব নয়, বাংলা ও বাংলার প্রতিবেশী ভাষা থেকেও শব্দ আহরণ করে যারা ‘নতুন’ বাংলা ভাষার জন্ম দিয়েছেন বা এখনো দিয়ে চলেছেন, তাঁদেরকে বাদ দেবে কোন আহাম্মক?  সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক স্বাধীন ভাবে ভাষাবুনন করেন বৃহত্তর বাংলা সমাজের যে কোন এক বা বহু প্রান্তের সজীব ভাষার প্রত্যক্ষ আহরণ বা পরোক্ষ মিশ্রণ ক’রে।  এখন সাহিত্যিক তাঁর ভাষার মাধ্যমে ভিন্নতর মৌলিকতার সন্ধান ও প্ৰতিষ্ঠা করতে উন্মুখ।  পরিপ্রেক্ষায় অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ ‘নিজ’ ‘অপর’ সব মিলেমিশে যাচ্ছে।  ভাষা আন্দোলনে এটি একটি বৈপ্লবিক আয়োজন।  একে নাকচ করতে চাইলেও তা করা যাবে না।

——————————–     

Signature 

Interviewee.                                                                                                       

Moloy Roychoudhury(Prominent Poet,Essayist,Novelist,Founder Member of Hungry Generation of Bengali Poems)

https://lh3.googleusercontent.com/IrMpm9e_NzbE85gOv53BGH0q3sxhlAJIafY-eebIZ-bgi0mg1XSqZX7sS4wV5rtUORfQ6E5iVf9e3VsDucmoJL05rcDA2UPn6KT2IDRMYsKq1Gc5ej4T6oZvffJYXWh6gcdvMzkqQJbRs7uTEyvPr78

                                         Date-

                                                                                                      Interviewer                                                

                                                            Arindam  Debnath,

                                                                                                      Assistant   Professor of  Political Science,

                                                                                       Chakadaha College Chakdaha,Nadia.

                                                          Mob-9038221590

                                                                                           Email-id-arindamdebnath88@gmail.com

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমর বন্দ্যোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমর বন্দ্যোপাধ্যায়

অমর :আমরা জেনেছি পাটনায় আপনাদের বাড়ি, মানে আপনি ও আপনার ভাই সমীর রায়চৌধুরী শুরু করেছিলেন হাংরি আন্দোলন। যদি কিছু বলেন ।

মলয় : নিজের ঢাক নিজে না পিটে একটা উদ্ধৃতি দিই ।বীজেশ সাহা সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ১ জুন ২০২২ সংখ্যায় ‘পাঁচ ছয় দশকের কিছু পত্রিকা-কথা’ প্রবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার  সন্দীপ দত্ত, যাঁর লাইব্রেরিতে ভারতের ও বিদেশের নানা ভাষার লেখক-গবেষকরা পুরোনো বই-পত্রিকার খোঁজে যান, তিনি লিখেছেন :“বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে হাংরি প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের মাধ্যমে যার সূচনা । স্রষ্টা, নেতৃত্ব ও সম্পাদক যথাক্রমে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায় । পত্রিকার চিন্তনভূমি পাটনা হলেও তার প্রকাশ স্হান ছিল ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া ; হারাধন ধাড়া বা দেবী রায়ের ঠিকানা । যদিও ছাপা হয়েছিল পাটনা থেকে । মলয় রায়চৌধুরী তখন ২২ বছরের তরুণ, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ।কবি জিওফ্রে চসারের ( ১৯৩৯ – ১৪০০ ) In The Sowre Hungry Tyme পড়ে মলয় Hungry শব্দের অভিঘাতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । হাংরির পরিকল্পনা তখন থেকেই । সময়ের প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ । সদ্য স্বাধীন দেশ । দেশভাগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় । দারিদ্র, ক্ষুধা, নিরন্ন মানুষ । বাংলা কবিতার হালও খুব খারাপ । ৩০ – ৪০-এর গতানুগতিক কবিতা নির্জীব হচ্ছে । ৫০-এর কবিরা সবে নিজেদের প্রকাশ করছে । নিজস্বভূমি আবিষ্কার হয়নি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় এলেন পাটনায় । মলয় শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন । প্রথম বুলেটিনে কবিতা বিষয়ক একটি ইশতাহার ইংরেজিতে ছাপা হলো । ১৯৬২ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলায় প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশ পায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ পায় । এইসব বুলেটিনে প্রকাশের কোনো তারিখ থাকতো না । নানা রঙের কাগজে, এমনকি মলাটের বাদামি কাগজেও  বেরোতো এক সপ্তাহে ২৪টি আবার কখনও বছরে একটি হয়তো ।

“হাংরি সূচনাকালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র চারজন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী । এরপর একে একে যুক্ত হন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, অরুণেশ ঘোষ, সুবো আচার্য প্রমুখ । ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার ও প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখালিখিতে নতুন আবিষ্কারই প্রকৃত সাহসী ও মৌলিক পথ মানতো হাংরিরা । কৃত্তিবাস বা শতভিষা গোষ্ঠী হাংরি আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেনি । প্রবীণ সাহিত্যকাররাও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন হাংরিদের সম্পর্কে । সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে হাংরি গোষ্ঠী । অথচ সর্বভারতীয় ভাষায় বরেণ্য হয়েছিল এই আন্দোলন । হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি তরুণ লেখকরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল । অন্য ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় প্রভাব পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের । মারাঠি ভাষার লেখক অশোক সাহানে, দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলটকর প্রমুখ, তেলেগু ভাষায় নিখিলেশ্বর, নগ্নমুনি, জ্বলামুখী প্রমুখ । হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ হাংরি লেখকদের মূল্যায়ন করেন । বহির্বিশ্বেও হাংরি আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ।১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হাংরি জেনারেশনের একটি বুলেটিনকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগে মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয় । ৪৮ শঙ্কর হালদার লেন, আহিরিটোলা, কলকাতা- ৫ থেকে ওই সংখ্যায় দশজন লেখক ও প্রকাশক সমীর রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায় । লেখক তালিকায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ও সুবো আচার্য । এই বুলেটিনেই প্রকাশ পায় মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি । এই কবিতাকে কেন্দ্র করে অশ্লীল রচনার দায়ে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার প্রেস সেকশনের সাব ইন্সপেক্টর কালীকিঙ্কর দাস অভিযোগ আনলেন । শুরু হলো ধড়পাকড় । ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা হলো ৬ জনকে । মামলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে । দীর্ঘ দিন মামলা চলল । ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয় । এই ১৯৬৫ সালেই হাংরি আন্দোলনের ইতি ঘটে । এই বছরেই ২৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর সাজা হয় । পরে, ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে পিটিশন দ্বারা মামলা করার ভিত্তিতে, তাঁকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দেয়া হয় । আন্দোলনের কথা পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের TIME পত্রিকায় । এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা বিদেশে প্রচারিত হলো । প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি জেনারেশনের এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে একটি দীঘস্হায়ী ছাপ রেখে গেল ।”

অমর : বিংশ শতকের ছয়ের দশকে প্রচলিত ব্যবস্থা যা সাহিত্য ও সাহিত্য – স্রষ্টাদের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করতো, হাংরি আন্দোলন তার বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়,প্রতিরোধ ও বিপ্লব। সেই জেনারেশনের অন্যতম এক যোদ্ধা আপনি। এই বিষয়টি নতুন প্রজন্মের যারা লেখালেখি করছে তারা অনেকেই সেই হাংরি জেনারেশনের কথা জানেন না। যদি ওদের উদ্দেশ্যে কিছু বলেন?

মলয় : এই প্রসঙ্গেও উদ্ধৃতি দিই শিবনারায়ণ রায়ের । জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার কার্তিক-পৌষ সংখ্যায় শিবনারায়ণ রায় লিখেছিলেন, “ কোনও সমাজ যখন নানা কারণ সমাবেশে স্হবির ও উদ্ভাবনাহীন হয়ে পড়ে তখন সেখানে প্রাণ ও গতির সঞ্চার বিভিন্ন উপায়ে ঘটতে পারে । এটি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে বহিরাগত শক্তির আঘাতে ; কখনও কখনও অভ্যন্তরীন বিরোধ এবং তজ্জাত অত্যয়ের ফলে । কখনও বা কিছু সংখ্যক সচেতন আদর্শবাদী উদ্যোগী স্ত্রী-পুরুষের একনিষ্ঠ প্রয়াসে সেই সমাজের সংবিষ্ট ও ভোগবৃত্ত দশা থেকে উদ্ধার ঘটে । হয়তো সামাজিক উজ্জীবনের জন্য উদ্যোগী কয়েকজনের উদ্যম ও অধ্যবসায়ই যথেষ্ট নয় । তবু তাঁদের কাছে সমাজের ঋণ গভীর ; তাঁদের জীবন পরবর্তী  প্রজন্মের প্রেরণার উৎস । দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে আর এই ধরণের পত্রিকা অথবা সাহিত্য আন্দোলন বড় একটা চোখে পড়ে না । সাহিত্যজগতে ব্যাবসয়ী প্রতিষ্ঠানের ( দেশ ও আনন্দবাজার  গোষ্ঠী ) বিবর্ধমান একচেটিয়া কারবার, কমিউনিস্টদের প্রচারসর্বস্ব উচ্চরোল, ক্ষীণসামর্থ্য লেখকদের নিজের নিজের স্বল্পস্হায়ী কাগজ বার করবার অতিপ্রজ প্রচেষ্টা — সব মিলিয়ে সাহিত্যিক আন্দোলনের ঐতিহ্য দ্রুত ক্ষীণ হয়ে আসে । যে অর্থে ‘সবুজপত্র’ বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি পর্বকে এনে তাকে প্রকট করে তুলেছিল, যে অর্থে ত্রিশের দশক বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যের বিপ্লবকাল, সেই অর্থে গত তিরিশ চল্লিশ বছরে পশ্চিমবাংলায় বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় কিছু ঘটেনি। সুরচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, এমনকি উপন্যাসও স্বল্পসংখ্যায় লেখা হয়েছে বটে । কিন্তু কোনও প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন আন্দোলন বা নতুন দিগদর্শীর সন্ধান মেলে না । ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে কিছু সমর্থ তরুণ যুক্ত ছিলেন ; তাঁদের ভিতরে কয়েকজন পরবর্তীকালে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ; কিন্তু ‘কৃত্তিবাসের’ চরিত্রে আন্দোলন গড়ে তোলবার অথবা নতুন দিক খুলে দেবার আভিমুখ্য ও শক্তি আদৌ ছিল না ‘সবুজপত্র’, ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’, বা ‘পূর্বাশা’ জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে .কৃত্তিবাসের’ নাম যুক্ত করা নিতান্তই অসঙ্গত । ওই পত্রিকার প্রধান লেখকদের মধ্যে কয়েকজন পরে আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল ইত্যাদি ব্যাবসায়িক পত্রিকার আশ্রয় নিয়ে বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন । ষাটের এবং সত্তরের দশকে আমি বেশিটা সময় ভারতবর্ষের বাইরে ছিলাম । বন্ধুদের কাছ থেকে এবং পত্রপত্রিকার সূত্রে জানতে পারি যে, অন্তত পশ্চিমবাংলাতেও শিক্ষিত তরুণ-তরুণী মহলে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বার্লিন, বার্কলি এবং জাকর্তায় যে যুবাবিস্ফোরণ আমি দেখেছি, কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীদের অস্হির আলোড়নের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা আমার জানা নেই । রাজনীতির ক্ষেত্রে এই বিক্ষোভ রূপ নেয় নকশাল আন্দোলনে — বিপ্লবী বুলির আড়ালে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতাদের সুবিধাবাদী ক্রিয়াকলাপ তাদের কিছুসংখ্যক তরুণ—আদর্শবাদী অনুগামীদের মনে যে বিরূপতা জাগিয়ে তুলেছিল নকশাল আন্দোলনে আকার খোঁজে । তাদের মধ্যে একটি ছিল হাংরি আন্দোলন । এটি সম্পর্কে কিছু সংবাদ বিদেশি পত্র-পত্রিকায় পড়ি ; কিছু খবর পাই আমার মারাঠি ও গুজরাটি বন্ধুদের কাছে ।হাংরিরা তাঁদের ক্ষোভ আক্রোশ ব্যর্থতা ও আত্মাভিমানকে উচ্চণ্ডভাবে প্রকাশ করে রফাশ্রয়ী, ভণ্ড, জীর্ণ, বাঙালি বাবুসমাজকে উচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন ।”

অমর : আপনি , শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সুবিমল বসাক প্রমুখ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। ফর্ম, বক্তব্য এবং প্রকাশ ভঙ্গি – সবটাই 

এস্টাব্লিশমেন্টকে সজোরে আঘাত করার লক্ষ্যে নিক্ষেপিত ছিল। ফলত, সাহিত্যের ব্যাপারী কিছু কাগজের চক্ষুশূল হন আপনারা, কেউ কেউকে চাকরি বা কর্মজীবনে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়।এই বিষয়টি যদি উত্তরপ্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে কিছু বলেন।

মলয়: হ্যাঁ । আমার বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাস মামলা চলে ; তখন কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না; চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হবার দরুন সাসপেনশান অ্যালাউন্স আদালতেই খরচ হয়ে যেতো; সকালে পাইস হোটেলে কম পয়সায় খেয়ে চালিয়ে দিতুম। সমীর রায়চৌধুরী চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হন । উৎপলকুমার বসুকে অধ্যাপনা থেকে বরখাস্ত করে যোগমায়া দেবী কলেজ । প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট হয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায় ভয়ে আন্দোলন ছেড়ে দেন আর আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন ; সুবিমল বসাককে মারধর করার জন্য দলবল নিয়ে কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরেছিলেন । সন্দীপন, শৈলেশ্বর, সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় । আমি হাইকোর্টে মামলা জিতে যাই । সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে ট্রান্সফার করে দেয়া হয় । যদি হাংরি কর্মকাণ্ডকে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ধরা হয়, যাকে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত বলেছেন বাংলা সাহিত্য একদিন  “যৌবন-দীপ্তিতে  আলোকিত হয়েছিল তার লয়-ক্ষয-ব্যয় নেই–সত্যের মতো  তা সক্রিয় ছিল”, তা্হলে সম্পূর্ণ ও ব্যাপক ‘হাংরি যুগ’-এর কথা বলা হবে না । ১৯৬৭-এর পরেও হাংরি আন্দোলন সক্রিয় ছিল বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর  পত্রিকার মাধ্যমে, যেমন প্রতিদ্বন্দী, চিহ্ণ, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, ফুঃ, ঋত্বিক, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র, ক্ষুধার্ত সময়, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবোট, কুরুক্ষেত্র, পাগলা ঘোড়া, দ্রোহ, বিকল্প, দন্দশূক, সময়সূত্র, যুদ্ধযাত্রা, মন্বন্তর, এখন এই রকম, অনার্য, পাখি সব করে রব ইত্যাদি,  এবং  আশির দশকের শেষ পর্যন্ত কলকাতাসহ উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার তরুণ কবি-লেখকরা সেই যুগকে করে তোলেন মহামিলন-ক্ষেত্র । তোমাকে পুরো পার্সপেক্টিভটা বুঝতে হবে ।

অমর: অনেকেই সেই সময় আপনাদের বোহেমিয়ানস বলতো।বাস্তব জীবনের সংস্কৃতি, দারিদ্র্য,সামাজিক বিভাজন, অসাম্যকে ছাপা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচলিত সাহিত্য যা দেশ বা ওই জাতীয় কিছু সাহিত্য পত্রিকার হাত ধরে এস্টাব্লিসমেন্ট কে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল, তার বিরুদ্ধে আপনারা এই বোহেমিয়ান রীতি এনেছিলেন। এটা মানবেন কী?

মলয় : আমার শৈশব কেটেছে পাটনা শহরের ইমলিতলা নামে এক বস্তিতে । অন্ত্যজ বিহারিদের পাড়া । আমি তাদের মতনই, শৈশবে তাড়ি শুয়োরের মাংস এমনকি ইঁদুরপোড়াও খেয়েছি । তাকে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা বোহেমিয়ান বলে মনে করলে আমার কিছু করার নেই।সুবিমল বসাকের বাবা অ্যাসিড খেয়ে আত্নহত্যা করার পর পুরো সংসার টানতে হয়েছিল ওকে, কম বয়স থেকে । সুবিমলও পাটনায় একটা গলিতে থাকতো । দেবী রায় হাওড়ার বস্তিতে থাকতো ; কম বয়সে চায়ের দোকানে কাজ করতো। শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব, সুবো ছিল উদ্বাস্তু পরিবারের । অবনী ধর ছিল জাহাজের খালাসি । ফালগুনী রায় ছিল খণ্ডহর হয়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির ছেলে যারা বাড়ির সব আসবাব এমনকি মেঝের মার্বেলও উপড়ে বিক্রি করে চালাতো । মানে, কেউই মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সদস্য ছিল না। আমাদের জীবনযাত্রা অমনই ছিল । হাংরি আন্দোলনে অনেকে ছিলেন, তুমি হয়তো এঁদের নাম শোনোনি। ‘কল্লোল’-এর তুলনায় হাংরি যুগে বহু তরুণ দেখা দিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,  সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই,  করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অলোক গোস্বামী, মলয় মজুমদার, রাজা সরকার, কিশোর সাহা, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কুশল বাগচী, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিকাশ সরকার, নির্মল হালদার, সূর্য মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি রায়, অরুণেশ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ রাউত, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, সুনীতা ঘোষ,  রবীন দত্ত, সেলিম মুস্তফা, রবিউল, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সাত্বিক নন্দী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, স্বপন চক্রবর্তী, সুবীর মুখোপাধ্যায়, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, নির্মল হালদার, সৈকত রক্ষিত, রবীন্দ্র মল্লিক, বিজন রায়, স্বপন মুখোপাধ্যায়  প্রমুখ । এই কবি ও লেখকদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি । তাঁদের মধ্যে অনেকে   পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। 

অমর : না কী এটি নিও লিবারেলিসম যা জন্ম হয় অস্তিত্বের সংকট অথবা অনিশ্চয়তা থেকে? এর থেকে আপনাদের লেখাগুলো সৃষ্টি হয়েছে?

মলয় : সালটা ১৯৬১ । অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হয়ে চাকরি করছি পাটনায়।১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ‘ইতিহাসের দর্শন’ যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে।‘হাংরি’ শব্দটা পেয়েছি ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের In Swore Hungry Tyme বাক্য থেকে।এই হাংরি শব্দটা খাওয়ার ব্যাপার নয় । সময়ের ব্যাপার, খারাপ সময়ের । আর আন্দোলনের তাত্বিক বনেদ হলো দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West বইটার কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য ।  ইতিহাসের দর্শন নিয়ে  প্রবন্ধ  আর ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে একটা বই লেখার সময়ে পরিচিত হয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের সমাজভাবনায় আর মেলাবার চেষ্টা করেছিলুম দেশভাগ-পরবর্তী ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবাংলার সঙ্গে ।  সেই সময়ে, দেশভাগের পর, পশ্চিম বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু শরণার্থীর ভিড়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বরাজের স্বপ্নকে চুরমার করে আরম্ভ হয়েছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির  খেলা। স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে। অসওয়াল্ড  স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় ।  হাংরি হলো কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, আর হাংরি  সাহিত্যকৃতি হলো কাউন্টার ডিসকোর্স। ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; ;কল্লোল’, ‘কবিতা’ , ‘কৃত্তিবাস’ যে নবায়ন এনেছে সে কাজগুলো  কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো  যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, আর তাঁদের মনোবীজে অনুমিত রয়েছে যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটা একক, নিটোল ও সমন্বিত । ওই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে  সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, আর স্থানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । 

অমর : কলোনি সংস্কৃতি যার ধারক ও বাহক ছিল দেশ – আনন্দ বাজার গোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর এরাই সেই গাড়িটাকে ভারতীয় করে সাজায় বাংলার সংস্কৃতির আঙিনায়। এই স্থিতাবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য লড়াই ছিল আপনাদের। এক কথায় বলা যায় কলোনিয়ালিসমের সংস্কৃতির এজেন্টদের বিরুদ্ধে   ‘ পেন ও ব্রাশ ‘ – এর স্বাধীনতার জন্য লড়াই ছিল আপনাদের? একটু যদি বলেন ।

মলয় : আমাদের লড়াই ছিল ক্ষমতার সমস্ত পীঠস্হানের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে । সেই পীঠস্হানের একটা আনন্দবাজার কোম্পানি ।

অমর : হাংরি আন্দোলন চলাকালীন সময় ভারতীয় নন এমন কোন কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আপনার কাছে আসেন এবং আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত হতে চান? কেউ কী স্ব স্ব দেশে এবং স্ব স্ব আঙিনায় প্রভাবিত হন?

মলয়: আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন অকতাভিও পাজ, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আরনেস্তো কার্দেনাল। গিন্সবার্গ আমাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যেকারণে ফিরে গিয়ে আর ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ -এর মতো কবিতা লিখতে পারেনি ।

অমর : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ – আপনাদের মুভমেন্ট ছেড়ে চলে গেছিলেন? কেন ? আপনার কী মনে হয়?

মলয় : শক্তি চট্টোপাধ্যায় আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যান  আনন্দবাজারে চাকরি পাবার জন্য ।শৈলেশ্বর, সুভাষ ওরা বেশ কিছুকাল পরে ‘ক্ষুধার্ত’, ক্ষুধার্ত খবর, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ ইত্যাদি নামে পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেছিল । তার কারণ ওরা মুচলেকা লিখে জানিয়েছিল যে হাংরির সঙ্গে ওদের সম্পর্ক নেই।

অমর : মানুষগুলো হটাৎ ই বদলে যাচ্ছে,মনে হয় না? সিস্টেম এর সঙ্গে মৌতাত করে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে আর তাল মিলিয়ে কবি শিল্পী সাহিত্যিকগণ সাপ্লাই দিচ্ছে ভুসিমাল? এ সব  দেখার পর আপনার কেমন লাগে?

মলয় : দেখছো তো সরকারে ঢোকবার আর পুরস্কার পাবার জন্য কী কাণ্ডটাই না করছে একদল কবি আর লেখক । এরা যাবতীয় চুরি-জোচ্চুরির বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ রাখে । সবাই ভুসিমাল নয় । অনেকে লোভী । 

অমর : মেধা বিক্রীত প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের দিয়ে পুঁজিবাদের সাহিত্যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আপনারা মনস্ক পাঠক থেকে ও নিজেদের অহমিকায় বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।  সকলেই চটি  চাটা ছিল না? আপনাদের কারণে অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন? আপনি মানছেন কি?

মলয় : এখন কেউ চটিচাটা কেউ চাড্ডিচাটা । আত্মাভিমানের অভাব । 

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

A reader par excellence

From Krishnagar, West Bengal, she, Sonali Chakraborty,  crossed two rivers on boats, took a taxi and reached Dumdum airport for a flight to Mumbai and met Malay Roychoudhury just for a day. She collected more than twenty books written by Malay and went back the same day. 

…………………………………………………………………………………………

যেমত নেশাতুর হরিণীর তারারন্ধ্র স্থির ও উদাস থাকে বিশালতায়

প্রায় বছর আড়াই পর আবার উঠোন ভাঙতে গিয়ে প্রথম জানা গেলো কখন গালিব বলেছিলেন “কিতনি খউফ হোতে হ্যায় শাম কে অন্ধেরো মে, পুছ উন পরিন্দো সে জিনকে ঘর নেহি হোতে”। নিজের হাজার ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে প্যাকিং, বোর্ডিং পাস, কার্ড ব্যালেন্স চেক করে মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার আগে “জাস্ট ঘুমোতে যাওয়ার সময় gdn8 টা লিখে ঘুমোবে যদি ঘুমোতে মনে থাকে” বলে আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে সোজা নিজের দুর্গে ফিরে যাওয়ার প্রবল পুরুষটি আর দাঁড়িয়ে থাকবে না ব্যালকনিতে যখন আমি ফিরবো…

খুব সহজ ছিলো না তাই এই সফর অথচ যেতে আমায় হতোই। ভাঙা বাতিঘর থেকে নাড়ি কাটা সূর্যকে দেখার জন্য যে নশ্বরতা, তার দায় থাকে। রামধনু দিয়ে কাজল পরে যে ফ্লাইটে উঠেছিলাম বৃষ্টি আর বিদ্যুত তাকে ধুয়ে কিছু অতিরিক্ত ক্লান্তি আঁকতে পেরেছিলো মাত্র। যে কোনো ডানার উড়াল আকাশের ব্যক্তিগত ভালো লাগার তালিকায় আছে, ঝড়ে যে উড়োজাহাজ আটকে না থেকেছে, তার যাত্রী না হলে এই প্রসঙ্গে সম্যক জ্ঞান জন্মায় না।

কিংবদন্তী যে প্রেমিক তাঁর মাথা কেটে আমায় পাঠিয়েছিলেন, তাঁর পায়ে একবার হাত না রাখলে অপরাধ হয় অথচ তিনি যেহেতু বললেন “আর তো দেখা হবে না”, বরাবরের উন্মাদিনী আমার ভিতরে জিহাদ এলো তাঁকে ভুল প্রমাণের, সুতরাং প্রণাম করিনি, আবার দেখা হবে এই বিশ্বাসে।

প্রেমে পড়ার মতো ভয়ঙ্কর সুন্দরী দুই বিদুষী একত্রে ছিলেন, শীলা দি ও নূপুর দি, আমার ভিতরের তরঙ্গে “ইন্দুবালা গো, তুমি কার আকাশে থাকো, জোছনা কার মাখো” বাজছিলো, সামনে মলয় আর অর্ঘ্য দা ছিলেন বলে প্রকাশ করা গেলো না সেভাবে, কপাল। ও হ্যাঁ, আমি জাতিস্মর নই, নিয়তি নিজে লিখি তাই প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অর্ঘ্য দা ও নূপুর দির সঙ্গে পরবর্তী জন্মের মৌ সই করা আছে।

এতো বই পাওয়া হলো আদর টইটই চকোলেট (আমি বৃদ্ধা হইলেও কিছু কিউটস্য বন্ধু আমার আছে) সহ, দেবদূত বিরাট একটি ব্যাগ কিনে দিলেন ছত্রপতি থেকে আমার করুণ অবস্থা দেখে, সেও উপহারই। জানলাম এখন আর আমরা ভারতীয় এয়ারপোর্টে বসি না, ‘আদানী লাউঞ্জ’ এ রেস্ট করি, এও জানা হলো ভিস্তারা দীর্ঘ যাত্রায় খেতে দেয় না, ‘হিন্দু মিল’ সার্ভ করে। এই দেশ বিচিত্র ছিলোই কিন্তু দিনে দিনে আমার বড় অপরিচিত হয়ে উঠছে সেলুকাস, কোথা যাই বলো তো?

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার ও কবিতা

কবি কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরী

প্রথম অংশ

( এই সাক্ষাৎকার কেদার ভাদুড়ীর গাঙ্গুলিবাগান-এর একরুমের ঘরে ১৯৯৮ সালে নেয়া । প্রথমে ‘মহাদিগন্ত’ ও পরে ‘বোধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল  ।  একা থাকতেন, নিজেই রান্না করতেন, বাসন মাজতেন, ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন, রাতে মদ খেতেন আর কবিতা লিখতেন । নাকতলা স্কুলের খ্যাতনামা ইংরেজি-শিক্ষক ছিলেন । বলতেন, সিপিএম বিরোধী বলে ওনার পেনশন আটকে দেয়া হয়েছে। হাত কাঁপতো বলে শেষ দিকে কলম ধরে লিখতে পারতেন না । ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন, লিখে দেবার জন্য । এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েন, সে গর্ভবর্তী হয়ে গেলে তাঁকে বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন । ছাত্রী-স্স্ত্রীর বয়স তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের চেয়ে কম ছিল। প্রতিবেশীরা দ্বিতীয় স্ত্রীকে তাঁর নাতনি ভাবতো বলে গাঙ্গুলিবাগানের বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন ; ছাত্রী-স্ত্রী মফসসলের কোনো স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেয়েছিলেন । ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম আর তাঁকে বিয়ে করা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি । আমি আর কবি-সম্পাদক উত্তম দাশ প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা যেতুম কেদারের দশ-স্কোয়ারফুট ঘরে আর তিনজনে মিলে মদ খেয়ে নাচতুম । উত্তম দাশের বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হলে নিমন্ত্রণ পেতেন ; মাঝেমধ্যে আমিও পেতুম । এক-কালের উদ্বাস্তুদের মাথা গোঁজার ঠাঁই গাঙ্গুলিবাগান ভেঙে আবাসন উঠেছে । কেদারের জন্ম ১৯২৫ সালের একুশে জুন আর মৃত্যু ২০০২ সালের দোসরা মার্চ । ওনার কাব্যগ্রন্হগুলো পুনঃপ্রকাশিত হওয়া দরকার । )

মলয় : কেদার, আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিওতে চাইছি, এ ব্যাপারটা সম্ভবত বিসদৃশ ঠেকছে আপনার। আপনার আর আমার পাঠকদেরও সেরকম ঠেকবে হয়তো । আমি কিন্তু সাক্ষাৎকারটা নিচ্ছি আমার নিজের কারণেও বটে । এর আগে আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলুম দীপঙ্কর দত্তর । আমি নিশ্চিত যে দীপঙ্করের নাম শোনেনমি । দীপঙ্করও আপনার লেখা পড়েছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার । পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যজগতের শাসক সম্প্রদায় যে একশৈলিক আধিপত্যবাদী অনুশাসন চাপিয়ে দিতে চাইছেন, কেবলমাত্র মিডিয়া-অ্যাকাডেমি-সরকারের মাধ্যমেই নয়, লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেও, তা কোনো-কোনো কবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন । আর তা করছেন যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে । কেননা সমালোচকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে শেখা বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাঠামোর বাইরে বেরোতে পারেন না বলে কবিরা থেকে যান প্রান্তিক । তাছাড়া সাহিত্যজগতের শাসকদের নিজস্ব বহুবিধ স্বার্থ তো আছেই, বিশেষ করে আর্থিক ও রাজনৈতিক । আমি এসট্যাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান শব্দটা প্রয়োগ করছি না, কেননা পশ্চিমবঙ্গে ভালগার মার্কসিস্টরা, যাঁরা এতাবৎ প্রচার করে এসেছেন যে ‘গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো’, তাঁরা আনন্দবাজার প্রাইভেট লিমিটেডকেই প্রতিষ্ঠান বলে চালিয়েছেন ।। আমি ব্যাপারটা অতো সহজ বলে মনে করি না । আর আপনি তো আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী নন । প্রতিষ্ঠান আপনাকে ‘ভেন্ন’ করেছে । সে যা হোক । আমার কথাটা বলি । আমি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছি । গোটা পনেরো সাক্ষাৎকার দিয়েছি । কিন্তু সাক্ষাৎকার নেবার চেয়ারটায় বসার অভিজ্ঞতা নেই । এ-ব্যাপারটাও ঝালিয়ে নিতে চাই ।  আপনি বয়সে আমার চেয়ে দেড় দশক বড়ো। দীপঙ্কর আমার চেয়ে অনেক ছোটো । আপনার  কিছু বলার আছে ? না পরের প্রশ্নে এগোই? 

কেদার : মলয়, এ পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার কেউ-কেউ নিতে চেয়েছে কিন্তু নেয়নি । তুমিই প্রথম আমার সাক্ষাৎকার নিতে চলেছ । এতো আনন্দেই ব্যাপার । সুতরাং বিসদৃশ ঠেকবে কেন ? আমার ? তবে অনেকেরই গা জ্বালা করবে । পেটে খিঁচ ধরবে । কফ নামক এক মুদ্রাদোষে আক্রান্ত হতেও পারে বা । কেননা তুমি শুধু হাংরি নও, অ্যাংরিও বটে । আমার তো তাই মনে হয় । অনুমান, অনুমানই । সত্যিও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে । দীপঙ্কর দত্তের নাম আমি শুনিনি, তাই নাকি ? বহু মাস, বহু বছর ধরে ও তার কাগজ ‘জোরো আওয়ার’ আমাকে পাঠাতো, পাঠিয়েছে । এখন অবশ্য পাঠায় না । তারও কারণ আছে । এখানে বলব ? না, এখন বলব না । এসট্যাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান শব্দ দুটোয় আমো কোনো দিনই পরোয়া করিনি, করিও না । ওরা মানুষ না জন্তু ? সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে । প্রতিষ্ঠান আমাকে ‘ভেন্ন’ করেছে ! ছিলাম কখন ? ‘দেশে’ এ পর্যন্ত আমার চারটে, মাত্র কবিতা ছাপা হয়েছে । তাতে ‘দেশ’ উদ্ধার হয়ে গেছে বলেই আমার ধারণা । কারণ ওই ‘দেশ’ পত্রিকার এক সংখ্যায় কবি কাম প্রাবন্ধিক জগন্নাথ চক্রবর্তী আমার ও অন্যান্যদের কবিতা নিয়ে অনবদ্য এক আলোচনা করেছিলেন, তা পড়েছি । কথা হলো আমি ওই কবিতা এবং ছাপা হলো না এমন অনেক কবিতাই ডাকে পাঠিয়েছিলাম । বাই পোস্ট । পয়সা খরচ করে । তবে ওই যে বলছ ‘ভেন্ন’ করেছে । ‘ভেন্ন’ কথাটা শুনে আমার খুব মনে-মনে হাসি পেলো । বেড়ে বলেছো । ‘ভেন্ন’ ! আসলে কী জানো ? আমার তো মনে হয় কেউ-না-কেউ বা অনেকেই দাদাদের কাছে গিয়ে চুকলি কেটেছে । এছাড়া তো আমি আর কোনো কারণ দেখিনে । ১৭৮২ সালে রবিনসন বা রবার্টসন, বা ওই রকমই হবে । মনে পড়ছে না ঠিক । তবে সালটা ঠিক । উনি স্টাডি করে বাঙালির দুশো বিরাশিটা নেতিবাচক দিক দেখিয়েছেন । তার মধ্যে চুকলি অন্যতম । এখ আরো দুশো একাশিটি । কি-কি গবেষণা করো গুরু ? আমাদের অনেকের ধারণা যে গুরু সব সময়েই বয়সে বড়ো হয় । এক্ষেত্রে নয় । ‘গু’ মানে তো জানো, অন্ধকার । আরো অনেক কিছু হয়, হাগু-টাগু জাতীয় । সেসব বলছি না । ‘রু’ মানে যা অন্ধকার দূর করে বা যিনি অন্ধকার দূর করেন । সেজন্যই তো তোমাকে ‘গুরু’ বললাম । Don’t take it otherwise. এবারে তোমার পরের প্রশ্ন, না ছোটোখাটো এক নিবন্ধে যাই, কেমন ?

মলয় : আপনার জীবন তো বেশ কার্নিভালেস্ক । জন্মেছেন কলকাতায় ১৯২৫ সালের রাবীন্দ্রিক বর্ষায় । পড়াশুনা শুরু করেছিলেন রাজশাহি শহরের জীবনানন্দীয় পাঠশালায় । ১৯৩৯ সালে সুনীল গঙ্গোর ফরিদপুরের কণকদ্বীপে গিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন । মালদায় এসে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক দিলেন । কলেজে কোথায় ভর্তি হলেন ? মালদাতেই ? তারপর ১৯৪৪ সালে নেভিতে যোগ দিলেন, ক্যাডেটদের সঙ্গে আন্দোলন করলেন আর বরখাস্ত হলেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান এয়ারফোর্স বেসে দমদমে যোগ দিলেন আণ্ডারক্যারেজ রিপেয়ারার হিসেবে । ১৯৪৮ সালে জয়েন করলেন ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে । আট-নয় বছর চাকরি করে সেখানে গোলমাল বাধিয়ে কোর্ট মার্শালে চাকরি হারালেন । এর মাঝে কখন যেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারে ওভারসিয়ার হয়ে গোল্ড মেডালও পেয়েছিলেন । প্রাইভেটে আই.এ. পরীক্ষা দিলেন ১৯৫৭ সালে । ওই বছরেই শেষের দিকে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে ডায়েটিশিয়ানের চাকরি নিলেন । ছেড়ে দ৮ইয়ে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত বেঙ্গল পটারিজে সুপারভাইজারের কাজ করলেন আর তার মধ্যেই বি.এ. পাশ করলেন । ১৯৬৩ থেকে টানা তিরিশ বছর শিক্ষকতা করলেন নাকতলা হাইস্কুলে । ইতিমধ্যে ১৯৬৮ সালে এম’এ. পাশ করেছিলেন । আপনার প্রথম স্ত্রী নমাসে-ছমাসে একদিন আসতেন, কলকাতায় কাজ থাকলে । প্রথম স্ত্রী থাকা সত্বেও নাতনির বয়সী ছাত্রীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করলেন, কেননা সে অন্তসত্বা হয়ে গিয়েছিলেন । তিনিও আপনার সন্তানকে নিয়ে আসেন না লোকলজ্জার ভয়ে । পরিবারহীনতা, গাঙ্গুলিবাগানের এই একঘরের ফ্ল্যাটে, যে অবস্হায় আপনি নিজেকে পাচ্ছেন বা রাখছেন, তা কিন্তু আপনার কবিতাকে পেড়ে ফেলতে পারেনি । মনে হয়, পরিবারহীনতা, যোগাযোগহীনতা, স্বজনহীনতা, বন্ধুহীনতা, এগুলো বরং উল্টে আপনাকে আহ্লাদিত করছে, যার দরুণ আপনি অজস্র প্রতিস্ব ক্রিয়েট করে আহ্লাদের একটা কারেন্ট বজায় রাখেন প্রতিটি কবিতায় । আধুনিকতাবাদী অনুশাসনে, যা বোদলেয়ার থেকে শুরু হয়ে টি.এস.এলিয়ট প্রমুখের হাই মডার্নিজমে পৌঁছেছিল, আহ্লাদের অনুমোদন ছিল না । আপনি কিন্তু অবিরাম বজায় রেখে গেছেন প্রতিটি কবিতায় । জীবন যাপনের ঝুঁকি এক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছেন, জেনে বা অজান্তে, নাকি ?

কেদার : আপনার জীবন তো বেশ কার্নিভালেস্ক । ভালোই বলেছ । একবার, একবার কেন বহুবার, বহুজনকে বলেছি, এক বছর সময় দিলাম, বেশিও নিতে পারো, চিন্তাভাবনা করে এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলো, যা আমার জীবনে ঘটেনি । পারলে পিটার স্কট খাওয়াবো । পারেনি । ‘রাজশাহি’ কেন ? হবে তো রাজসাহী । যা আমি লেখেছি সারাটা জীবন । রাজসাহী শহরের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এই বানানই ছিল এবং আছে । নাটোরের মহারাজা রামজীবনের জমিদারির নাম ছিল রাজসাহী । বিস্তৃতি ছিল ১২,৯০৯ বর্গ মাইল, আর আয় ছিল সিক্কা ২,৭০২,৪০০ টাকা । ভাবো । জীবানন্দীয় পাঠশালা বলছ। কাব্যি করছ ? আমার তো পাঠশালার নাম ছিল ‘সাবিত্রী শিক্ষালয়’ । তার আগে অন্যান্য পাঠশালায় পড়েছি । এমনকী কাশীতেও, বাঙালিটোলায়, সেই প্রথম । মালদায় কেন ? অথচ মালদায় । আসলে চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিক পাস করি । ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম বলে রাজসাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হতে হলো । নিলাম  বিজ্ঞান । ওই সময়ে ওই কলেজে কবি উত্তম দাশের মা, মানে মাদার-ইন-ল ভর্তি হয়েছিলেন । তখন আলাপ হয়নি । মেয়েদের জন্য বিরাট বিরাট ব্যারিকেড বসানো হতো ক্লাসরুমে । তাই ! এখন  হয়েছে । ‘সুনীল গঙ্গো’ কেন ? তেল দিচ্ছ ? যাই হোক, আমাদের গ্রামের নাম ছিল, এখনও বোধহয় আছে, কৌড়কদি । কণকদ্বীপ নামক পদার্থটির অপভ্রংশ । ‘ক্যাডেট’ নয় । নেভিতে রেডিও মেকানিক হিসেবে যোগ দিই । আমেরিকান এয়ারফোর্স থেকে যুদ্ধশেষে গোল্ড মেডাল পেয়েছি । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে নয় । তারই মুনাফায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাব-ওভারসিয়ার । বছর আড়াই কাজ করে ছেড়ে দিই । লোকে বলে কোর্ট মার্শাল । আসলে রাজনীতির কারণে দিল্লিতে চোদ্দ দিন চোদ্দ রাত জেরায় জর্জরিত হয়ে চাকরি নট । অফিশিয়ালি ডায়েটিশিয়ান নয় । বাস্তবে কিন্তু তাই । শুধু ক্যানসার হাসপাতালে নয়, সেবাসদনেও । দেশবন্ধুর বাড়িতে কাজ করে ঘুষ নেবো ? অঢসম্ভব । ভাবনায় আসে না । তাই আবার চাকরি ছেড়ে দিই । ১৯৬৮ সালে কোনো পরীক্ষাই দিইনি সুতরাং এম.এ. পাশ করার প্রশ্নই ওঠে না । আসলে আমি ইংরেজিতে অনার্স এবং ইংলিশ ইন্স্টিটিউট থেকে ড.ই.এল.টি. – ব্যাস । তুমি বলছো ‘পরিবারহীনতা, যোগাযোগহীনতা,স্বজনহীনতা, বন্ধুহীনতা, এগুলো বরং উল্টে আহ্লাদিত করেছে আপনাকে ।’ এগুলো সবই একদিকে সত্যি, অন্যদিকে নয় । গোটা পৃথিবীর মানুষজনই, জন্তুজানোয়ার, গাছপালা, বৃক্ষলতা, এরা সবই আমার পরিবারভুক্ত বলেই আমি মনে করি । লোকে অবশ্য পাগল-টাগল এরকমকিছু একটা বলবে । বলুক । বলে-ও । একটা ইন্টারন্যাশানাল আউটলুক না থাকলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না । বিশ্বাস । এই আইডিয়া কিন্তু মোটেই বানানো নয় । সহজাত । মাতৃগর্ভ থেকে উৎসারিত । বিলিভ ইট অর নট । তাইই । তুমি বলছ ‘আহ্লাদ’। আমার কবিতা পড়ে তোমার তাই মনে হয়েছে বোধহয় । আসলে আমি যন্ত্রণায় নীল হয়ে আছি সব সময় । এসব দেখতে হলে একটি তৃতীয় চক্ষু চাই । আমার মনে হয় আমার তা আছে । বৈশিষ্টটা তাই । 

মলয় : আপনার যৌনজীবন সম্পর্কে নানা কানাঘুষা শোনা যায় । ‘জাস্ট ডু ইট টু মি’ ধরণের অভাবনীয় ঘটনা । এখন তো সত্তর পেরিয়েছেন । একটু স্মৃতিচারণ করুন না, শোনা যাক ।

কেদার : ‘আপনার যৌনজীবন নিয়ে কিছু কানাঘুষা শোনা যায় ।’ কবি মাত্রেই এক ধরণের অ-সামাজিক জীব । তাও আবার বাঙালি । তাও আবার যৌন । কানাঘুষা করবে না ? স্ল্যাণ্ডারিঙ? জেনে রাখো, হাফ আ ট্রুথ ইজ অলওয়েজ আ গ্রেট লাই । প্রবচন । ভালোবাসা, কবিতা, রোমান্টিকতা ছাড়া এ জীবনে আর কিছু নাই । আমার জীবনে ছেলেরা যেমন এসেছে, মেয়েরাও তেমনি । এখনও আসে । যৌনতা কি জীবন থেকে আলাদা কিছু ? এতো আগ্রহ কেন তোমার ? কই, আমার রাজনৈতিক জীবন সম্বন্ধে তু কিছুই বলছ না ? ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে চাপাই নবাবগঞ্জ শহরটা তিন দিন বস্তুত অধিকার করে রেখেছিলাম আমরা ক’জন স্কুলের ছেলেরা । ধরা পড়িনি । পড়লে ভালো হতো । এখন ফ্রিডাম ফাইটারের পেনশনটা অন্তত পেয়ে যেতাম । অন্তত বেশ কয়েক ডজন পিটার স্কটের বোতল এসে যেত ঘরে । আপসোস করছি না । কিন্তু ঘটনাটা তাইই । একেক দিনে একেকটা কবিতার বই বেরিয়ে যেতো । কলমে, আড়াই ঘণ্টায় সাতান্নটা কবিতা লিখেছি । রেকর্ড । প্রয়াত কবি অশোক চট্টোপাধ্যায় তার কয়েকটা পড়েই মুগ্ধ । পরে আলাপ । খোজারা কি খুব ভালো কবিতা লেখে ? কখনও ? কবিতা লিখতে হলে বীর্যবান হতে হয় মলয় । বীর্যবান । জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে হয় । তেরোবার, ঠিক তেরোবার, মৃত্যু নামক মাগিটা বুকে হিসসস তুলে বেরিয়ে গেছে । অভাবনীয়ভাবে বেঁচে গেছি, রয়েছি, এখনও । ‘মনে হয়’ কেন ? আমি নিশ্চিত । রবার্ট ক্লাইভ দুবার এভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন । তৃতীয়বার নয় । তুমি জানো ? পরিশেষে বলি । তোমার হয়তো কাজে দেবে । অ্যাডমিরাল রিকোভার, ফাদার অব আমেরিকান নিউক্লিয়ার নেভি, একবার বলেছিলেন, Great minds discuss ideas, average minds discuss events, small minds discuss people. সুতরাং কানাঘুষা যারা করে থাকে তাদের Sexually perverted বললে কি খুব মিথ্যে বলা হবে ? ‘কানাঘুষা’কে ইংরেজিতে কী বলে ? Hearsay. এবং কোনো আদালতেই  ethical, moral অথবা legal কোনো আদালতেই ধোপে টেকে না । 

মলয় : টাক পড়ে গেছে বলে ইনহিবিশান আছে ? আপনার যৌন এক্সপ্লয়েটগুলোয় অসুবিধে হয়নি টাকের জন্য ? আমি তো আমার টাকপড়া চেহারা ভাবতেই আতঙ্কিত বোধ করি । টাকমাথা কবি, কেমন যেন আধুনিকতাবাদী মিসনোমার । অনেকে বলেন যে বয়স অনুযায়ী কবিতাভাবনায় পরিবর্তন দরকার । যেমন কবিরুল ইসলাম বলেছেন যে, আমার কবিতায় যৌনতা থাকাটা এই বয়সে অনুচিত । বয়স অনুযায়ী পালটাতে হবে, এভাবনাটা আধুনিকও নয়, বলা যায় প্রাগাধুনিক । আপনি তো শারীরিকভাবেও, মানে অ্যাপিয়ারেন্সের দিক থেকে, বেশ কিছুকাল যাবৎ কান্তিচ্যূত, কিন্তু যৌনতামুক্ত করেননি নিজেকে, বা করতে পারেননি । নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন কখনও এভাবে ? কলকাতায় কবিতার রাজনীতির মাঝে সতত নেশাগ্রস্ত কবিরা নিজেদের সম্পর্কে যেটুকু ভাবেন, তা সামনে সাহিত্যসমাজটাকে দাঁড় করিয়ে । আপনি একা নিজেকে অ্যাসেস করেছেন কখনও ? আপনার সামনে কেউ নেই, পাঠক নেই, তেমনভাবে ?

কেদার : Euphemism বোঝো না ? অতো টাক-টাক করছ কেন ? বলতে পারো না, উদাত্তকপাল? আমার যতোদূর মনে পড়ে সক্রেটিসেরও উদাত্তকপাল ছিল । ঈশ্বরচন্দ্রেরও । নেতাজীরও । আমার জানা অন্তত শ’খানেক গ্রেটদের নাম করতে পারি । আসলে উদাত্তকপাল মায়েরই স্নেহভার । উদাত্তকপাল মাতৃকুলজাত । তাকে অবহেলা করি কী করে বলো ? কবিরুল ইসলাম কী বলেছেন, তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । আমি জানি, আমার ভিতরে আরেক কেদার বাস করে । তার বয়স কিছুতেই চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয় । কমও হতে পারে । তার তো উদাত্তকপাল দেখি না । অভাবনীয় ? আর অ্যাসেস ? একথাটি বলছো ?  আমাদের সাহিত্যসমাজটিকে জানিনে, জানতেও চাইনে । আরে, আমার পাঠক থাক বা না থাক, উত্তম তো আছে, উত্তম দাশ । কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, পি.এইচ.ডি., রিডার। দ্যাখোনি ? প্রতি সংখ্যায় আমার কবিতা প্রথমেই ছাপা হয় । এ তার মহত্ব । মহত্বই বলব । আমি বলিনি কখনো । এই তো সন্মান । আর কী চাই ? চাই নাকি ? নিজেই জানি না । আর ‘কান্তিচ্যূত’ বলছ ? তা তো হবোই । কাল সবকিছুই খায়, খেয়ে ফ্যালে । এই হলো জাগতিক নিয়ম । উপেক্ষা করতে পারি । কিন্তু লঙ্ঘন করতে পারি না ।  এবং এক মজার কথা হলো – মজার কথাই বলি । ক্লাস টুয়েলভে ইংরেজির ক্লাস নিতে-নিতে সুদেষ্ণা নামে এক মেয়ে, সুদেষ্ণাই বটে । বলেছিলো : ‘স্যার, একটা চোস্ত জিনস পরবেন, একটা ঝকঝকে নতুন । তিন হর্স পাওয়ারের একটা বাইক নেবেন । ঋভালা দেবেন । আমাদের মতো যেকোনো মেয়েকেই পেছনের সিটে তুলে নিতে পারবেন, এখনও।’ আরেকজনের কথা বলি । সেও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো, এই কিছুদিন আগেও । বলেছিলো, কথায় কথায় বলেছিলো, ‘মেয়েদের পেতে হলে.স্যার, স্রেফ হরণ করতে শিখতে হয় । মেয়েরা বলুক বা না বলুক, মনে মনে এই চায়, জানেন ?’ এতে আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না । কিন্তু ওদের মানসিকতা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায় । কথাটা পরে ভেবে দেখেছি, ইতিহাসগতভাবে ঠিক । অতো কান্তি-টান্তির দরকার নেই, যা দরকার তা হলো শক্তির । বলো আমি ‘শক্তিচূত’ হয়েছি ।

মলয় :  আপনার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল হাতে লেখা মশাল পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে, মানে এবারো বছর বয়সে, সম্পাদক ছিলেন অমিয়কৃষ্ণ সান্যাল ।  বাঙালি কিশোরের টিপিকাল অভিব্যক্তি । ১৯৪৯ থেকে রেগুলার কবিতা লেখা শুরু করলেন । বেঙ্গল পটারিজ আর এয়ারফোর্সের হাউস ম্যাগাজিনেও লিখেছেন । তখন তো এখনকার মতন লিটল ম্যাগাজিন ছিল না । ছটফটানি সামলাতেন কোন উপায়ে ? আপনার প্রথম বই ‘শুকনো জল’ বেরিয়েছে বহু পরে, ১৯৬৯ সালে । এতো দেরিতে কেন ? সম্ভবত এই গ্রন্হের জন্যই আপনাকে ছয়ের দশকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, নইলে একাধবছর পরে বের করলে সত্তর দশকের তালিকায় যেতেন । ছয়ের দশকের যে-দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা আছে, কাঠের পা-অলা কবি এবং ঘোড়ার পা-অলা কবির, আপনি বোধহয় তার মাঝের লিংক । ওই ভাঙনের জায়গাটাই নৈতিক-নানন্দনিক জলবিভাজক, আধুনিকতাবাদী মানদণ্ডগুলো ভেঙে ফেলার কাজ আরম্ভ হয়েছিল । আপনার দ্বিতীয় বই ‘পাথরের স্লেট’ ১৯৭৪ সালে, ‘চারপুরুষ এক নারী’ ১৯৮০ সালে, ‘তিন ভূবনের প্রেম’ ১৯৮২ সালে আর ‘এই তো ঠিকানা’ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । তারপ[র বোধহয় বেরোয়নি কোনো বই । 

কেদার : প্রথমে কারেক্ট করে দিই । অমিয়কৃষ্ণ সান্যাল নয় । অমলকৃষ্ণ সান্যাল । পরে লেখক অমল সান্যাল । সেন্ট লরেন্স স্কুলের মাস্টারমশায় ছিলেন । প্রয়াত হন ১৯৮৭ সালে । ওনার অনেকগুলো বই আছে । শেষ বই কণকদীপ’ । উপন্যাস । পুনাতে থাকতে, সেই ১৯৪৯ সাল থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি । গড়ে দুটো করে প্রতিদিন । আজ ১৯৯৯ সালে বছর পূর্তি শুরু করি । এই উপলক্ষে খাওয়াবে না? স্কচ ? সত্যি কথা বলতে কি ছাপানোর জন্য ‘ছটফটানি’ কোনোদিনই অনুভব করিনি । এয়ার ফোর্সের কিছু-কিছু বন্ধুদের শোনাতাম । কেউ কেউ কোনো কোনো কবিতায় আবার সুর দিতো হারমোনিয়াম ও তবলায় । ব্যাস, এইটুকুই । ১৯৬৯ সালেও ‘শুকনো জল’ বেরোতো না যদি না নাকতলা স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশায় অশোক ঘোষ উদ্বুদ্ধ করতেন ।  তখন পর্যন্ত, জানতাম না বাংলায় কে কে কবিতা লিখছেন। তাদের কাঠের পা নাকি ঘোড়ার পা আছে বা নেই খোঁজই রাখতাম না । রাখার প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনও । এই হিসেবে বাংলার কাব্যজগতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত এই আমি । পরে, ১৯৭১ সালে স্বনামধন্য দেবকুমার বসুর সঙ্গে আলাপ হয় । আলাপ অবশ্য একটু-আধটু এর আগেও হয়েছে । ১৯৭১ সালে গভীর । দুজনে মিলে ‘সমায়ানুগ’ পত্রিকা বের করি । ক্রমে অন্যান্য পত্রিকায় আমার কবিতা বের হতে থাকে । এবং পরিচয়ও হতে থাকে অনেকের সঙ্গে । কিছু-কিছু নাম বলি । উত্তম দাশ, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ মণ্ডল, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, রবীন সুর, আনন্দ ঘোষ হাজরা, অভিজিৎ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, অতীন্দ্রিয় পাঠক, ঈশ্বর ত্রিপাঠী এবং আরো আরো আরো । আইপারবোলিক হয়ে গেল না । হলো । কিন্তু সেটাও তো ভাষারই অলঙ্কার ।  ‘ণেতিক-নান্দনিক জলবিভাজক ও আধুনিকতাবাদী মানদন্ডগুলো ভেঙে ফেলার কাজ আরম্ভ হয়েছিল’ । বলেছো । আমি কিন্তু এসবের কোনো খবরই রাখি না । ইহাই আমার কৃতি, প্রকৃতি । আন্দোলনের মাধ্যমে আধুনিকতাবাদী হওয়ার কোনো চেষ্টাই আমার নেই । শব্দই আমার সুর, শব্দি আমার লয় । মন যা বলে তার লক্ষ-কোটি ভাগের একভাগ আজ তক লিখেছি কিংবা লিখে ফেলেছি । শতশত কবিতা চুরি হয়ে গেছে, স্রেরফ চুরি । সহস্র সহস্র কবিতা উইপোকায় খেয়েছে । কোনো ক্ষোভ নাই । কোনো দুঃখ নাই । মহাকালের ঘোড়া আসছে টগবগিয়ে । কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে তার হদিশ পাবো না । তবে একটা যন্ত্রণা আছে । লক্ষ কোটি ভাগের একভাগ কেন, তার বেশি নয় কেন, তারই । সেকথা থাক । ‘এই তো ঠিকানা’ বেরোবার আট বছর পরে উত্তম দাশের প্ররোচনায় এবং তারই তত্ত্বাবধানে এবং তৎপরতায় ১৯৯১ সালে বেরোয় ‘নির্বাচিত কবিতা’ । এই বই বেরোবার পর আমার খ্যাতি বোধহয় বেড়েই গেছে । বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়ে গেলাম কিনা, তাই । আলসেমির একটা সীমা আছে । অন্যকে দোষ দিই না, নিজেকেই । প্রতি বছরই আমি একটা করে বই বের করতে পারি । অনায়াসেই । মনে হচ্ছে কপাল খুলেছে একটু, আমার । একজনকে পেয়েছি, ভারি ইনটেলিজেন্ট এবং সুন্দর । আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে বন্ধু । সেই কপি করে দেবে । মনে হয় । নাম অর্ঘ্য বাগচী । বারিন্দির । দেখি কী হয় । দু’হাজার সালে বইমেলায় এবং যদি বেঁচে থাকি, তার পরেও ।

মলয় : আপনার ঘরে খবরের কাগজ বা নিউজ ম্যাগাজিন দেখি না । আপনি কি সংবাদপত্র পড়েন না ? বাংলা খবরের কাগজগুলো অবশ্য নিজের নিজের বাস্তবতা বানায় । ‘বর্তমান’ পড়লে সঙ্গে ‘গণশক্তি’ পড়তে হবে । ‘আনন্দবাজার’ পড়লে সঙ্গে ‘আজকাল’ পড়তে হবে । তারপরেও প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবেন না । সত্যের মালিকানা কেবল ক্ষমতাধিকারীর । বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগীতার মতন বয়স্কদের নিজে খবর বানাও প্রতিযোগীতায় টেনে নামায় সংবাদ-মাধ্যমগুলো । তার ওপর কাদের বানান সঠিক আর কাদের ভুল সে আরেক নরক । আপনার কি মনে হয়, সংবাদ মাধ্যমের বানানো হাইপাররিয়্যালিটি  আপনার ইম্যাজিনেশনের জগতে হস্তক্ষেপ করে ? নাকি, এমনিই পড়েন না ? জাস্ট বোরড অফ এভরিথিঙ । আমার কথা যদি বলেন, আমি সংবাদপত্র আর নিউজ ম্যাগাজিন তো পড়িই, আমি বিবিসি, সিএনএন, জিটিভি, আইআইডাবল্যু, স্টার নিউজ চ্যানেলগুলোও সারফিঙ করি । আপনার তো টিভিটাও খারাপ হয়ে পড়ে আছে দেখলুম । ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি এসব চ্যানেলগুলো দ্যাখেন, নাকি কেবল ‘দূরদর্শন’? আমার তো কেমন সন্দেহ হয় যে আপনি নিজেকে সম্পূর্ণ ব্লক করে নিয়েছেন । হয়তো আপনার কবিতার ফুর্তি বানাতে অমন ব্লকেজ দরকার । কিন্তু সাহিত্যজগতে এই মুহূর্তে কী ঘটছে তা জানার জন্যেও তো প্যারিস রিভিউ, টাইমস লিটেরারি সাপলিমেন্ট, এপিআর, পোয়েট্রি, লন্ডন ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে অন্তত চোখ বোলাতে হবে ! সাহিত্য সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক চিন্তাধারা ওব্দি পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে । কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সমালোচনা ইত্যাদি বিভিন্ন জঁরের আধুনিকতাবাদী, মতান্তরে সাম্রাজ্যবাদী, বৈধতার ও নৈতিকতার ভিত্তিটাই তো বদলে যাচ্ছে । আপনি কি এসমস্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান । থাকতে চান আপনার ফুর্তিবাজ কাব্যজগতে ?

কেদার : উরিব্বাবা ! অনেকগুলো নাম করে ফেলেছো ! এর অনেকগুলোর নামই শুনিনি কখনও । তুমি বলছ, সাহিত্য সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক চিন্তাধারা ওব্দি পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে । ঠিক । এই পাল্টে যাওয়াটাই তো ভেরি ন্যাচারাল । আমি চাইলেও যাবে, না চাইলেও যাবে । নেচার কে কি কখনও অস্বীকার করা যায় ? গেলেও যাওয়া কি উচিত ? সারফিং করার জন্য আমার আরেকটি টিভি আছে, তার নাম ‘সময়’ । সেই আমাকে সব জানিয়ে দেয় । সবকিছু । আমি তো লিখব শুধু কবিতা । এখন । আগে গদ্যও লিখেছি অনেক । তার অনেকগুলি ম্যানিফেস্টো । কিছু বেরিয়েছিল, বেশ কিছু ‘সময়ানুগ’-এ। আর কিছু ‘ব্যতিরেক’ পত্রিকায় । ‘ব্যতিরেক’ পত্রিকা বিপ্রতীপ গুহ, শুভানন রায় আর আমিই চালাতাম । পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের নাম শুনেছো কখনও ? তিনি বলেছিলেন, “খবরের কাগজ একজনকে পাঁঠা করার পক্ষে যথেষ্ট । আমি রামকৃষ্ণদেব নই । খবরের কাগজ কখনো রাখি কখনো রাখি না । আর ‘গণশক্তি’ পড়লে আমার সর্বাঙ্গে র‌্যাশ বেরোয় । তুমি  যাই মনে করো আর তাই মনে করো । সত্যি । বেটাদের সঙ্গে অনেক অনেক অনেক বছর কাটিয়েছি । অভিজ্ঞতার কি কোনও দাম নেই ! নাকি ? ফুর্তিবাজ জগৎ কেন বলছ ?  বারে, বারে । পাঁঠাকে ধরে আড়াই প্যাঁচ যখন বধ করে কসাই তার ছটফটানি লক্ষ্য করেছ কখনও । শালা শুয়োরের জগতে আমি এক পাঁঠা । কলজে থেকে বেরিয়ে আসে এক নিখাদ যকৃৎ । রঙ তার সেই নারীটির মতো । আমি ছটফট করি, কাতরাই, কেউ কিছু খবর রাখে না । কেননা ঘরে থেকেও আমি একা । একাই । আসলে নারীরা ঠিক জলের মতো । বর্ণ নেই । নিমকের মতো । কোনো স্বাদ নেই । স্বাদিষ্ট হয় তখন যখন আমি, আমিই গ্রহণ করি তাকে । ভারতে গান্ধিজি না এলেও, সূর্য সেন না এলেও, নেতাজী না এলেও, বিশ্বাস করি, পরিপূর্ণ বিশ্বাস করি, একদিন-না-একদিন-না-একদিন ভারতবর্ষ স্বাধীন হতোই । তুমি এক ছাগল । এই সম্বোধনে তুমি আবার কিছু মনে করলে না তো ? যাকে খুউব ভালোবাসি তাকে মুখ ফসকে বলে ফেলি । এই বিশেষত্ব । এসবের কোনো খবরই রাখো না । আমি যদি সমালোচক হতাম তবে ওইসব ম্যাগাজিনগুলোয় অন্তত চোখ বোলাতাম । আমি যা করি তা হলো এই । ধ্যান । নির্জনতায় ধ্যান । ধ্যান মানে খুব সহজ, আবার কঠিনও । এক জায়গায় বসে মনকে মননশূন্যতায় নিয়ে যাওয়া চাই । কিম্বা যেকোনো একটি দৃশ্যে বা বস্তুতে অপলক অনেকক্ষণ দৃষ্টি রাখা চাই । এরকম বেশ কয়েকমাস অভ্যাস করলেই কে যে শেয়াল আর কেই বা সিংহ মুখ দেখেই চেনা যায় । অদ্ভুত এক শক্তিস্ফূরণ হয় তাতে । ফলে কবিতা বা যেকোনো শিল্পের অবস্হান সর্বকালীন এবং সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে । আমি যে একা থাকি বা থাকতে হয় আমার পক্ষে ও দুটোই — নির্জনতা এবং ধ্যান, বেশ সহজলভ্য । তুমি এসব একটু প্র্যাকটিস করে দ্যাখোই না কী হয়।

মলয় : কবি-লেখকদের ঘর দেখেছি বইপত্তরে ছড়াছড়ি । আপনার ঘর দেখছি একেবারে ফাঁকা । কড়িকাঠের কাছে তাকটায় যেসব বইপত্র অগোছালো রাখা, তা বোধহয় আপনার রান্নাঘরের ধোঁয়ায় বহুকাল যাবত বোরখা পরে বসে আছে । কিছু বই বোধহয় আপনার নিজের, দপ্তরির প্যাকিঙের মধ্যেই রয়ে গেছে । আপনি বইপত্র সংগ্রহ, রেফারেন্সের জন্য রাখা, পরে আবার পড়া, এগুলো করেন না সম্ভবত । বইটই পড়েন ? ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ন্যাশানাল লাইব্রেরি, সাহিত্য পরিষৎ যান ? লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা পত্রিকা পাঠান ? আমি কিন্তু বইপত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করি না । পড়া হয়ে গেলে আগ্রহীদের দিয়ে দিই । পাটনায় অবশ্য আমার ভালো ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল ।গিন্সবার্গ, জেমস লাফলিন, ফেরলিংঘেট্টি, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, কার্ল ওয়েসনার, মার্গারেট র‌্যানডাল, ক্যারল বার্জ, ডিক বাকেন এঁরা অজস্র বই পাঠিয়েছিলেন । আমি লখনউ চলে গেলুম, বাবা-মা মারা গেলেন, তারপর এদেশে দুষ্প্রাপ্য বইগুলো চুরি হয়ে গেল । কলকাতায় যখন ১৯৯৪ সালে মুম্বাই থেকে এলুম, তখন শুনলুম অধিকাংশ বই মেরে দিয়েছিল দাদার এক ভায়রাভাই রঞ্জু ভট্টাচার্য, যেহেতু বই চুরি করাটা আধুনিকতাবাদী সদর্থক মূল্যবোধ । আমাদের উত্তরপাড়ার আদিবাড়িতে বিরাট একটা সিন্দুকে তালপাতার অমূল্য সব পুঁথি ছিল । ঠাকুমা মারা যেতে সেগুলোও হাপিশ । পড়াশুনা অবশ্য ছাড়িনি । লেখালিখির চেয়ে পড়াশুনা আমি বেশি করি । আপনি তো একা থাকেন, পড়াশুনা ছাড়া তো বেশ ভয়াবহ হবে প্রতিদিনের সময় কাটানো । তার ওপর হাত কাঁপে বলে লিখতে পারছেন না কিছু । এ তো চরম দুর্দশা । মোকাবিলা করছেন কী ভাবে ? কবে থেকে চলছে ? কেনই বা ?

কেদার : আমার একটা নেশা ছিল । বই কেনা । বই কেনা । বই কেনা । কিন্তু ওগুলো কবি উত্তম দাশের মতো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো সেই প্রতিশ্রুতি আমার ছিল না কখনও, নেইও । তার অনেকগুলি উইপোকায় খেয়েছে । অনেকগুলি, তোমার মতোই, হাপিশ । আবার অনেকগুলো অন্যদের দিয়ে দিয়েছি । উপহার । এখন অবশ্য কিনিনা বিশেষ । খুব কাছেই আমার এক বন্ধু থাকে । সুভাষকুমার মজুমদার । মাস্টারমশায়, বিয়ে-থা করেনি । একা । তারও ওই রোগ । কতো লক্ষ টাকার বই কিনেছে ও-ও জানে না । দরকার পড়লে যেকোনো বই যেকোনো সময়ে যে কোনো মুহূর্তে নিয়ে আসতে পারে ।  না থাকলে নিজে কিনে এনে দেয় । এমন । সেদিন চেলেনি পড়লাম । তার ডায়রি । ওই একটা বই পড়লেই ইতালির মধ্যযুগটা, ভয়ঙ্কর মধ্যযুগটা, বেশ জানা যায় । আসলে আমি যেসব বই পছন্দ করি, তা হলো সত্যি সত্যি সত্যি যা তাই । যেমন—ইতিহাস। নেপোলিয়ান অবশ্য বলেছিলেন ‘What is history but a fable agreed upon ?’ আবার মজাটা দ্যাখো, আনাতোল ফ্রাঁ বলেছিলেন ‘All the historical books which contain no lies are extremely tedious.’ যেমন ভূগোল, যেমন ভ্রমণ বৃত্তান্ত – মার্কো পোলো, স্টিভেনসন, ক্যাপ্টেন স্কট, কতো আর নাম বলব, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ! যেমন দর্শন, দর্শনের বই । যেমন অটোবায়োগ্রাফি। উপন্যাস ও গল্প একসময়ে অনেক পড়েছি। যেমন টলস্টয় । ডস্টয়েভস্কি । জ্যাক লণ্ডন । অসকার ওয়াইল্ড । এমন এমন অনেক । ডান হাত কাঁপে। বাঁ হাত একটু । কবিতা তো লিখি । ওই বাঁ হাত দিয়েই কাজ সেরে ফেলি । কপি করার জন্য অবশ্য ছাত্ররা আছে । ছাত্রীও । একে চরম দুর্দশা বলছ কেন ? কতোজনের তো দুটো হাতই নেই ! তারা আবার পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেয় । দেখেছি । এভাবেই মোকাবিলা । অনেক বছর থেকে । আর ‘কেনই বা’ ? ঈশ্বরের ‘আশীর্বাদ’ ছাড়া আর কী-ই বা বলি ! 

মলয় : জীবনে প্রথম যে গালাগালটা খেয়ে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, সে-ব্যাপারটা একটু বলুন । আমার শৈশব কেটেছে পাটনা শহরের ইমলিতলা নামে এক ক্রিমিনাল এলাকায়, কাহার-কুর্মি-দুসাধ অধ্যুষিত দাগি পাড়ায় । তাই গালাগাল ব্যাপারটায় আক্রান্ত হয়ে ইনোসেন্স মুক্তির অভিজ্ঞতা আমার নেই । আপনি তো রাজসাহিতে ঘোড়ামারা গ্রামে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন । প্রথম গালাগালের ধাক্কার তীব্রতা, যা দিয়ে মানবসমাজে আপনার আধুনিকতাবাদী ইনিশিয়েসন হলো, সে-অভিজ্ঞতার কথা বলুন একটু । লেনি ব্রুসের প্রথম শোনা আর প্রথম দেয়া গালাগালের জীবনে ভূকম্পন-ঘটানো একটা লেখা পড়েছিলুম, বছর তিরিশেক আগে । অসাধারণ মনে হয়েছিল । বাঙালি কোনও লেখক বা কবির অমন অভিজ্ঞতার বয়ান কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ছে না । আপনারটা শোনা যাক ।

কেদার : মহাভারতে কর্ণের চরিত্রে যা-যা বৈশিষ্ট্য ছিল তার অনেকগুলো আমারও । বোধহয় । ভেবে দেখেছি বহুবার, সংখ্যাতত্বের দিক দিয়েও এক । সূর্য ও ইউরেনাসের প্রভাব প্রকট । এখন কর্ণের জীবনটা জানা থাকলে আমার জীবনটাও জানা হয়ে যাবে, অনেকটা । বৃষকেতুকে বধ করে কর্ণ যেমন, আমিও তেমন । ঘোড়ামারাটা গ্রাম নয়, একটা পাড়া, রাজসাহি শহরের । তখনও ক্লাস ওয়ানে উঠিনি । পাড়ার এক ভদ্রলোক আমাকে একদিন– এখন আমাকে যা দেখছো, রূপে, তেমন নয়–এতই ফরসা ছিলাম যে মাকে ডাক্তার ডাকিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছিল, রোগটোগ নয়তো ! এতো ফরসা হয় কী করে ?—জিজ্ঞাসা করেছিল, খোকা তোমার বাবার নাম কী ? এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আমি জীবনে শুনিনি । হকচকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কেন, বাবা’ । বাবার যে একটা নাম থাকতে পারে সে বোধ তখনও হয়নি । অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণও আছে । বললে বড়ো গল্প হয়ে যাবে । থাক । একদিন সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে বাজার যাচ্ছিলাম । তখন টুতে পড়ি । আমার উল্টো দিক থেকে আমারই বয়সী একটা ছেলে আসছিল । চেনা নয় অথচ চেনা । আলাপ-টালাপ হয়নি কখনও । কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠলো ‘শা-লা’ । শুনে আমি স্তম্ভিত । বিস্মিত । কা্ছে কেউ নেই যে ও অন্য কাউকে ও-কথা বলেছে । মুখ দিয়ে ‘শালা’ কথাটা বলা যায়, এ যে কী বিস্ময়, এবং অশ্লীল । মুখের মধ্যেই যে ভগবান থাকেন, এ বোধ অন্তত তখনো ছিল । নইলে গালের ওপর একটি চড়ে পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট দাগ ফেললাম কী করে ? যা হোক, ছেলেটি কেঁদে ফেললো । আমিও অনেক দূর এগিয়ে গেছিল যখন এগিয়ে গেছি তখনও ছেলেটা ওখানে দাঁড়িয়েই আবার বললে, ‘শা-লা’ । আমি শুনলাম, দাঁড়ালাম, ঘুরে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আস্তে-আস্তে । ও কিন্তু পালালো না । সহজেই পালিয়ে যেতে পারতো । দৌড়ে । আমিও গিয়ে আবার একটা চড়, আরো জোরে । এরকম বারবার তিনবার । ওর চোখে জল, টপ টপ করে ঝরে পড়ছে, এখনও দেখছি । এই চুয়াত্তর বছর বয়সেও । ভাবছি, মেরে কাউকে কিছু শেখানো যায় না । এই শিক্ষাই আমার জীবনে প্রথম শিক্ষা । এখন অবশছ ‘শালা’ কেন, আরো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শব্দ স্বচ্ছন্দে বসিয়ে দিই । যেমন 

‘সারা দেশ মাগী হলে আমি তবে গডসে হয়ে যাবো।

গুলি করবি ? ফাঁসি দিবি ? আয় শালা, গুলি করে দেখ

রক্তবীজ, রক্তবীজ, ওরে শালা রক্তবীজ আমি’

এটা একটা সনেটের শেষ তিন লাইন । ছোটোবেলায় ভগবান ছিলাম । এখন ভুত হয়ে গেছি ।

মলয় : আপনি তো একা একা প্রতিদিন মদ খান বলে মনে হয় ল হুইস্কি সম্ভবত । ছয়ের দশকে আমরা যখন খালাসিটোলা, বারদুয়ারিতে মদ খেতে গেছি, তখন কখনও দেখিনি আপনাকে । আমি এখন আর দিশি মদ খাই না । মুম্বাইতে থাকার সামাজিকতার অভ্যাসের দরুন প্রতিদিন দেড় পেগ হুইস্কি খাই । নানান হুইস্কি এসেছে বাজারে । রাতে মদ না খেলে, কিছু একটা করা হয়নি, এরকম ভীতি বোধ হয়কি ? মানে, মদ কি অজুহাত হিসেবে খান ? অনেক কবি সাহিত্যিক মহলে মাতলামিকে ডিসকোর্স হিসেবে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন । অন্যান্য নেশা করেছেন ? হার্ড ড্রাগস ? ট্র্যান্স, ডিলিরিয়াম, হ্যালুশিনেশানের অভিজ্ঞতা আছে ?

কেদার : বারদুয়ারি ! রানি রাসমনির বাড়ির কাছেই । ছয়ের দশকে অবশ্যই কবিতা লিখতাম । কোনো কবির সঙ্গেই আমার আলাপ ছিল না । একেবারেই । তখনও বারদুয়ারিতে গেছি । দুচারদিন । কিন্তু খালাসিটোলা নামটা শুনেছি । ঠেকটা যে কোথায়, জানতাম না তখনও । জানার চেষ্টাও করিনি । কখনও । ১৯৭৪ সালে ‘পাথরের স্লেট’ বেরোবার পর কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত আমাকেওখানে প্রথম নিয়ে যায় । । আরে ! ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৪ ওই খালাসিটোলার পাশ দিয়ে গেছিও, এসেছি বহুবার । বুঝতেও পারিনি ওখানে এরকম একটা বিরাট ঠেক রয়েছে । আশ্চর্য । ১৯৪৫ সালে আমেরিকান সোলজারদের পাল্লায় পড়ে, কয়েকদিন জিন খেয়েছি, ক্যান বিয়ার খেয়েছি শুয়োরের মাংস ফ্রাই করে । ১৯৪৫ সালের আগস্টে যুদ্ধ তো বন্ধ হয়ে গেলল মহাযুদ্ধ । তারপর দুতিন দিন । দুএক পেগ, ফরেন । যেমন হোয়াইট হর্স, রেড লেবেল । তিন টাকা পেগ । মনে আছে । কেন খেয়েছি ? আমার তো মনে হয় মনের মধ্যে প্রেম নামক যে অদ্ভুত জীবটি আছে তারই দুপাশে দুটো ডানা গজানোর ব্যর্থতম প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয় । ১৯৫১ সালে যখন শ্রীনগর গেলাম, দেখি মিউল রাম-এর ছড়াছড়ি । তাও ফ্রি । সুতরাং অল ইন্ডিয়া ক্লাসে, যেখানে সব রাজ্যেরই ছেলে ছিল, জমাটি আড্ডা হতো । অফ ডিউটিতে ।  সুতরাং ওই শীতের মধ্যেই প্রথমে একটু-আধটু । তারপর পাঁইট পাঁইট । ভুখারিতে, মানে টিনের ফায়ার প্লেসে, মাংস গরম হতো, চাপাটি হতো, প্রায় নরক গুলজার । ১৯৫৬ সালে Fired ; চাকরি নেই, মদ খাবো কি ! বাপের হোটেল নেই ; মদ খাবো কি ! দুচারটে বড়োলোকের বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াই । তাও আবার তারা মাইনে দেয় না । উল্টে যায় । বাস ভাড়া । মদ খাবো কি ! নেশা যখন ভুলতে বসেছি, তখনই ভুল ভাঙলো। ঈশ্বর আছেন তাহলে । চাকরি মিললো । মিললেও কোনো বন্ধু নেই, কোনো প্রেম নেই, কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু দেখভাল করেন ভাগ্য । 

মলয় : আধুনিকতাবাদী তত্ব অনুযায়ী স্কুল শিক্ষকরা তো মানুষ গড়ার কারিগর । তাদের কাজ সবাইকে পিটিয়ে একইরকম মানব বানানো । তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষকরা তো এসট্যাবলিশমেন্ট নামের অক্টোপাসের বিষাক্ত শুঁড়গুলোর অন্যতম । তাহলে আপনার এমন অবস্হা কেন ? গাঙ্গুলিবাগানের এই ছোট্ট অন্ধকার ঘরে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন । শুনছি শাসক বিরোধিতার জন্য পেনশনও আটকে দিয়েছে নাকতলা হাইস্কুল । শৈলেশ্বর ঘোষকে দেখেছি গেটঅলা বড়ো বাড়ি বানিয়েছে দেবদারু গাছে ঘেরা, বইয়ের মলাটে ভিকিরির ছবি থাকলেও পনেরো হাজার টাকা খরচ করে আমাকে গালমন্দ করে পুরো একটা গাঁজাখুরি বই লিখে ফেলেছে আরেক স্কুল শিক্ষক বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে । স্কুল শিক্ষক পপদীপ চৌধুরীকেও দেখেছি রিজেন্ট পার্কের সুন্দর ফ্ল্যাটে এয়ার কাণ্ডিশানার লাগানো ; বাংলা-ইংরেজি-ফরাসি তিনটে ভাষার পত্রিকা ‘ফুঃ’ নিয়মিত প্রকাশ করে । সুভাষ ঘোষ সিপিএমের চন্দননগর লোকাল কমিটির সদস্য । কিন্তু আপনার চলেই বা কীভাবে ? এরা তো আনন্দবাজারকে এসট্যাবলিশমেন্ট চিহ্ণিত করে সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা অ্যাকাডেমি, সিপিএম, লোকাল কমিটি সবাইকে তোয়াজ তদবিরে রেখেছে । আপনি ক্ষমতাকেন্দ্রেরই বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছেন । আপনি কি ভাবছেন কথোপকথনের সময়ে যেসব আক্রমণ-আগ্রাস চালাচ্ছেন, সেগুলো মালিক বাহাদুরদের কানে পৌঁছোয় না? সারা পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষকরা যে আখের গোছানো কোম্পানি প্রায়ভেট লিমিটেড খুলেছে তার শেয়ার হোল্ডার হলেন না কেন ? কবি কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন ? কী প্রমাণ করতে চান ? আত্মনিরুপণের কোন মাত্রা ব্যাখ্যা করতে চান নিজের কাছে, পাঠকের কাছে ? নাকি রিজাইনড টু ফেট?

কেদার : এতোক্ষণে মলয় রায়চৌধুরীকে মলয় রায়চৌধুরী বলে চেনা গেল । তুমি তো জবরদখল কলোনিতে এসে  কয়েক বছর মাত্র আস্তানা গেড়েছ । কী করে জানবে জবরদখল কলোনির মানুষজনের নোংরাতম ইতিহাস ? তার মধ্যেই কাটাতে হলো । গাঙ্গুলিবাগানের সরকারি বস্তির এক চিলতে এক ঘরে। প্রায় একচল্লিশ বছর এখানে আছি । কুড়ি টাকা ভাড়া । জাস্ট কুড়ি । তাও আবার দেয় না বা দিতে পারে না ষাট শতাংশ মানুষ । তাদের মধ্যে অনেকেই অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছে, ওঠে না । বাড়ি বানিয়েছে, যায় না । মোটর সাইকেল, স্কুটার, এমনকি মোটর গাড়িও আছে অনেকের । ঘরের সামনে একটা ছোটো বাগান করেছিলাম, হাজার টাকা খরচ করে । বালতি বালতি সিমেন্টের চাঙড় তুলেছিলাম।পরিশ্রম । রঙ লাগিয়েছিলাম । আমার ঘরে তো এর আগে দুতিনবার এসেছো । লক্ষ্য করোনি বুঝি ? ওটা এখন একটা ডাস্টবিন । নোংরা ফেলছে তো ফেলছেই । ওখানেই । বোকার মতন বেশ কয়েক বছর টাকা দিয়ে পরিষ্কার করাতাম । এখন বুদ্ধির জল এসেছে মাথায় । কাজের লোককে বলেছিলাম ভেঙেটেঙে তুলে নিয়ে যা । খুঁটিগুলো, কাঠগুলো যা সব আছে নিয়ে যা । নিচ্ছে । কিছু কিছু । বেশ কয়েকদিন পরই দেখবে ফরসা । তবে আমি খুশি । বিশটাকা ভাড়ায় আর কোনো ফ্ল্যাট কলকাতায় আছে নাকি ? চব্বিশ ঘণ্টা জল, বিদ্যুৎ । এখন অবশ্য ওই বিশটাকাও সরকার নেয় না । মহানুভবতা নয় । উচ্ছেদের নোটিস দিয়েছে । কিন্তু কেউ ওঠেনি । উঠবেই বা কোথায় ? বাড়িভাড়া নিলে হাজার দুয়েক টাকা মাসে-মাসে গচ্চা । আমরা রিফিউজি না ! সোজা কথা ! এদের নাইনটিনাইন পারসেন্ট লোকও কোনো দিন পূর্ববঙ্গে থাকতে, চারতলা বাড়ি চোখেও দ্যাখেনি । আর ‘কবি কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন’? কি আর চাইবো ! দশদিন আর দশরাত্রি সমানে অনশন করেছি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে । জেলে গেছি বার বার । আর্মিতেও একবার ঢুকতে গিয়েছিলাম । পালিয়েছি । দুনম্বর এগজিবিশান রোড, পাটনা থেকে । পছন্দ হলো না । পালিয়েছি । ঢ্যাম ঢ্যাম ভি.ভি.আই.পির সঙ্গে সংঘর্ষে এসেছি । প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর টনক নড়ে গিয়েছিল । শত-শর রাজনৈতিক কারণে, তাদের মধ্যে অনেকেই, কেদার ভাদুড়ীর হাল-হকিকৎ জানিয়েছিল । অনেকে বলতে যারা আমাকে চিনতো তাদের কথাই বলছি । আমিই একমাত্র ব্যতিক্রমী পুরুষ যে একজনের নামও প্রকাশকরেনি । করলেও, ‘আর করিব না’ এই বণ্ড লিখে দিলে কর্পোরাল কেদার ভাদুড়ীর চাকরিটা অন্তত বাঁচতো । ‘কেদার ভাদুড়ী কী চাইছেন?’ আমি কিছুই চাইছি না । আমি শুধু আমার মতনই বেঁচে থাকতে চাই । আমাদের ছোটোবেলায় অলিখিত এক অনুজ্ঞা ছিল । একজনের সঙ্গে একজনই লড়তো । রাইট অর রঙ । যে জিততো, মেনে নেয়া হতো । এখন পাঁচশোজন এসে পেটায় । খুন হলে গণপ্রহারে মারা গেছে এইসব বলে । আবার ছাপ দেয়, সমাজবিরোধী । গণপ্রহারের একটা সুবিধে আছে । মামলা-টামলা হয় না । এখানে আমি অন্তত বিশ-বাইশজনকে খুন হতে দেখেছি । আমিও হতাম । হইনি । অনেকেই চুপিচুপি জ্ঞান দিয়েছে, কেটে পড়ুন মশাই, কেটে পড়ুন । তাও চুপিচুপি । পালানো জিনিসটাই তো শিখিনি কোনোদিন । ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারির ভাষায় একে বলে A successful retreat. তবুও দ্যাখি কি সুন্দর বেঁচে আছি । সোজাকথা স্পষ্টভাবে বলছি । ভাগ্যদেবীকে মানি । I believe in faith. তবে  fatalist নই । একটা ছোটো ঘটনা বলি । ১৯৬৫ সালে ফাইভে এসে ভর্তি হলো । চোখে পড়ার মতো নয় । সেই ছেলেই দেখি হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলো । হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হলে তো কোনো প্রাইজ নেই । আমি তাকে হাজরার মোড় থেকে একটা পাঁচ-ছটাকা দামের ফাউনটেন পেন কিনে ক্লাসের মধ্যে উপহার দিয়ে বসলাম । পরের দিনই একঠোঙা লজেন্স ও একটা চিঠি । লজেন্স তো বেটে দিলাম দুটো-দুটো করে ক্লাসের সব ছেলেকে । দেখলাম ওর বাবা একজন মাস্টারমশাই । মেট্রোপলিটান স্কুলের ।  ফ্রিডাম ফাইটারও । স্বাধীনতা সংগ্রামী । লিখেছেন, অনেক অনেক কথার মধ্যে একথাও লিখেছেন, “আমি বিশ্বাস করি না সমগ্র ভারতবর্ষেও আপনার মতো আর দ্বিতীয় কোনো মাস্টারমশায় আছেন।” পরবর্তীকালে দেখা গেলো, He never stood second from five to Higher Secondary. নাম অভিজিৎ গুহ । ব্যাঙ্কের ম্যানেজার । বস্তি জেলায়, উত্তরপ্রদেশে। কবি । তার একটা সনেট ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় বেরিয়েছে কয়েক সংখ্যা আগে । এটাকে কি ‘প্রাপ্তি’ বলব না ?  এই রকম বেশ কিছু প্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি । এখনও । তোফা ।

মলয় : আধুনিকতাবাদী সমাজে ডিসেন্ট অর্থাৎ মতের অনৈক্যকে নষ্ট করার প্রথম অস্ত্র হলেন স্কুল-শিক্ষকরা । যার সঙ্গে মতের মিল হচ্ছে না, সেই বালক-কিশোরকে বাধ্য-বশ্য করেন তাঁরা । বস্তুত ইংরেজরা আসার আগে নিল ডাউন বা স্ট্যাণ্ড আপ অন দি বেঞ্চ জাতীয় নির্দিষ্ট অপমানজনক শাস্তি ছিল না । স্বাভাবিক কারণে আধুনিকতাবাদের বিরোধিতায় ছাত্ররা বিভিন্ন উপায় বের করে ফেলেছে যাতে বাধ্য-বশ্য হওয়া প্রতিরোধ করা যায় । তাছাড়া শিক্ষরাও যে উত্তরআদর্শবাদী জীব, তার পরিচয় তারা পাচ্ছে অহরহ । মানব জীবনে বালক-কিশোরের প্রবেশকালীন এই সমস্যাকে কী ভাবে ট্যাকল করেছেন ? কোনও কবিতায় এই টেনশনটা দেখলুম না তো !  নাকি কবিতার জগতকে এই এলাকাটার বাইরে রাখতে চেয়েছেন ? কিন্তু কবিতার জগত তো কফিহাউস, মিডিয়া দপতর বা লিটল ম্যাগ আড্ডা নয় । আপনি তো বাংলা-ভাষাভাষি জগতের অধিবাসী । বাংলাভাষা জগতটাই তো আপনাকে পড়ছে অবিরাম । বাঙালির ভাষা-ব্রহ্মাণ্ডে শিক্ষক ও কবি কেদার ভাদুড়ী তো জীবনের অধিকাংশ তেজ আর সংসাধন খরচ করেছেন । তাহলে ?

কেদার : তুমি আর কয়টি কবিতা পড়েছ আমার ? দুশো ? পাঁচশো ? তার বেশি কখনই নয় । আমার কবিতার সংখ্যা কতো তা আমি নিজেই জানি না । বারো-চোদ্দো-পনেরো-আঠারো হাজার তো হবেই । তাহলে ? ট্যাকল করেছি ভালোবাসা দিয়ে ও বন্ধু হিসেবে মিশে । শাস্তি দিইনি তা নয় । ঢ্যামঢ্যাম বড়ো লোকদের ছেলেরা যখন উন্নতনাসা হয়ে থাকতো তখন ক্লাসরুমে এমন পিটিয়েছি যে আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হলো । কয়েকবার । একটি কেসে, মনে আছে, এক জজসাহেব মন্তব্য করেছিলেন, ‘I am biased. অন্য ঘরে মামলা নিয়ে যান মশাই ল কী করেন ? কাপড়ের ব্যবসা ? তাই করুন গিয়ে । মাস্টারমশাই পিটিয়েছে বলে মামলা ? মাস্টারমশাই ছাড়া আর কে পেটাবে ? অ্যাঁ ?’ এরকম খুচরো খবর আমি অনেক দিতে পারি । তাহলে ?

মলয় : শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায় । মানে, কবি-লেখকদের কথা বলছি আমি । তাঁরা অনেকেই, নিজেকে, পাঠকদের, আর ছাত্রদের ঠকান । যেমন ক্লাসরুমে জসীমুদ্দিন, গোলাম কুদ্দুস, কুমুদরঞ্জন প্রমুখের পক্ষে ভ্যালু-জাজমেন্ট দেন, আর লেখার সময়ে বা নিজের লেখার বৈধতা প্রমাণের জন্য ওনাদের নান্দনিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করেন । যে শিক্ষক-অধ্যাপকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঘোষণা করেন, তাঁরা সিপিএমের সভায় হাত তুলে-তুলে ইনক্লাব জিন্দাবাদ চেল্লান । অনেকে নিজেদের লেখাকে বলেন আণ্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য, আর সরকার বা অকাদেমির ল্যাজ ধরের তরে যাবার তালে থাকেন । অনেকে ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের জয়ধ্বনি করেন অথচ বাইরে পাঠকদের কাছে এঁদের ডাউনগ্রেডিঙ করেন । বুদ্ধদেব বসু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ । ওনার ‘সাহিত্যচর্চা’ প্রবন্ধে উনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, “সত্যি বলতে, মাইকেলের মহিমা বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধতম কিংবদন্তি, দুর্মরতম কুসংস্কার । কর্মফল তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে ভুল স্বর্গে, যেখানে মহত্ব নিতান্ত ধরে নেওয়া হয়, পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। আধুনিক বাঙালি পাঠক মাইকেলের রচনাবলী পড়ে এ-মীমাংসায় আসতে বাধ্য যে তাঁর নাটকাবলী অপাঠ্য এবং যে-কোনও শ্রেণীর রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য, ‘মেঘনাধবধ’ কাব্য নিস্প্রাণ, তিনটি কি চারটি বাদ দিয়ে চতুর্দশপদী পদাবলী বাগাড়ম্বর মাত্র, এমনকি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যেও জীবনের কিঞ্চিৎ লক্ষণ দেখা যায় একমাত্র তারার উক্তিতে ।” এগুলো কোনও ছাত্র পরীক্ষার খাতায় লিখলে আপনারা তাকে নির্ঘাত ফেল করিয়ে দেবেন । শিক্ষক-অধ্যাপক কবিদের এই ডুয়ালিটি বা চরিত্রে কারচুপি কেন ? নিজের সমাজ আর নিজেরকবিতাকে তাঁরা কি একই জ্ঞানপরিধির অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না । মাইকেল আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপনার অবস্হান ?

কেদার : মাইকেলের জীবনধারা আমার ভালো লাগে । গুরুর সঙ্গে গোমাংস খেতেন কিনা জানি না, ওল্ড মিশন চার্চে ধর্মান্তরের ব্যাপারটাও মেনে নিতে পারি । একদিক থেকে । রেবেকাকে ছেড়ে হেনরিয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে আসাটাও । ইংরেজি ভাষাটা ভালোই শিখেছিলেন । ট্যালেন্টেড নিঃসন্দেহে। স্কুলে, কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ওঁর বই পড়ানো না হতো, বাই ফোর্স, তবে কয়জন বাঙালি পকেটের টাকা খরচ করে বই কিনে পড়তেন জানি না । পয়ারকে ব্ল্যাংকভার্সে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সনেটকে বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছিলেন । প্রথম । মানতেই হয় । দুতিনটে সনেট ছাড়া আর সবই অপাঠ্য । বিদ্যাসাগরমশাই না থাকলে, প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর, কী যে ওতো বলা যায় না । এবারে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ । কবিতা ? আট-দশটা । গানে ? সারা জীবন ডুবে থাকা যায় । সারাটা জীবন । গল্পে ? তুলনাবিহীন । গীতাঞ্জলিতে ওঁর নোবেলপ্রাপ্তি, এখনও আমার লজ্জা হয় । গল্পেই পাওয়া উচিত ছিল । ওঁর ভাষাজ্ঞান অসাধারণ । ভাষাগত জ্ঞান, তাও অসাধারণ । গরুকে গোরু প্রথম লিখেছিলেন বলে কি যাতনাই না সহ্য করতে হয়েছিল । বাংলা ছন্দে কেউ আর ওঁর পদধূলিরও যোগ্য নয়। নির্মাণেও তাঁর কৃতিত্ব, ভাবতে বসলে আমার ব্যকরণ ভুল হয়ে যাবে । সুতরাং গুরু থেকে গুরুদেবে উত্তরণ যথার্থই । ওই সময় । ওই স্হান । ওইসব পাত্রমিত্র । ওই স্বর্ণসিংহাসনে অবস্হান করতেন বলেই, বুঝে নাও, দ্বিতীয়বার বিবাহের দিকে যাননি । এটা আমার ব্যক্তিগত মত । তাছাড়া মননে কি কাদম্বরী দেবী ছিলেন না ? ‘তুমি কি কেবলি ছবি। শুধু পটে লিখা ?’ ‘দ্রুত হাঁটছে, পা রয়েছে স্হির।’ এ ধরণের কবিতা কি লিখতে পারতেন না ? আসলে ভয় । সিংহাসনচ্যূতির ভয় । ভয়ানক ।

মলয় : আপনার ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটার ভূমিকায় বছর দশেক আগে উত্তম দাশ লিখেছিলেন যে, আপনি একজন প্রতিভা এবং এই জন্য অবহেলিত ও অবাদৃত যে, বঙ্গভূমিতে প্রতিভার বিচার ঠিক মতন হয় না । উনি এও লিখেছিলেন যে, এমন একদিন আসবে যেদিন আপনার দিকে সিংহাসন এগিয়ে দেয়া হবে । কারণ হিসেবে উনি লিখেছিলেন, ওনার কথাই বলছি হুবহু, “বাংলা কবিতায় নিজস্ব এক পঠনভঙ্গীর প্রতিষ্ঠা কেদারের স্বকীয়তার দান । তাঁর নিজস্ব উচ্চারণ গেঁথে থাকে, যাকে শব্দবন্ধ বাক্যবিন্যাস থেকে আলাদা করা যায় না ; করলে তাঁর কবিতার রহস্যই যেন হারিয়ে যায় । এজন্যে এক বিশেষ ভাষাভঙ্গী আবিষ্কার করেছেন কেদার । বাংলা কবিতার শব্দবন্ধের প্রায় বিপর্যয় থেকেই পপতীত হয় এক ভিন্ন জাতীয় অর্থবোধ।” সত্যি বলতে কি প্রতিভা জিনিসটা যে ঠিক কী, এবং কবিতা লেখার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কিনা, ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয় । আপনি অবহেলিত আর অনাদৃত সিম্পলি বিকজ আপনি আধুনিকতাবাদের প্রধান নির্দেশ মানছেন না একেবারেই । আধুনিকতাবাদী অনুশাসন অনুযায়ী প্রতিটি কবিতাকে হতে হবে একশৈলিক আর্টপিস বা শিল্প এবং তার জন্য রচনাটিকে হতে হবে গম্ভীর এলিটিস্ট একটি একক, তার সুস্পষ্ট আদি-অন্ত লজিকাল লিনিয়রিটি থাকবে । আপনি প্রতিটি কবিতাকে উপস্হাপন করছেন বাচনিক যৌগ হিসেবে, যার আদি কোনও এক অস্পষ্ট কালখণ্ডে থেকে থাকবে । প্রতিটি কবিতার প্রথম পংক্তি এবং সেই অতীত অজানা ঘটনার অনিশ্চয়তার মাঝে তৈরি স্পেসটায় পাঠককে ঠেলে দিচ্ছেন আপনি । হিন্দুদের দেবী-দেবতারা যেমন জয়দেব বা বড়ু চণ্ডিদাসের সময়ে মন্দিরে অধিষ্ঠানকালে ছিলেন আদিহীন-অন্তহীন, কিন্তু ইংরেজ আর মার্কিনীরা তাঁদের উপড়ে বা মুণ্ডু কেটে নিয়ে গিয়ে সংগ্রহালয়ে আর্টপিস বানায় । আপনি তো সীমা লঙ্ঘন করছেন, নান্দনিক সীমাকে অস্পষ্ট করে দিচ্ছেন । দ্বিতীয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার কবিতার শিরোনাম দিয়ে কবিতার কেন্দ্র বা বিষয় চিহ্ণিত হয় না । মানে, শিরোনামটা কবিতার টাইটেল হোল্ডার নয় । যার দরুণ পাঠক প্রথম পংক্তির পরও প্রবেশপথ খুঁজে বেড়ায় । আপনার ১৯৬৯ সালে পপকাশিত ‘শুকনো জল’ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি কবিতার আদরায় রয়েছে বৈশিষ্ট্যগুলো । এ-ব্যাপারে আপনি ভেবেছেন কিছু ? ভাবার দরকার মনে করেছেন ? আমার কথা যদি বলেন, আমি নিজেকে অবহেলিত বা অনাদৃত মনে করি না । কারণ আমি একজন OUTSIDER.

কেদার : আমি যখন কবিতা লিখতে শুরুকরি, তার হাজার বর্গমাইলের মধ্যেও এমন কেউ ছিল না যার কাছ থেকে আমি অণু-পরিমাণ গাইডেন্স পেতে পারি । আমার তখন ২৪ বছর বয়স, ১৯৪৯ সালে । ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি শুধু আমার মতো করেই লিখে গেছি । আমার মতো মানে আমার মধ্যে আর এক ‘আমি’ আছে । আসলে সেই লিখতো । মনে হয়েছিল, এখনও হণ, যে, আমি মানুষটা তিন জনের মিশ্রণ । বুগোর জাঁ ভালজাঁ, ডিকেন্সের কপারফিল্ড আর শরৎবাবুর ইন্দ্রনাথ । সুতরাং অভিজ্ঞতা এবং যন্ত্রণা কতো গভীর এবং কতো বিস্তৃত হতে পারে, ব্যাপক, কল্পনাও করতে পারবে না এমন একজন বাঙালি আমি । শিল্প হলো কি হলো না, আধুনিকতাবাদের প্রধান নির্দেশ মানছি কি মানছি না, এসবে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । ছিলও না । কোনোদিন । আমি কি নিজেকে অবহেলিত বা অনাদৃত মনে করি ? একেবারেই না । আমারই কবিতা অন্যের নামে ছাপিয়ে দিয়ে দেখলাম, কাব্যগ্রন্হটির মধ্যে ওটাই, সমালোচকদের মতে, ওটাই দ্য ভেরি বেস্ট ।এরকম আরো একটা । একটি মেয়ের নামে শতকার ৯৯.৯শতাংশ লেখা একটা কবিতা পাঠিয়ে দিয়ে দেখি বড়ো বড়ো ম্যাগাজিন থেকে সম্পাদকদের বিনীত অনুরোধ আসছে, এই তো লেখা ! এমন লেখা চাই । চাই-ই । অনেক কলেজের অধ্যক্ষরা জানিয়েছেন, লিখিত জানিয়েছেন, ভাদুড়ী ইজ গ্রেট, শিয়োরলি গ্রেট । চাকরি ছেড়ে দিয়ে আপনার পেছনে চব্বিশ ঘণ্টাই আমার ঘোরা উচিত, জানা উচিত কী করে লেখেন এসব কবিতা ! ভারত কাঁপানো কোনো পুরস্কার পাইনি বটে, শত শত ছেলের ভালোবাসা পেয়েছি । কবিতায় আকৃষ্ট করেছি। এও কি কম কিছু ? আমি মনে করি কোনো কবিতারই কোনো শিরোনাম যথাযথ হতে পারে না । নাম্বার দেওয়া উচিত । শেক্সপিয়র যেমন দিয়েছেন ১,২,৩…। নামও দেওয়া উচিত নয় । গাড়িতে যেমন নাম্বার থাকে অনেকটা তেমনি । কে শক্তি, কে সুনীল, কে জয়, কে মলয়, আর কেই বা উত্তম কেউ জানলো না । বোঝা যেতো তখন ব্যাপারটা । আর পঠনভঙ্গীর কথা ? এমন সব কবিতা আছে আমার, আমি ছাড়া আর কেউ ঠিক মতো পড়তে পারবে না । পারে না । দেখেছি । একবার ঋষিণ মিত্র আমার এক কবিতায় সুরারোপ করেছিল । তখন বুঝেছি কবিতাও মার্ডার হতে পারে । বলিনি, কিছুই বলিনি । কেননা এমন কোনো আদালত নেই যেখানে এই খুনের মামলার বিচার হবে । একটা কবিতা যখন একবার পড়েই লোকে বুঝে যায় তখন বাঁদরামির নীল ইতিহাস আমার জানা হয়ে যায় । এছাড়া আর যা-যা বলছ, মানছি । আসলে কবিতা তো মেয়েমানুষ। যদি সুন্দরী হয় তো কথাই নেই । হাজার দৃষ্টিকোণ থেকে হাজার লোক হাজার ভাবে নিতে পারে । নেয়ও । তাই না ?

মলয় : আধুনিকতাবাদী অনুশাসন অনুযায়ী প্রতিটি কবিতার একটি বিষয়কেন্দ্র থাকা দরকার, অনেকটা সাম্রাজ্যবাদে সম্রাটের মতন, বা রাষ্ট্রের রাজধানির শাসনের মতন । তার ভাব, অর্থাৎ ক্ষমতাকেন্দ্রটির ভাব, এমন হবে যে তাকে সম্প্রসারিত করা যাবে, সাম্রাজ্যবাদের বা নয়া-ঔপনিবেশিকতার বিস্তারের মতন ।এই ভাবটি আবার অপরিবর্তনীয়, সব্বাইকে তা মেনে নিতে হবে, শাসকের হুকুমের মতন । অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিরোনামটির সাহায্যে আধুনিকতাবাদী কবি তাঁর ক্ষমতাকেন্দ্রটি চিহ্ণিত করতেন, সম্রাটের মুকুট বা দেশনেতার হোয়াইট হাউস-ক্রেমলিনের মতন। আপনার কবিতায়, অধিকাংশ কবিতায়, অমন বিষয়কেন্দ্রের উপস্হিতি নজরে পড়ে না । দ্বিতীয়ত, কবিতার যেটুকু ভাব আঁচ করা যায়, তার সঙ্গে শিরোনামের মিল সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না । তৃতীয়ত, প্রকরণকৌশলের ফুর্তিবাজ বাচনিকতার কারণে, ভাবের ওটুকু রেশও ডিসপ্লেসড হয়ে যায় । অর্থাৎ, চালু সার্কলে আপনার স্বীকৃতি না পাওয়ার এ-ও এক কারণ । কেননা, কবিতা যে ভাববিশেষের যৌক্তিক রূপ হিসেবে না-ও উপস্হিত করতে পরেন কবি, আর কেন্দ্রটির বহুবিধ ট্যানজেন্ট রূপে তাকে গড়তে পারেন, তা আপনি কবিতার পর কবিতায় দেখিয়ে যাচ্ছেন । কিন্তু তা সত্বেও আধুনিকতাবাদীরা আপনাকে শৈলীনির্মাতা বলে মানছেন না । শৈলী বা ব্র্যাণ্ডিঙ -এর শিরোপা এই জন্য দেয়া হচ্ছে না যে, একটা কবিতা, পাঠকের কাছে ওয়ান মর্সেল ভোগ্য কমোডিটি হয়ে উঠতে পারছে না । কমোডিটি না হলে ব্র্যান্ডিঙ হয় না । জানি না এ-ব্যাপারগুলো ভেবেছেন কি না । মঙ্গলকাব্য বা পদাবলী রচয়িতাদের ব্র্যাণ্ডিঙ সম্ভব ছিল না । লক্ষ্য করবেন যে তাঁদের কাব্য ইষ্টদেবতায় নিবেদিত বা কোনও দেবী বা দেবতার স্বপ্নাদেশে লেখা । রচনার অথরিটির উৎস ছিলেন সেই দেবী বা দেবতা, লেখক নিজে নয় । আধুনিকতাবাদে লেখক  হয়ে উঠলেন নিজেই নিজের লেখার অথরিটি । মানে, একটা কবিতার বিষয়কেন্দ্রের, যে কেন্দ্রটি থেকে আবার উৎসারিত মানে অপরিবর্তনীয়, তার নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে উঠলেন । আধুনিকতাবাদী কোকেন হেরোইনে অভ্যস্ত পাঠক বা সমালোচক, যদি দেখেন যে তাঁর কাঙ্খিত কেন্দ্রটি নেই, তাহলে আপনার কবিতা সম্পর্কে মিডিয়া-অকাদেমি-সরকারের কর্তাদের উইথড্রল সিম্পটমকে দোষ দেয়া যায় না । কেন্দ্রটিকে শক্ত-সমর্থ করার জন্য পংক্তির পর পংক্তি বসিয়ে রেললাইন বরাবর কবি লজিকালি শেষ পংক্তিতে পৌঁছোন । সাধারণত আধুনিকতাবাদী কবিতায় সেটাই টারমিনাস । আপনার কবিতা সেভাবে টার্মিনেট করে না । এমনকি ফুর্তি বজায় রেখে পরের কবিতায় চলে যাওয়া যায়, একের পর এক কবিতায়, আহ্লাদের ব্যাপক গেমপ্ল্যানের দরুন । আপনি এব্যাপারে নিজের দিকটা একটু বলুন ।  আমার সঙ্গে অ্যাগ্রি করার দরকার নেই ।

কেদার : ধরো, যারা আছে তারা সবাই মরেছে । ধরো, ওই সময় বা ওরও বেশি, ৫০ কি ৬০, ধরো, আর, যদি আমি আমার অপ্রকাশিত কিছুটাও প্রকাশ করে যেতে পারি তাহলে মূল্যায়ন জিনিসটার তখনি মূল্যায়ন হতে পারে । কবি জীবনানন্দের জীবনে অনেকটা তাই ঘটেছে । আমার বিশেষভাবে ভালো-লাগা একটা কবিতা, ‘আট বছর আগের একদিন’ পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক সুধীন দত্তসাহেব ছাপেননি । বলেছিলেন, ওটা কবিতাই হয়নি । ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর হাত দিয়ে । আর আহ্লাদ বলছ ? ফুর্তি বলছ ? কই, আমি দেখি না তো ! চোখের জলের টসটসানি দেখোনি কি কোনোদিন ? আমারই দুর্ভাগ্য ! ব্যাস, আমার জবাব হয়ে গেল ।

কেদার ভাদুড়ীর কয়েকটি কবিতা

হঠাৎ পুস্পিতা

………………….

হঠাৎ পুষ্পিতা এসে বললো‌: দেখুন স্যার,

আমাকে না জানিয়ে অনেকেই প্রপোজ করে, কি করি?

বললাম‌: করবেই তো

মেয়েরা প্রপোজিত হবে, তবেই না মেয়ে !

পুষ্পিতা কি এমনই হয়েছো?

ভ্রুণ থেকে ভ্রুণাতীত, জন্ম থেকে জন্মাতীত তুমি

প্রজাপতি আসুক, কী আছে !

একদিকে প্রজা, অন্যদিকে পতি, দ্বৈতবাদ, সেইতো সুন্দর।

পুষ্পিতা বললো, কি কথা ! অনন্য। অন্যতর স্বাদ।

তখুনি ঘরে ঢুকলো একফালি অন্ধকার, একফালি পোড়-খাওয়া পূ্র্ণিমার চাঁদ।

___________

চুমো কনজিউমার গুডস্

……………………………..

বাবা বলেছিলেন, অত গল্প পড়িস কেন, খোকন?

সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে মেশ, দেখবি গায়ে গল্প লেখা থাকে।

সেই থেকে আজতক আমি গোগোল পড়িনি

সেই থেকে আজতক আমি জ্যাক লন্ডন

সেই থেকে আজতক আমি টেগোরের গল্পগুলো

চেকভের গল্পগুলো লু শ্যুনের গল্পগুলো মোপাসাঁ ইস্তক।

শুধু একবার চুরি করে ভিক্টর হুগোর গল্প

সেই-যে-সেই ছেলেটি, দ্বীপের মেয়েটি,জাহাজডুবি……….

যাচ্চলে, মনে নেই।

মনে থাকে কি কখনো এইসব বাঁদরের, ইঁদুরের গল্প?

রোমানফ কী বলেন? টলস্টয়? আনাতোল কী বলেন? ডুমা?

বৃদ্ধ মানুষটি এবং সমুদ্রের গল্প লিখে যে ছেলেটি গুলি খেলো, সেও

রেমারএ কী বলেন? টুর্গেনিভ কী বলেন? মম?

খেজুরগাছের দেশে মাদী চিতাবাঘের পাল্লায় টুঁটিকাটা ছাড়া

উপায় থাকে না।

উপায় কি থাকে না কখনো? আমি শুধু দুটি, দুটি মাত্র স্টেট এক্সপ্রেস খাইয়ে

রুশী মেয়েটির গায়ে গল্প পেয়েছিলুম, দু’গালে দ? চুমো।

_____________

একটি চুমোর জন্য আমি

…………………………….

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি রাজত্ব ছেড়েছি

রাঁধুনীকে বলি আমি, আহা গিন্নি রান্নাঘর দেখ

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি সাম্রাজ্য ছেড়েছি

ধোপানীকে বলি আমি, আহা গিন্নি স্নানঘরে যাও

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি সাম্রাজ্য বেচেছি

চাকরাণীকে বলি আমি, আহা গিন্নি ঘরদোর মোছো

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি রাজত্ব ছেড়েছি

সেবিকাকে বলি আমি, আহা গিন্নি মাথা টেপো দেখি

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি অপমানি হব

রক্ষিতাকে বলি আমি, আহা গিন্নি আলোটা নিবাও

তোমার একটি চুমুর জন্য আমি অপমানি হব

বিয়োনিকে বলি আমি, আহা গিন্নী গর্ভবতী হও

তোমার একটি চুমোর জন্য আমি মৃত্যুমুখি হব

রাজত্ব সাম্রাজ্য ছেড়ে আমি নরকে পৌঁছবো

___________

মোহ

…….

চারিদিকে বৃক্ষ অগুনতি। তারই একটা হেভেনলি ফ্লেইম,

ফ্লেইম? না ইনফার্নো?এই জেনে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে

ইন্ডিয়ান লেবার নামের, পাশে লুকিয়ে হঠাৎ……….

হঠাৎ্ই শুনতে হ’লো সেই স্বর, বাংলায়‌: অসভ্য!বাঁদর!

মাধোরায়, গুর্জরদেশের এই মন্দিরের পাশে

যে অরণ্য আছে সহস্র শিল্পের, শিল্পের কর্মের,

নবম কি একাদশ শতকের, আমি শুধু তার

স্তনের উজ্বল মসৃণতা দেখেছিলুম ব’লেই

হাত দিয়ে, বাঁ হাত দিয়ে, ছুঁয়ে, মসৃণতা

দেথেছিলুম ব’লেই শুনতে হ’লো সেই স্বর বাংলায়‌: অসভ্য, বাঁদর!

কিন্তু বাংলায় কেন? গুর্জরদেশের ভাষা ওকি ভুলে গেছে, মেয়ে?

উৎকল দেশেও তাই, একবার, কোনারক, সূর্যের মন্দিরে,

বিজয়নগরে, কেশব মন্দিরে, মদনিকা, আর্শিতে যখন

মুখ দেখেছিলো একা, হঠাৎ তখুনি স্তনে হাত রেখেছিলুম ব’লেই………

আহা, মামাল্লাপুরমেও তা। লালচে, কালো, সাদা পাথুরে মেয়েরা

ভাবতে ভাবতে লজ্জা, না লজ্জা নয়, শরমে মরে যাই শুধু।

কেননা, আমার ভিতরে যে মেয়ে থাকে, চুল বাঁধে, নাচে, গায়

স্তনে সর মেখে শুয়ে থাকে, উপন্যাস পড়ে, পিয়ানো বাজায়,

পার্টিতে চিকেন স্যুপ খায়, হরিদ্বারে গিয়ে পিদিম জ্বালিয়ে

পিতৃপুরুষের দায়ে একবার ভাসিয়েছিলো গঙ্গায়, সেই।

___________

অনিবার্যকারণবশত

…………………………..

অনিবার্যকারণবশত

আমি কাল দিব্য আঁধারে গাছের তলায় দাঁড়াতে পারিনি রাধে।

বেলগাছে ভূত থাকে, থাকেনা কি? ব্রহ্মদত্যি, এ কথা তো জানা,

কিন্তু যেটা জানা ছিলোনা তা’হলো তার পক্ক বিম্বাধর ফল, লোভ

পয়োধরা তুমি, পয়স্বিনী, অববাহিকায় আছো।

থাকো, কিন্তু ক্ষমা করবে তো, বলো? অনিবার্যকারণবশত

তুমিও তো একদিন এইদিন এতোদিন, আহা—

অনিবার্যকা-র-ণ-ব-শ-তঃ।

___________

লিপস্টিক

……………

আমি এক গো-পন্ডিতের মতোই বুরবাক।

ছেলেরা চুল কাটে

মেয়েরা চুল রাখে, কেন?

ছেলেরা ধুতি পরে

মেয়েরা শাড়ি পরে, কেন?

ছেলেরা দেড় মিটারের জামা পরে।

মেয়েরা কোয়ার্টার মিটারের

জামা পরে কেন?

রহস্য বুঝিনি।

___________

এইসব ব্রতকথা

……………………

এতদিন আমি তাই ছিন্ন কন্থা সোহাগে ভরেছি

দুধেল ওয়ারে যেন, ভারতীয় রিঠে দিয়ে কাচা।

কে বানিয়েছিল, বুনেছিলো ঘুঘুসই চিত্র দিয়ে?

দেবযানী? শাড়ির সবুজ সুতো লাল সুতো নীল

উঠিয়ে উঠিয়ে? ধৈর্যের পুরাণ থেকে নাদব্রহ্ম

শুনে শুনঅ? ছুঁচ তার কতবার ফুটে গেছে, ব্যথা,

আঙুলের অগ্রভাগে রক্তবিন্দু চুষে নিয়ে শে্ষে

হেসেছিলো মৃদু জ্যোৎস্না, তালপাতা শুয়েছিলো পায়ে।

এইসব ব্রতকথা শতাব্দীর শুরু হ’তে শেষ।

এখন? চন্দনা নদীটির কাছে কোনো ঘর একা

দাঁড়িয়ে থাকেনা দেখি, কদলীবৃক্ষের মাথা, ভ্রাতঃ

দোলেনা বাতাসনির্ভর, বলেনা চন্দনা নদীটি

কবে বুঁজে গেছে, মেঠো ঘেরি সরে গেছে, মেছুয়ারা

ভাটিয়ালি ভুলে গেছে, সুজন নাইয়া আজ কই?

____________

ক্যাপ্টেনের নাম কেন্ রবিনসন

………………………………………

বাংলা বলতে জানেন হিন্দিও

চোস্ত উর্দুতে কথা বললে বোঝাই যায় না

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান

ক্র্যাক পাইলট বলে তাঁর নাম আছে

এয়ার পকেট পেলেও

বাম্প করে না তাঁর কাইট—

ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর

শুক্কুরবারের ফ্লাইটে তাঁর কায়রো যাবার কথা

মাঝখানে কুয়ায়েত

নাবতে হবে

কাইটে পেট্রোল ভরা হয়ে গেছে

থাউজেন্ডস্

অ্যান্ড থাউজেন্ডস্ অব লিটারস্

হান্ড্রেড অকটিন

এখন এখন শুধু

ফ্লাইং কনট্রোল থেকে সিগন্যাল স্রেফ বাকি

রেডি থামস্ আপ

একটা টিহি-টিহুউউ শব্দ করে জেট

ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর উড়ে গেল

তিরিশ নম্বর সীটে তিরিকলাল বললেন

আপেলের রস

তেত্রিশ নম্বর সীটে বাচ্চা ছেলেটা

বমি করল

এয়ার হোস্টেস মিস স্যানিয়াল

অদ্ভুত তৎপরতায়

বমি আর আপেলের রস

সামাল দিয়ে উঠল

ককপিটে তখন কেন রবিনসন

কো-পাইলটকে বললেন

হোলড্ দ্য জয়স্টিক

ড্রাইভ স্ট্রেট অ্যাহেড

তারপর

আরব সাগরের সবটুকু ব্লু ক’রে

স্কাইকে স্কাই ক’রে ফরেনসিক

ইন্টারকমে বললেন, মিস স্যানিয়াল

সী মি অ্যাট ওয়ানস্

বমি আর আপেলের রস

ব মি আ র আ পে লে র র স

মিস স্যানিয়াল ইন্টারকমেই উত্তর দিলেন

স্যর, আয়াম অফুলি বিজি, অফুলি……….

তিন মিনিটে তিন ক্যান

ফরাসী শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে

কেন্ রবিনসন

গকগক্ করে দরজা খুললেন

গকগক করে লাফিয়ে পড়লেন

উইদাউটা প্যারাশুট

ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর উড়ে গেল

নিচে নীল সমুদ্র

সবুজ আয়নার মতো ছড়িয়ে আছে

দিগদিগন্ত

কেন্ নাবতে লাগলেন

একটা শকুন এসে বলল

হাই, মে আই ইট ইনটু ইউ

কেনের টিউনিক উড়ে গেল

একটা চিল এসে বলল

লুক্ দিসিজ হাউ উই সুপ

কেনের ট্রাউজার্স খুলে গেল

বাজপাখি যে বাজপাখি

দ্য ডিউফল হক্

সেও বলল

কাম্ অন্, টেক আউট ইয়োর

আন্ডার ভেস্টস, উইল ইউ

কেন্ ন্যাংটো হয়ে গেল

সূর্য তখন ডুবুডুবু ডুবছে

চাঁদ তখন উবুউবু উঠছে

ঠিক তখনি

বিশ হাজার ফিট নিচে সমুদ্রের বুকে

বিশ ফুট জল লাফিয়ে উঠল

বলল, কাম্ ইন চাম, কাম্ ইন

দু-ফিট সমুদ্রের তলে

দুটো সার্ডিন খেলা করছিল

একজন আরেকজনকে চোখ টিপে বলল

দেখেছে

তিন ফিট সমুদ্রের তলে

তিনটে হেরিং তিনশো মালিক তাড়া করছিল

একটু দাঁড়াল

তারপর তার চোখে এইসা ঢুঁ মারল যে

চোখ গলে গেল

পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা অক্টোপাস

শুঁড়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল

আ উইন্ডফল

পৃথিবীর মাটি

পৃথিবীর আকাশ জল

টলটল করলেও

সময়ে সময়ে টলোমল

পরদিন খবরের কাগজে বরুল

দ্য পাইলট অব দ্য ডি.সি. ফোর হান্ড্রেড ফোর

ওয়াজ হাইজ্যাকট ইন দ্য মিড এয়ার

আমরা ফ্লাইং সসারের কথা

ভাবতে বসলুম

কেউ জানল না

কেউ জানল না কেউ

শুধু আমিই জানলুম—

দ্য কো-পাইলট

আমিই জানলুম

আ উইন্ডফল

মিস স্যানিয়াল এখন

আঃ আমিই জানলুম

আ উইন্ডফল

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

নিজের সাক্ষাৎকার নিজে নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরীর আত্মসাক্ষাৎকার

( এই সাক্ষাৎকারের ধারণাটি ‘দাহপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক কমলকুমার দত্তর । তিনিই প্রস্তাব দেন যে নিজের সঙ্গে নিজে কারোর সাক্ষাৎকার নেবার নজির সম্ভবত বাংলায় নেই । মলয় রায়চৌধুরীকে তিনি প্রস্তাব দেন যে তিনি নিজের সঙ্গে নিজের একটি সাক্ষাৎকার তৈরি করুন যা তাঁর লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবে । তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি সাহিত্যিক মহলে অভাবনীয় সাড়া ফেলেছিল ।কারণ এই ধরণের সাক্ষাৎকার বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম । সে-কারণে ২০০৪ সালের কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় তিনি এটি গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেন । এখানে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি তুলে দেয়া হল । )

প্রশ্ন: তুমি তো বহু সাহিত্য পত্রিকায় ইনটারভিউ দিয়েছ । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে দিয়েছ । বহির্বাংলার বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে দিয়েছ। পোস্টমডার্ন সাহিত্যভাবনা সম্পর্কে দিয়েছ । ইংরেজি আর হিন্দি পত্রিকায় দিয়েছ । চাকরি পাবার জন্যে, চাকরিতে পদোন্নতির জন্যে দিয়েছ । তাছাড়া তুমি স্বদেশ সেন, কার্তিক লাহিড়ি, দীপঙ্কর দত্ত আর সুবিমল বসাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছ । যখন তুমি রায়বরেলি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আর ফয়জাবাদ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ডায়রেক্টর ছিলে, তখন তুমি ক্লার্ক আর অফিসার পদে কর্মী নিয়োগের ইন্টারভিউ নিতে । সাক্ষাৎকার দেবার আর নেবার বহুস্তরীয় অভিজ্ঞতা তোমার হয়েছে । এখন কেউ যদি তোমাকে বলেন যে তুমি নিজের একটা সাক্ষাৎকার নাও, কিংবা তুমি নিজেকে একটা ইন্টারভিউ দাও, তাহলে তোমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? তোমার মনের মধ্যে যা ঘটতে থাকবে, তা তুমি কীভাবে সামাল দেবে ?

উত্তর: বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারগুলো, যিনি বা যাঁরা সাক্ষা৭কারগুলো নিয়েছেন, তা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থন যোগাবার জন্যে নেওয়া, বিশেষ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে যে সাক্ষাৎকারগুলো তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা নিয়েছেন, সেগুলো । প্রায় সবই মোটিভেটেদ । সকলেই মোটামুটি একটা হাংরি ইমেজ নির্মাণ বা অবিনির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত আমার লেখাপত্র সম্পর্কে কোনোও বিশ্লেষণভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেননি তাঁরা । অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা সাক্ষাৎকার নেবার জন্যে আমার বইটই পড়ে নিজেদের প্রস্তুত করেননি । আমার ডিসকোর্সের পরিবর্তে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা নিজেদের ডিসকোর্সকে জায়গা করে দিতে চেয়েছেন ।ম পোস্টমডার্ন ভাবনা নিয়ে যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি জানার জন্যে, এবং পাঠকদের সঙ্গে বিষয়টির পরিচয় করাবার জন্যে নিয়েছেন । সাকআৎকার কীভাবে নেয়া উচিত, তা স্পষ্ট করে দেবার জন্যেই আমি কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলুম । তবে, বহুল-প্রচারিতদের সাক্ষাৎকার আমি নিইনি, কেননা তাঁরা মিথ্যায় গড়া সাবজেক্ট-পজিশানের কারবার করেন । গ্রামীণ ব্যাঙ্ক দুটোর কর্মী নিয়োগের জন্যে ইন্টারভিউ নেবার জন্যে আমায় নিজেকে পড়াশুনা করে যোগ্য করে তুলতে হয়েছিল । এখন তুমি যেই বললে নিজেই নিজের সাক্ষাৎকার নেবার কথা, আমার মনে হল, ব্যাপারটা অ্যাবসার্ড, কেননা যে নিচ্ছে তার এবং যে দিচ্ছে তার, এই স্হিতিটা তো দুটি সাবজেক্ট পোজিশানের বাইনারি অপোজিট নয় । একাধিক সাবজেক্ট পোজিশান রয়েছে, এবং প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে, যে-অবস্হায় এক্সটেমপোর জিনিস বেরোতে পারে বলে মনে হয় না । ব্যাপারটা আমার কাছে ওই সাবজেক্ট পোজিশানগুলোর ওপনিং আপ প্রক্রয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে । সমস্যা হল যে, এই ওপনিং আপ তো বিশাল, তাকে তো কিছুক্ষণ বা কয়েকদিনের চিন্তা পরিসরে ছকে ফেলা যাবে না । তার ওপর, যাকে দ্বিপাক্ষিক ডিসকোর্স হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তার মধ্যে দুটি পক্ষই এমনভাবে গড়ে উঠতে পরে যে, সাক্ষাৎকারের বদলে তা হয়ে দাঁড়াবে আত্ম-বিশ্লেষণ । ফলে সাক্ষাৎকারের genreটাকে subvert করে ফেলা হবে । তার মানে, একটা formless সাহিত্য-সংরূপ চাগিয়ে উঠবে, যাকে define করা কঠিন । বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক যাকে বলেছেন বুদ্ধিমত্তার manifest শেষাবধি সেরকম একটা আদল-আদরা পাবে ।Syncretism দিয়ে সামাল দিতে হবে, যে প্রক্রিয়ায় জীবনের সবকিছু সামাল দিচ্ছি ।

প্রশ্ন: মাঝে-মাঝে অফিসের কাজে তুমি মুম্বাই থেকে পশ্চিমবাংলায় আসতে । পঁয়ত্রিশ বছর পরে পাকাপাকি কলকাতায় থাকতে এসে তোমার মনখারাপ হয়ে গেল কেন? তোমার আত্মীয় পরিজন, সাবর্ণ চৌধুরী ক্ল্যান, বন্ধুবান্ধব, সবায়ের সঙ্গে আবার দাখাসাক্ষাৎ হল, পাণিহাটি-কোন্নোগর-উত্তরপাড়ার কৈশোরের সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে দেখা হল, তা সত্বেও তোমার মন কেন পীড়িত বোধ করতে লাগল ? মনে হল যে তোমার মস্তিষ্কের মধ্যে আবাল্য লালিত দেশের বাড়িতে তুমি ফেরোনি ?যেখানে ফিরেছ, তা অন্য ভূখণ্ড ? যাদের মাঝে ফিরেছ, তারা সম্পূর্ণ অন্য লোক ? যা লাগবে বলবেন কাব্যগ্রন্হে তুমি এই মননস্হিতি আর্টিকুলেট করলে, কিন্তু বুঝতে পারলে যে, যাদের পক্ষে ওই পাঠকৃতি প্রবেশযোগ্য ছিল, সেই আদি ভূমিজ পশ্চিমবঙ্গবাসী নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে ? এই পীড়া তো নিরাময়ের অতীত ! কী করবে তুমি?

উত্তর: আমার এই দেশাত্মবোধ এতই বিমূর্ত আর জটিল যে, অনেক সময়ে আমার মনে হয়, আমার পীড়া আমারই সৃষ্ট । এ-জিনিসটা দেখনসই বাঙালিয়ানা নয় । কিংবা এমনটাও নয় যা আমার আত্মীয়-জ্ঞাতিরা বলে থাকেন, যে, রিফিউজিরা এসে আমাদের পশ্চিমবাংলাকে ধ্বংস করে দিলে । বস্তুত অন্য শব্দ না পেয়ে আমি দেশাত্মবোধ শব্দটা প্রয়োগ করছি । পাকাপাকি ফিরে আসার পর, মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে মুম্বাইতে বা মেয়ের কাছে আহমেদাবাদে যাই, আমি বুঝতে পারি, আমি এই পীড়া নিজের সঙ্গে নিয়ে বেড়াই । জলাঞ্জলি উপন্যাসের শেষার্ধে এবং নামগন্ধ উপন্যাসে ধরার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু বোধটা এমনই অ্যাবসট্র্যাক্ট যে অনায়ত্ত রয়ে গেল । ব্যাপারটা পারক্য, এলিয়েনেশন, একাকীত্ব, মন ভালো নেই ধাঁচের নয় । অ্যানুই নয় । একে শেয়ারও করা যায় না । আমার মনে হয় মুম্বাই থেকে মাঝে-মধ্যে পশ্চিমবাংলায় অফিসের কাজে আসার সময়ে আমি এই পীঢ়া-বোধটা পিক আপ করেছি । বাঙালির সঙ্গে বাঙালি মন খুলে কথা বলে না টের পাবার পর আমি এম আর চোওধারি হয়ে হিন্দি আর ইংরেজিতে কথা বলতুম । মুর্শিদাবাদ-মালদা জেলায় উর্দুভাষী মুসলমানের মতন কথা বলেছি । দাড়ি রাখার সূত্রপাত এই ক্যামোফ্লেজের প্রয়োজন মেটাতে । সাহিত্যিকদের সঙ্গে পারতপক্ষে মেলামেশা করতুম না । কেউ আমায় চিনত না বলে অসুবিধা হয়নি । এলডিবির ম্যানেজিং ডায়রেক্টর প্রত্যুষপ্রসূন ঘোষ আমার পাশে বসে সরকারি মিটিঙেও জানতে পারেননি । আর কোনও কবি বা লেখক এই পীড়ায় আক্রান্ত কি না জানি না । এ কোনোও অসুখ নয় । একজনকে গভীর ভালোবাসতুম, অথচ এখন দেখে আর তার সঙ্গে বাস করে, বুঝতে পারছি না সে-ই কি না, অথচ তার কাছেই তো এসেছি । বাইরে না গিয়ে টানা এখানে থেকে গেলে এরকমটা হতো না হয়তো । যাঁরা সেই তখন থেকে পশ্চিমবাংলার সাথাসাথা মেটামরফোজড হয়েছেন, বা মেটামরফোসিস প্রক্রিয়াটিতে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের এই পীড়ার বোধটা জন্মায়নি । না লেখকদের, না আলোচকদের । আমার তাই সন্দেহ থেকে যায় যে আমার পাঠকৃতি আর পাঠক-আলোচকদের মাঝে ওই পীড়া একটা অনচ্ছ দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো ? কেননা, এমনিতেই আমার পাঠকৃতির আগেই আমার ইমেজ—কালীকৃষ্ণ গুহের কাছে একরকম, অনিকেত পাত্রের কাছে একরকম, আবার নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে আরেকরকম—পাঠকের কাছে পৌঁছে ভ্যারিয়েবল ইন্টারপ্রিটেশনের সম্ভাবনা গড়ে ফ্যালে, যা আসলে পাঠকের নিজের চাহিদা মেটাবার জন্যে । পাঠকৃতির উদ্দেশে নয় । সম্ভবত গ্রহণ-বর্জনের বৈভিন্ন্যের নিরন্তর টানাপোড়েনে পাঠকৃতি-বিশেষ তার নিজের পরিসর অহরহ গড়ে নিতে থাকে । তার কিনারায় গালে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া আমের কিছু করার নেই ।

প্রশ্ন: তুমি তোমার কবিতা অনুশীলনে ফর্ম, কনটেন্ট, মিঊজিকালিটি এসব নিয়ে প্রথম থেকেই ভেবেছ কী? এগুলো আলাদা-আলাদা ভেবেছ কী ? নাকি একটা কবিতাকে এককসমগ্র উৎসার ভেবে ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠতে দিয়েছ? প্রশ্নটা এই জন্যে করতে হল যে একটা একঘেয়ে আদল না থাকলে সেই কবির কাজগুলোর একঘেয়েমির ছাপ পাঠকের মগজে বসতে পারে না বলে পাঠক তোমার কাব্যজগত সম্পর্কে পাকাপাকি ধারণা তৈরি করার বদলে কনফিউজড হয়ে যান । রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল, বিষ্ণু দে, সমর সেন, আলোক সরকার, যাঁর কবিতার দিকে তাকাও, দেখবে যে তাঁরা অনুশীলনের মাধ্যমে নিজস্ব একঘেয়েমি গড়ে তুলেছেন যার ছাঁচে তাঁদের যে কোনোও কাব্যিক ডিসকোর্স ঢালাই করে দিয়েছেন । অথচ তোমার প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ থেকে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ জখম একেবারে আলাদা । তারপর প্রকাশিত হল মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর যার সঙ্গে সামান্যতম মিল নেই জখম কাব্যগ্রন্হের । এরপর বেরোল হাততালি, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর বইটার কবিতাগুলো থেকে । তোমার সাম্প্রতিক কৌণপের লুচিমাংস পর্যন্ত এই ব্যাপারটা লক্ষ করা গেছে । সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা দখলের জন্যে প্রধান ব্যাপার হল একঘেয়েমি, যাকে ইউরোপে বলা হয়েছে কবির মৌলিক শৈলী । সর্বজনস্বীকৃত সেই পথ অগ্রাহ্য করে তুমি ভুল করে যাচ্ছ না কি ?

উত্তর: ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে আমাদের সংস্কৃত শিক্ষক বলেছিলেন, “আরে ইংরেজদের বুকে অত দম আছে নাকি যে বেদ-উপনিষদের মতন শ্লোক লিখবে বা গীতা মতন কাব্য লিখবে ? শিতের দেশের লোক, চান-টান করে না, একটুতেই দম ফুরিয়ে যায় বলে অমন কবিতা লেখে, যেন ছুটতে ছুটতে দম নিচ্ছে ।” কালিদাসের আড়াল নিয়ে তুমুল আক্রমণ করতেন টেনিসন, কীটস, শেলি প্রমুখকে । তখন অত না বুঝলেও, ব্যাপারটা আমার মাথায় থেকে গিয়েছিল । যখন কবিতা লেখা আরম্ভ করলুম, গোগ্রাস বইপোকা ছিলুম বলে, য়েশ পড়াশোনা করে ফেলতে পেরেছিলুম যাতে পয়ার ফাটিয়ে বেরোতে পারি । আমার মনে হয়, কবিতায় একঘেয়েমি বজায় রাখার জণভে একটা টিপিকাল বাল্যকালীন আত্মপরিচিতির সঙ্গীতজগত দরকার হয়, যা অগ্রজ বাঠালি কবিদের মতন আমার ছিল না । দাদারও ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি, জানোয়ার এবং আমার ভিয়েতনাম কাব্যগ্রন্হ তিনটের মধ্যে একঘেয়েমির মিল নেই, যা দাদার বন্ধু দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপধ্যায় প্রমুখের কবিতায় আছে । বিহারিপাড়ার অন্ত্যজ লোকসঙ্গীত, শিয়া মুসলমানদের গজল, নাথ, কাওয়ালি, মিশনারি স্কুলে চার্চ কয়্যার, রামমোহন রায় সেমিনারিতে ব্রাহ্মসংগীত, বাবার দোকানের কর্মী ডাবরের রহিম-দাদু-কবীর, বাড়ির কাজের লোক শিউনন্নির রামচরিতমানস, বঢ়জ্যাঠার আঙুরবালা-শু্ভলক্ষ্মী, বড়দি-ছোড়দির খেয়াল-ঠুমরি, জ্যাঠাইমার নানারকম পাঁচালিগান, সতীশকাকার চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে মন্ত্রৌচ্চারণ, এই পলিমরফাস মিউজিকালিটিতে আমার বাল্যকাল কেটেছে । এই অধম ওই অধম উপন্যাসে আর ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্মৃতিকথায় আমি ব্যাপারটাকে চেহারা দেবার চেষ্টা করেছি । একটা পলিসোনিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়ায় এক কাব্যগ্রন্হ থেকে পরের গ্রন্হে পরিবর্তনটা মনে হয়েছে অপরিহার্য । তা নইলে একটা নতুন বই বের করার দরকারটাই বা কী? পাঠক নামক একজন অপরকে সামনে দাঁড় করিয়ে, নিজের কাব্য টেক্সটের দশহাজার কিলোর একঘেয়ে হাতুড়ি ঠুকে যাচ্ছি বছরের পর বছর, ওটা আমার ভাষা-প্রযুক্তির অন্তর্গত ছিল না কখনও । কবিতা পড়তে শুরু করে বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখের ভাষা-স্ট্রাকচারকে মনে হয়েছিল আউট অ্যান্ড আউট বুর্জোয়া । ভিরমি খেয়েছিলুম দাদার কাছে শুনে যে ওনারা মার্কসবাদী । তারপর তো নকশাল কবিদের দেখলুম যারা কবিতা লিখেছেন কুলাক-বাড়ির ভাষায় । আসলে সবাই ভেবেছেন কী বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ । তাই যদি হবে, তো কবিতা লেখা কেন? অদ্বয়বজ্র, ক্রমদীশ্বর, ইন্দ্র্যভূতি, অতীশ দীপঙ্কর, চৈতন্যদেব প্রমুখ বাঙালিরা তো ওসব বলে গেছেন বহুকাল আগে । বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে জ্যোতি বসু একবার বলেছিলেন, “ও ওইসব কালচার-ফালচার নিয়ে থাকে ।” কথাটা আমায় স্ট্রাইক করেছিল । বঙ্গসংস্কৃতির দুটো বর্গ আছে । রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খ ঘোষ হয়ে হাল আমলের বহু কবি হলেন কালচারের মানুষ, যাঁদের কবিতায় একঘেয়েমিটা কালচার দ্বারা নির্মিত । আমি আর আমার মতন কেউ-কেউ হলেন ফালচার বর্গের মানুষ, যাঁরা একঘেয়েমি না কাটাতে পারলে পাগল হয়ে যাবেন । ফালচার বলতে আমি ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্পেসটার কথা কেবল বলছি না । আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন ব্রাহ্ম বলে । পিরিলি বাউনদের বজরা উত্তরপাড়ার গঙ্গায় ভাসলে স্নান অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠাকুমার পাল্কি ফিরে আসত । সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ ছিল কেননা তা লোচ্চাদের তামাসবিনি । অথচ পাশাপাশি মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুলও ঘটেছে । এই ইরর‌শানালিটি দিয়ে ডিফাইন করতে হবে ফালচার ব্যাপারটাকে । নিজেরা ফালচার বর্গের হয়েও আমি আর দাদা যে লেখালিখি আরম্ভ করলুম, তার কারণ অবশ্য মামার বাড়ির উচ্চমধ্যবিত্ত কালচার । ফালচারজগৎ এবং কালচারজগতের মাঝে যোগসূত্র ছিলেন শৈশবে পিতৃহীন আমার মা । আমি তো আর কোনো কবি-লেখকের কথা জানিনা, যাঁর সাবজেক্ট পোজিশানগুলো এরকম স্পেস আর টাইমে গড়ে উঠেছে । কালচার এমনই এক বাঙালিয়ানা যে-পরিসরে কখনও তুর্কি, কখনও ইরানি, কখনও ব্রিটিশ, কখনও সোভিয়েত, কখনও মারোয়াড়ি তাপের আঁচ কাজ করে গেছে বলে তা বেশ সুশৃঙ্খল । ফালচার জায়গাটার লোকটা বাঙালি বলে তার বিশৃঙ্খলা দিয়ে বাঙালিয়ানা সংজ্ঞায়িত; কোনোও সুনির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় সীমানা নেই । আমার ফিকশানে বহু চরিত্রের নির্গুণ বৈশিষ্ট্য এই সীমাহীনতার বোধ থেকে এসেছে । আমাদের উত্তরপাড়ার বাড়িটা শুনেছিলুম কোনও তুর্কি স্হপতির নকশা অনুযায়ী তৈরি, ইজিয়ান সমুদ্রের পূর্বপাড়ের ভিলাগুলোর আদলে; তিনশ বছর আগে বাড়ির সামনে দিয়ে গঙ্গা বইত । বাড়িটায় পঞ্চমুণ্ডের আসন ছিল; আর সেই জায়গাটায় বসে ছোটোবেলায় বেশ ফালচারি ফিল নেয়া যেত । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখের সাইকিতে এরকম প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা সম্ভব কি? এই সাবভারসিভ ফালচার? নেই, সম্ভব নয় । তাঁরা সমন্বিত চেতনার ইউনিফায়েড সেল্ফের বাইরে বেরোতে অপারগ । তান্ত্রিক নকশা-আঁকা লাল সিমেন্টের চারকোণা জায়গায় স্রেফ কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে থেকে যে নানা সাবজেক্ট পোজিশান স্পষ্ট হয়, ভয়ের, অতীতের, শবের, ধর্মের, নেশার, তন্ত্র নামক অনচ্ছ ধারণার, যৌনতার, এবং এ-ধরণের পাঁচমেশালি ফালচারি পরিচিতি, তা থেকেই তো জেনে গিয়েছিলুম যে শৈলীর একঘেয়েমি চলবে না । একটা বইয়ের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা পুরোনো হয়ে গেলে পরের বইতে যেন বোঝা যায় যে দুটি কাব্যগ্রন্হের মাঝে এক বা একাধিক সাইকো-লিংগুইস্টিক রাপচার্স ঘটে গেছে । আমার সাইকো-লিংগুইস্টিক স্পেসটাও মাইগ্রান্ট, কিন্তু সে মাইগ্রান্সি দেশভাগোত্তর রিফিউজি পরিবারের কবি-লেখকদের থেকে ভিন্ন, কেননা আমার মধ্যে রিরুটিঙের উদ্বেগ ছিল না, নেই । আমার মাইগ্রান্সি বজায় আছে । রিরুটিং পাকা হতেই রিফিউজি পরিবারের কবির মাইগ্রান্সি হাপিস, এবং তাঁরা একঘেয়েমির খপ্পরে । মনে হয় যে একঘেয়েমির ছকে পড়ে গেলে আমার কবিতা লেখা ফুরিয়ে যাবে । কবিতা লেখা বেশ কমে এসেছে । পত্রিকাগুলো চায়, কিন্তু ছকের মধ্যে থেকে যাচ্ছে বলে বাতিল করে দিতে হচ্ছে । একইরকম কবিতা অনেকে হুহু করে দিনের পর দিন কীভাবে লিখে যান, কে জানে! অধিকাংশ বিদ্যায়তনিক আলোচক এখনও ইউরোপে উনিশ শতকে শেখানো লেখককেন্দ্রিক আলোচনাপদ্ধতিতে আটক, আর কেবল সময় সময় সময় সময় বকে যান । আলোচনা যে পাঠবস্তুকেন্দ্রিক হওয়া উচিত, স্পেস স্পেস স্পেসের ভাবনা ভাবা দরকার, তা এখনও খেয়াল করে উঠতে পারেননি আলোচকরা । এখনও তাঁরা ইউরোপীয় অধিবিদ্যার মননবিশ্বের কারাগারে নিজেরা নিজেদের পায়ে বেড়ি হাতে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছেন ।

প্রশ্ন: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতা , এই দুটি ধারায় তুমি গ্রেপ্তার হয়েছিলে । তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেপ্টেম্বর ১৯৬৪তে । তোমাকে চার্জশিট দেয়া হল আর তোমার বিরুদ্ধে মকদ্দমা আরম্ভ হল মে ১৯৬৫তে । এই নয় মাস কলকাতার মিডিয়া আর কফিহাউস-বুদ্ধিজীবিরা অবিরাম প্রচার চালিয়েছিলেন যে তোমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতা বা পোরনোপুস্তক লেখার অভিযোগ উঠেছে । তুমি যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সে খবর মিডিয়া বেমালুম চেপে গিয়েছিল ওই নয় মাস । বিদ্ধদেব বসু এবং সমরেশ বসুর বিরুদ্ধে যে মকদ্দমা হয়েছিল, ওনাদের বিরুদ্ধে কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল না । তোমার বিরুদ্ধে সিরিয়াস অভিযোগ ছিল বলে তোমাকে আর তোমার দাদাকে জেরা করেছিল একটা ইনভেস্টিগেটিং বোর্ড যাতে সদস্য ছিলেন পুলিস, সেনা, স্বরাষ্ট্র বিভাগ, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপতরের উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা । মামলা রুজু হতে তুমি দেখলে যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নেয়া হয়েছে, এবং চার্জশিট দেওয়া হয়েছে অশ্লীল কবিতা লেখার ধারায় । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নায়া হয়েছে দেখে তোমার মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল কেন? এ-রাষ্ট্র তো ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সরকার নয় যে তুমি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করে গর্ববোধ করবে ? তোমার নিজেরই স্বদেশী উত্তরঔপনিবেশিক সরকার ! তোমার তো ভারমুক্ত বোধ করা উচিত ছিল । পরিবর্তে তুমি বিষণ্ণ হলে ?

উত্তর: স্বাধীনতা লাভের পর একজন কবির বিরুদ্ধে প্রথম রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগ তোলা হল । সারা ভারতবর্ষে প্রথম । কেবল কবিতা বা গল্প নিয়ে নয়, আমি রাজনীতি আর ধর্ম নিয়েও ম্যানিফেস্টো বের করেছিলুম, যা কোনও বাঙালি কবি তার আগে করেননি । ফলে রাষ্ট্রের টনক নড়ে গেল । রাষ্ট্র তো একটা অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেম, যেটা চালায় একদল লোক । সেই লোকগুলো, যারা যখন মসনদে বসে, নিজেদের রাষ্ট্র বলে মনে করে । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলতে প্রখৃত পক্ষে বোঝায় মসনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । যারা মসনদে বসে, তারা সবসময়ে পায়া টলে যাবার আতঙ্কে ভোগে । মসনদ বিরোধিতাই হল এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতা । আমি তো স্বঘোষিত এসটাবলিশমেন্ট বিরোধী । অভিযোগটা ছিল তার স্বীকৃতি । তাই মন খারাপ লেগেছিল । আসলে আঘাতটা যাঁদের দিয়েছিলুম, সেই সব মন্ত্রী, প্রশাসনিক আমলা আর পুলিসের কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অভোযোগের প্রমাণ যখন আদালতে পেশ হবে, তখন সাধারণ মানুষ তাঁদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে । মসনদের কেদারায় আসীন লোকগুলোর মগজে আমি অস্হিরতার বোধ চালান করে দিয়েছিলুম, তাঁদের আত্ম্ভরী ক্ষমতায় ঘা মেরে, মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রী, মুখ্য ও অন্যান্য সচিব, জেলাশাসক, পুলিশের কমিশনার ও আই জি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও বুদ্ধিজীবীদের কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে, রাক্ষস-অসুর-জানোয়ার-জোকার-মিকিমাউসের মুখোশ পাঠিয়ে, যার ওপর ছাপিয়েছিলুম একটি বার্তা: দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন । প্রশাসনের ক্রুদ্ধ নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ার কথা পুলিশ কমিশনার নিজে আমাকে আর দাদাকে বলেছিলেন । এখন তো বিরোধীপক্ষের লোকেরা প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে বলছে মুখৌটা বা মুখৌশধারী, বলছে মুখোশ খুলে ফেলুন । অনেকে তখন হ্যা হ্যা হি হি করেছিলেন, কেননা তাঁরা টের পাননি যে এসটাবলিশমেন্টের দাঁতকে শক্ত আর নখকে তারাল করে রেখে গেছে ইংরেজরা । তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন যখন নকশালর আন্দোলনে অংশ নেয়ায় অত্যাচারিত হলেন ও গুমখুন হলেন কবি ও লেখকরা । আরও বেশি করে টের পেলেন এমার্জেন্সির সময়ে যখন পচা আলুর চটের বস্তার মতন জেলের ভেতর নিক্ষিপ্ত হলেন লেখক ও সাংবাদিকরা, আর অশিক্ষিত লোকেদের দ্বারা প্রকাশিতব্য পাঠবস্তু অনুমোদন করাতে হল, কারা গারে দাগি আসামির মতন দাড়ি বাড়াতে হল গৌরকিশোর ঘোষকে, পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে ঠ্যাং ভাঙলেন জ্যোতির্ময় দত্ত।মুখোশধারী অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেম যে একই আছে, তা অভিজিৎ সিংহের আত্মহত্যায় আবার প্রমাণিত হল চল্লিশ বছর পর । তাত্বিক বিপ্লব আজকের দিনে বুদ্ধিবৃত্তির ভাঁোতামাত্র জেনেও, অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়া যে একই আছে, তা টের পাওয়া যায় মসনদের আতঙ্কবোধ থেকে, যখন তা কচি কচি ছেলেমেয়েদের এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতাকে ভয় পেয়ে মাঝরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে নখদন্ত দেখায় । পচনের এই প্রক্রিয়াকে আমি কিছিটা ধরার চেষ্টা করেছি নখদন্ত সাতকাহনে । বাঙালদের যে নেতারা ১৯৫০ সালে সংবিধান পুড়িয়েছিল, আজ তাদের কুর্সি নড়বড় করছে মনে হলেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধুয়ো তোলে । নবদ্বীপের গাণ্ডীব পত্রিকায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কনসেপ্টটাকে রিডিকিউল করে টুসকি অবিনির্মাণ শিরোনাঞে একটা পোস্টমডার্ন ছোটগল্প লিখেছি ।

প্রশ্ন: তোমার প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার বিরুদ্ধে হাংরি আন্দোলনের সময়ে অশ্লীলতার আরোপে মামলা হয়েছিল । সাহিত্যে অশ্লীলতা তখন নেতিবাচক ছিল । তোমার লেখালিখিতে অত্যধিক যৌনতা থাকার অভিযোগও উঠেছে । তোমার লেখালিখির জন্যেই তো হাংরি আন্দোলনকে অনেকে বলতেন যৌন ক্ষুধার আন্দোলন । তোমার নান্দনিক অবস্হান আর নৈতিকতা নিয়ে এরকম নেতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও তুমি মনে-মনে আনন্দ পেয়েছ । সমাজকর্তারা, সাহিত্যবেত্তারা, তোমার পাঠকৃতিকে অশ্লীল বললেন, যৌনতার বাড়াবাড়ি বললেন, ইমমরাল বললেন, অথচ গোপনে-গোপনে সে-কারণে তুমি গর্ববোধ করলে ! এটা পারভার্সান ছাড়া কী?

উত্তর: ব্রাহ্ম স্কুলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল পাঠ্য ছিল । বাংলার শিক্ষক অধিকারীবাবু একদিন সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে জানিয়েছিলেন, অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-এর কোন অংশগুলোকে বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, দীনেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, জেমস লঙ প্রমুখ অশ্লীল ঘোষণা করেছেন । উনি ভারতচন্দ্রকে ডিফেন্ড করে ব্রাহ্ম এলিটিজমকে আক্রমণ করেন, যা প্রধানশিক্ষকের কানে পৌঁছোলে অধিকারীবাবুকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল । আমি ভারতচন্দ্রের পক্ষে চলে গিয়েছিলুম অন্নদামঙ্গল-এর তৃতীয় অংশ মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান পড়ার সময়ে, কেননা আমার পূর্বজ লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন প্রতাপাদিত্যের প্রধান অমাত্য । আমার লেখায় যৌনতা আরোপিত নয় । কিন্তু অশ্লীলতা-যৌনতার অভিযোগে আমি ভারতচন্দ্রের ডিসকোর্সের পরিসরটা, যা এখন বুঝতে পারি প্রাগাধুনিক-প্রাকঔপনিবেশিক বলে, রিগেইন করে নিতে পেরেছিলুম । ভারতচন্দ্র-এর রচনায় যৌনতাকে আক্রমণের সূচনা করেছিল ব্রিটিশ অধ্যাপকরা । আর সাবর্ণ চৌধুরীরা গরিব হয়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম সাম্রাজ্যবাদী ধাক্কায়, যখন ওরা কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নিয়ে নিল । আমার মধ্যে, অভিযোগগুলো শুনে, বদলা নেবার গোপন গর্ববোধ চাগিয়েছিল । পার্ভারসান যে মনে হয় না, তারও কারণ আছে । বড়জ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার ছিলেন । পরীক্ষা-পরবর্তী স্কুলছুটিতে ওনার সাইকেলের কেরিয়ারে বসে প্রায়ই পাটনা মিউজিয়ামে যেতুম। স্কাল্পচার বিভাগে নানা ঢঙের নগ্ন-ন্গিকা অবাধে দেখে বেড়াতুম । দেখতুম যে পুরুষরা খাঁজকাটা যোনি বা স্তনের বোঁটায় টুক করে হাত দিয়ে নিচ্ছে বা ঠোঁট ঠেকাচ্ছে । মেয়েরা একই ব্যাপার করছে গ্রিক পুরুষের লিঙ্গ নিয়ে । হাত ঠেকিয়ে, চুমু খেয়ে সেসব অংশগুলোকে একেবারে চকচকে করেদিয়েছিল দর্শনার্থীরা । এখন মিউজিয়ামে নানা নিষেরধ হয়েছে যা তখন ছিল না । আমি প্রতাপাদিত্যের চেয়ে প্রাচীন সময়ে চলে যেতুম, যখন মেগাসথিনিস কয়েক হাজার গ্রিক তরুণী এনে পাটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনদের বিলিয়েছিলেন, কিংবা যখন গ্রিক সম্রাট মিনান্ডার পাটনা শহরে আগুন ধরিয়ে লন্ডভন্ড করার পর অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । অতীতের সঙ্গে আমার যা যোগসূত্র, আমি জানতুম, জানি, অভোযোগকারীদের সেরকম যোগসূত্র নেই । আমার কাছে তারা সদ্যভূমিষ্ঠ । মিউজিয়ামে বড়জ্যাঠার অফিসঘরে একাধিক নিউড পেইনটিং ছিল, যার একটা আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর আঁকা । ঠাকুর্দা ছবি আঁকা আর ফোটো তোলা শিখেছিলেন লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটর জন লকউড কিপলিঙের কাছে । ইনি সম্ভবত রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা, যাঁর সুপারিশে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতা মিউজিয়ামে সহকারী কিউরেটর হয়েছিলেন । ঠাকুর্দার আঙকা নিউডটা সম্পর্কে বড়জ্যাঠার গর্ববোধ ছিল । প্রত্যেক সদ্য-পরিচিতকে বলতেন ছবিটা ওনার বাবার আঙকা । ফলে আমার একটা ঐতিহাসিক সাপোর্ট সিস্টেম রয়েছে । হাংরি মকদ্দমার সময়ে বড়জ্যাঠা-বাবা-কাকারা আমায় টোটাল সাপোর্ট দিয়েছিলেন । বাবা তো পাটনা থেকে আদালতে এসেওছিলেন হিয়ারিঙের সময়ে বারকয়েক । আহিরিটোলা থেকে পিসেমশায়ও আসতেন ।

প্রশ্ন: তুমি তো রান্নাবান্না কর । সাধারণ বাঙালি রান্না রাঁধতে জান । অধিকাংশ কবি-লেখক যখন রান্না করা, বাসন মাজা, ঝুল ঝাড়া ইত্যাদি কাজকে অবমাননাকর মনে করেন, তখন তুমি রান্না-বান্নার কথা খোলাখুলি বলো কোন সাহসে? তাও আবার সংবাদপত্রের শৌখিন রান্না নয়, রোজকার রান্না । বিশুদ্ধ শিল্প, উত্তরণ, নান্দনিক বোধ ইত্যাদির প্রেক্ষিতে রান্নাবাড়ি ব্যাপারটা কি স্ববিরোধী নয় ? একদিন তুমি যখন ফ্যান গালছিলে, তখন মাঝি পত্রিকার সম্পাদক টেলিফোনে সেকথা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, বিশ্বাস করতে পারেননি । নখদন্ত সাতকাহনের প্রতি পৃষ্ঠায় তোমার রান্নার রেফারেন্স আছে । ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস উপন্যাসে বিসদৃশ মেনু আছে । জলাঞ্জলি উপন্যাসে সেক্সুয়াল অ্যাক্ট বর্ণনা করেছ রান্না প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আর তদ্বারা আক্রমণ করেছ সংবাদপত্রের শ্রখিন রন্ধনকর্মকে । নামগন্ধ উপন্যাসে রান্নাবান্নায় লুকিয়ে থাকা শ্রেণি বিভাজন অন্তত দুবার তুমি স্পষ্ট করেছ । তোমার কবিতাতেও রান্না বা কুইজিনের প্রসঙ্গ থাকে । তোমার আলোচকরা কেউই এই ব্যাপারটা ধরতে পারেননি দেখে তোমার অবাক লাগেনি? রান্না করতে শিখলে কোথায় ?

উত্তর: ইমলিতলায় হিন্দু-মুসলমান সবায়ের হেঁসেলে ঢোকার অবাধ অধিকার ছিল । রান্নাবাড়ির সাংস্কৃতিক পাথফক্যের ব্যাপারটা মগজে স্হান করে নিতে পেরেছিল । কুড়িজনের পরিবারে রান্নাঘরের ইনচার্জ ছিলেন মা। বাবা আর ছোটকাকা বিশুদ্ধ শাকাহারি ছিলেন । ইমলিতলার বাড়িতে কেবল পাঁঠার মাংস, হাঁসের ডিম, আঁশযুক্ত মাছ অনুমোদিত ছিল । প্রতি রবিবার ও ছুটির দিন বড়জ্যাঠা রাঁধতেন ওনার সাবর্ণ চৌধুরী স্পেশাল, যার তিনটে আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে । বাদাম কিসমিস খোয়াসহ যাবতীয় আনাজ দিয়ে সোনামুগ-আতপচালের মিষ্টি ভুনি খিচুড়ি; ঘিয়ে ভাজা তেতো-বর্জিত আনাজ দুধে সেদ্ধ করে ফোড়ন-তেজপাতার ওপর নারকোল কুরো দেয়া মিষ্টি শুক্তো; এবং বাঁধাকপি-ফুলকপি আলুতে ভেটকিটুকরো গরম মশলা দিয়ে মাখোমাখো তরকারি । ইমপ্রেশানিস্টিক মাইন্ড বলতে যা বোঝায়, তাতে এই পুরো সিনারিওটার ছাপ পড়েছে, যেটা ধরার কিছুটা চেষ্টা করেছি এই অথম ওই অধম উপন্যাসে আর ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্মৃতিকথায় । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকতে গিয়ে যখন নিষেধ ভাঙার, সীমালঙ্ঘনের, যথেচ্ছাচারের পর্ব শুরু হল, তখন সহপাঠী তরুণ-বারীন-সুবর্ণর সঙ্গে যা ইচ্ছে খাওয়া আর রাঁধার স্বাধীনতা পেয়ে গেলুম । প্রতিবেশি এক মুসলমান চুড়িওয়ালা অনেক পদ রাঁধতে শিখিয়েছিল । আমার স্ত্রী বাড়িতে মারাঠি পদগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে । লখনউতে দেড় বছর তেলেগু আবদুল করিম, পাঞ্জাবি মদন মোহন, কর্ণাটকি শেট্টিখেড়ে প্রভাকরা আর কোংকনিয় কুরকুটে একটা ফ্ল্যাটে ফোর্সড ব্যাচেলর হয়ে নিজেরা পালা করে রাঁধতুম । রান্না ব্যাপারটা যে যৌথজীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জলবিভাজক, তা পিক আপ করেছি অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তরে । বাঙালি লেখক-শিল্পীরা রান্নাকে ডিসকোর্স হিসেবে নেন না সম্ভবত উনিশ শতকের প্রধান পুরুষদের যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার ফলে। তার ওপর শ্বেতাঙ্গ পিতৃতন্ত্রের যে আদল-আদরা ইংরেজরা আমাদের সাহিত্যে চাপিয়ে গেছে, তাকে ডিকলোনাইজ করার জন্যে আমার মনে হয়েছে রান্নাবান্নার ব্যাপারটা একটা প্রধান হাতিয়ার। দাদা অবশ্য আমার চে্যে ভাল আটপৌরে রান্না জানে, আর বাবার কাছে শাকসব্জি আনাজপাতির আয়ুর্বেদিক গুণাগুণ শেখার ফলে রান্নাবাড়ির বাঙালিয়ানা ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে। ইমলিতলার রান্নাঘরে কোনবারে আর কোন তিথিতে কী-কী খেতে নেই, তার তালিকা থাকত, আগের বছরের পাঁজির ছেঁড়া পাতা । রান্না ব্যাপারটায় জীবনের সবকিছুই তো আছে ইনক্লুডিং সেক্স । আলোচকদের চোখে পড়েনি তার কারণ তাঁরা কেবল খাবার মধ্যে আটক, তার আগের পর্বের কর্মকান্ডেই যে তাঁদের সমাজটির নিবাস, তা অনুভব করেননি । বুদ্ধিজীবী যদি মাল্টিডিসিপ্লিনারি না হয়, তাহলে সাহিত্যের পুরো এলাকাটা খণ্ডিত করে ফ্যালে ।

প্রশ্ন: পোখরানে আনবিক বোমা ফাটাবার পর অনেক প্রতিবাদ হল, কবিতা লেখালিখি হল, গলা-কাঁপানো বক্তৃতা হল । এবারেই বেশি হল । প্রথমবার যখন ফাটানো হয়েছিল, তখন এতটা চেঁচামেচি হবনি । তুমি কেন আর সবায়ের মতন এর বিরুদ্ধে পদ্য বা গদ্য লিখলে না? ক্যাসেট বের করলে না? প্রথমবারও করোনি । এবারও করোনি। তুমি কি প্রসঙ্গটা থেকে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখছ?

উত্তর: তলিয়ে না দেখে কোনও কিছু ঘতলেই যারা গদ্য-পদ্য-গান-আঁকার মাধ্যমে একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তাঁরা ইনটেলেকচুয়াল বাফুন । ভারতের আণবিক বোমা তৈরি নিয়ে আমেরিকান, পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ গবেষক এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের লেখা বেশ কিছু বই আছে । প্রতিটিতেই বলা হয়েছেযে, ভারতীয় পোলিটিকাল এসট্যাবলিশমেন্টের অগোচরে, হোমি ভাবার সময় থেকে, বিজ্ঞানীদের একটা ছোট গোষ্ঠী আণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে নিজেদের জাহির করা । বাজেট বরাদ্দের দাবি ফি-বছর বাড়তে থাকায় পোলিটিকাল এসট্যাবলিশমেন্টের সন্দেহ হতে তারা প্রধানমন্ত্রীকে জানায় । কেননা বিভাগটা তাঁর অধীনে । প্রতিরক্ষমন্ত্রী ও সেনা জানত না । ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলে তরিৎকর্মা বিজ্ঞানীরা তাঁকে নানা তর্কে রাজি করিয়ে ভূগর্ভে বিস্ফোরণ ঘটাল । বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখে বিজ্ঞানীদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ইন্দিরা । সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে পড়ায়, চিন নিউট্রন বোমা তৈরি করে ফেলায়, এবং নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে, বিজেপি দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটায় । মানবিকতার দৃষ্টিতে আণবিক বোমার তুলনায় ঘৃণ্য আবিষ্কার দ্বিতীয়টি নেই । কিন্তু রিয়াল পলিটিক ভিন্ন কথা বলে । বাঙালি রাজনীতিকরা ছেঁদো দলাদলির সময়ে রিয়াল পলিটিক করেন, অথচ বিশ্বের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে বিমূর্ত মানবতাবাদ ফলান । বুশ-ব্লেয়ার মাস্তানি ফলিয়ে যেভাবে ইরাকে যুদ্ধ করতে ঢুকে পড়ল, সাদ্দাম হুসেন চৌসেস্কুর মতন একজন নৃশংস অত্যাচারী তিলে খচ্চর একনায়ক মেনে নিয়েও বলতে হয়, যে, ইরাকের কাছে আত্মরক্ষার অস্ত্র থাকা প্রয়োজন ছিল । ইউ এন ইন্সপেক্টর-ফেক্টর সব ফালতু । বুশ আর তার কুবের বন্ধুরা ইরাক আক্রমণ আর দখলের ছক বহু আগে করে রেখেছিল, এমনকী কে কী পাবে সেটাও । হয়ত কখনও ইরাক দখল করবে ভেবে ওদের আণবিক পরিকাঠামোটাও বোমা ফেলে বহুকাল আগে ওড়ানো হয়েছিল । ভারত আগে থাকতে মিসাইল প্রযুক্তিতে উন্নতি করে তারপর বোমা ফাটিয়ে অন্তত এটুকু হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখতে পেরেছে যে, তার কিছু হলে অন্তত এক হাত দেখে নেবে । চিন যেমন নিউট্রন বোমা বানিয়ে ফেলেছে, ভারতেরও তা তাড়াতাড়ি করে ফেলা দরকার । জেন-এর মিলিটারি ম্যাগাজিন অনুযায়ী, আণবিক শক্তিসম্পন্ন প্রতিটি দেশের মিসাইল কলকাতার দিকে তাক করা আছে, কেননা একটিমাত্র চোটে সবচেয়ে বেশি নাগরিকে এখানে যেভাবে ছাই করা যাবে, তা অন্য শহরে সম্ভব নয় । ইরাক যুদ্ধের ফলে বহু দেশ এবার গোপনে মারণাস্ত্রের ভাঁড়ার গড়বে, সম্ভবত একজন বয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন গণবিদ্ধংসী অস্ত্র । পদ্য-যোগাড়েরা তাদের হেড মিস্ত্রিদের যুগিয়ে যাবে গলা-কাঁপানো পদ্য । আমেরিকার বিশ্ববাজার আছে, তো পদ্য যোগাড়েদের আছে বুকনিবাজার । সম্প্রতি টিভিতে দেখলুম তথাকথিত নকশালপন্হী একদল পাঁচফুটিয়া ছেলেমেয়ে শেক্সপিয়ার সরণিতে একটা দোকানে এই অজুহাতে ভাঙচুর করল যে তারা মার্কিনী জুতো বিক্রি করে । একটি মেয়ে জিন্সের টপ আর টাইটবটম পরে ভাঙচুর করছিল । অর্থাৎ সে নিজেই মার্কিনী পোশাকে ছিল । অর্থনীতি সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই ছেলেমেয়েগুলোর । দোকানটা মারোয়াড়ির, টাকা তার, জুতোগুলো ভারতীয় শ্রমিকরা বানায় । ওসব না করে ওদের উচিত ছিল ফিদাইন হয়ে ইরাকে লড়তে যাওয়া । ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা লড়তে গিয়েছিল । যে নেতার কাজ অপছন্দ হতো, তিনি যে দেশেরই হোন, অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁদের যাচ্ছেতাই চিঠি লিখত ।

প্রশ্ন: তোমার জন্মের এক মাস আগে জার্মানি আর সোভিয়েত রাশিয়া পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল । সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল সেই যুদ্ধে, দু কোটি কেবল সোভিয়েত রাশিয়ার । তুমি যখন ক্যাথলিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছ, তখন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল যার ফলে তিন লক্ষ মানুষ মারা যান । তোমার যখন এক বছর বয়স, তখন ছাব্বিশ হাজার মানুষকে পোল্যান্ডের কাতি জঙ্গলে স্তালিনের নির্দেশে খুন করা হয়েছিল । ষাট লক্ষ ইহুদিকে বিষাক্ত গ্যাসে আর ইনসিনেটারে পুড়িয়ে মেরেছিলেন হিটলার । কত লক্ষ বিরোধী-নামাঙ্কিত মানুষকে স্তালিন, কাম্পুচিয়ার পল পট, জানারাল পিনোশে, ইদি আমিন, সুহার্তো, ট্রজিলিও, মোল্লা ওমর, দুভালিয়ের, টিক্কা খান, বিদেশের মাটিতে বাবা বুশ ছেলে বুশ মেরে ফেলেছেন । তোমার জীবদ্দশায় লক্ষ-লক্ষ মানুষকে একযোগে মেরে ফেলার জন্যে অ্যানথ্রাক্স, স্মল পক্স, বটুলিনাম, রাইসেন, টুলারেনসিস, নিউমোনিক প্লেগ, মাস্টার্ড গ্যাস, সারিন গ্যাস ইত্যাদি মারণাস্ত্র আবিষ্কার ও প্রয়োগ হয়েছে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোও না কোনোও আদশফের নামে গণহত্যাগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে । সারাটা জীবন অমন দূষণের ভেতরে বাস করে তুমি নিজেও কি দূষিত হয়ে যাওনি? তোমার কি সন্দেহ হয়না যে অমন দূষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাটাই বরং অপরাধ? এরকম আবর্তে বসে কবিতা লিখতে অপরাধ বোধ কর না? কেমন মানুষ তুমি?

উত্তর: হ্যাঁ । নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, নৃশংসতার যে সামগ্রিক ডিসকোর্সের সঙ্গে জন্মাবধি পরিচিত হয়ে চলেছি, এবং যেভাবে তা দেশে দেশে রাষ্ট্রীয়, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয়, এথনিক, ট্রাইবাল, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, আর্থিক বৈধতা পেয়েছে, তা ব্যক্তির অন্তরাত্মা ধাঁচের ধারণার অ্যাবসার্ডিটিতে আমি আক্রান্ত । হত্যাযজ্ঞ একজনের কর্মকাণ্ড নয় । তা অজস্র মানুষের আনুগত্যের যান্ত্রিক দক্ষতা থেকে উপজাত । জনমুক্তি, মানবতাবাদ, মানুষই পৃথিবীর কেন্দ্র, কমরেড তুমি নবযুগ আনবে, মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ, সততা, উত্তরণ, ধ্রুবসত্য, যুক্তিপ্রাণতা, ইতিহাসের প্রগতি, সার্বভৌম একক মন, ব্যক্তিচেতনা, বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক সুস্হতা ইত্যাদি, গ্রমীণ লিটল ম্যাগাজিনের অজ্ঞান-অবোধ ডিসকার্সিভ স্পেস হিসেবে কেবল টিকে আছে । আমি যে কেবলমাত্র সন্দেহে আক্রান্ত, সেখানেই যে এই প্রবলেম্যাটিকের সমাপ্তি, তা কিন্তু নয় । পশ্চিম বাংলার ম্যাক্রোলেভেল ও মাইখপলেভেল ঘটনাবলীর দ্বারা প্রতিনিয়ত ফুটে উঠছে বাগাড়ম্বরের ইডিয়সি । যারা বলেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এসট্যাবলিশমেন্টকে ধ্বংস করাটা সাম্যবাদের অভিমুখ, তাদের তো চেয়ারে বসে-বসে ফিসচুলা হয়েগেছে । আমাএ সাবজেক্ট পোজিশান ওই উনিশ শতকীয় এনলাইটেনমেন্টের পৃষ্ঠপটে যদি দূষিত মনে হয় তো তার উৎসসূত্র ওই একই ডিসকোর্স । বদ্ধ উন্মাদ বা খবরের কাগজে ঘটনা-নির্লিপ্ত প্রবন্ধ-লেখকরাই শুধু নিজেদের দূষণমুক্ত মহাপুরুষ বলে মনে করতে পারেন, কেননা তাঁদের যন্ত্রণায় ছটফট করার প্রয়োজন হয় না । আমি তাই আমার এই সাবজেক্ট পোজিশানকে পারক্য আক্রান্ত বা এলিয়েনেটেদ বলব না । কেননা, তুমি যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছ, সে single agent নয়, তার ‘অ্যানোমি’ ঘটা সম্ভব নয় । আমি যে আপোষ করিনা, আর dissenting voice গুলো বজায় রাখতে পেরেছি, তাও কিন্তু আমার সাবজেক্ট পোজিশানকে অবিরাম যাচাই করতে থাকার কারণে । অমন জাগতিক ধ্বংসকাণ্দের মাঝে জন্মাবধি বাস করে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস লেখার নৈতিক প্রয়োজনীয়তার সন্দেহটা থেকেই যায় । সাহিত্য ব্যবসায়ী হলে নিরেট অজ্ঞানতার কোকুনে সন্দেহহীন আরামে থাকতুম । সন্দেহহীন হওয়াটা, আমার মনে হয়, ক্রমিনালের মতন আচরণ হয়ে যাবে । যদিও জানি যে আমার ভাবনাচিন্তার চাপটাই আমার হার্ট অ্যাটাক দুটোর অন্যতম কারণ ।

প্রশ্ন: তুমি যখন থেকে লেখালিখি করছ, তখন থেকেই জোব চার্ণককে কলকাতার পিতৃত্ব দেবার বিরোধিতা করে আসছ । কলকাতায় ফিরে আসার পর সাবর্ণ চোধুরী পরিবার পরিষদে অংশ নিয়েছ, যাতে জোব চার্ণককে পিতৃত্ব দেয়া নাকচ হয় । প্রথম সাবর্ণ চৌধুরী লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর জীবন নিয়ে লিখেছ কবিতীর্থ পত্রিকায় । নবম শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত নিজের সাবর্ণ চৌধুরী লিনিয়েজ নিয়ে দিশা পত্রিকায় লিখেছ । এটা কি তোমার পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্স ? নাকি জোব চার্ণককে উৎখাত করার মধ্যমে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিলে? কেননা রাধাকান্ত দেবের পরিবার সুতানুটি পরিষদ জোব চার্ণককে কলকাতার পিতৃত্ব দিতে উঠে-পড়ে লেগেছিল । আর রাধাকান্ত দেবের পূর্বজই ক্লাইভকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, আর্থিক ও স্ট্র্যাটেজিক সাহায্য করেছিল । ইংরেজ ও নবাবপক্ষের অবর্তমানে, তাদের লড়াইটা কি গোপনে কলকাতার দুই আদি পরিবারের মধ্যে আজও চলছে? তুমি কী উদ্দ্যেশ্যে এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে, যার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নেই?

উত্তর: ইংরেজরা কলকাতার একশ বছর, কলকাতার দুশ বছর চিহ্ণিত করে কোনও উৎসব পালন করেনি । যারা তিনশ বছর পালন করার হুজুগটা করল, তাদের একটা অংশ সেই পরিবারের রেলিকস যারা সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাইভকে সাহায্য করে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় খুঁটি হিসেবে কাজ করেছিল । কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তিকর ও অসহ্য লাগল সেইসব লোকগুলোর কাজকারবার, যাঁরা স্বঘোষিত বামপন্হী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী । কলকাতার রাস্তাঘাত, মাঠ-ময়দান সর্বত্র থেকে যখন সাম্রাজ্যবাদীদের মূর্তিগুলো উপড়ে লোপাট করা হয়েছে, তখন আশ্চর্য হয়ে গেলুম দেখে যে স্কুলের পাঠ্যবইতে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট জোব চার্ণকের মূর্তি বসন হয়েছে, এই ফিকশনের মাধ্যমে যে, তিনি কলকাতা শহরের বাবা । আসলে পশ্চিম বাংলায় নিজেদের বৈধ ও ন্যায্য প্রমাণ করার জন্যে পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা রাজনৈতিক রিরুটিং হিসেবে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন । বহিরাগতরা যেখানে গেছে সেখানকার ইতিহাস বিকৃত করেছে । হাওয়া৪৯ এর অপর সংখ্যায় আদি কলকাতার অপর শিরোনামে কৌশিক পরামাণিক ওনার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, সরকারি ইতিহাসকাররা কলিকাতার তিনশত বৎসরের জীবনপঞ্জী বইটায় কী কেলো করেছেন । হাওয়া৪৯-এ উত্তরঔপনিবেশিকতা নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার সময়ে তধ্য খুঁজতে বসে রাগ ধরে গেল সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান বইতে জোব চার্ণক আর লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর এন্ট্রি দুটো পড়ে । জোব চার্ণক সম্পর্কে এন্ট্রিটা ভুল তথে্য ঠাসা, এবং গাঁজাখুরি । সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত আর অঞ্জলি বসু কোথা থেকে ওসব জুটিয়েছেন জানি না । তবে ওনাদের সাবজেক্ট পোজিশান যে মোটিভেটেদ তা স্পষ্ট হয়ে গেল আমার পূর্বজের এন্ট্রিটা পড়া । পদবিসহ নাম না দিয়ে লেখা হয়েছে কেবল লক্ষ্মীকান্ত, জন্ম-মৃত্যু সন নেই, তথ্য ভুল এবং ভাসা-ভাসা, যখন কিনা লক্ষ্মীকান্তর উত্তরপুরুষ অতুলকৃষ্ণ রায়ের লেখা এ শর্ট হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা বইটা, যার ভূমিকা লিখেছিলেন নিশীথরঞ্জন রায়, তা ওনাদের কাছেই ছিল । এই সময়েই বড়বাড়ি আর সাবর্ণ পাড়ার গোরাচাঁদবাবু, স্মরজিৎবাবু, কানুপ্রিয়বাবু জোব চার্ণককে কলকাতার বাবা বানাবার বিরুদ্ধে মামলা করার তোড়জোড় করছিলেন । সাম্রাজ্যবাদ আসার আগে হিন্দু বাঙালির বাপ-চোদ্দোপুরুষের ইতিহাস খতিয়ান রাখত ঘটক সম্প্রদায় আর পুরীর পাণ্ডারা । ধার্মিক আচার-আচরণের বাইরে তার গুরুত্ব এই ছিল যে, লোকে নিজের ভৌগলিক আর ঐতিহাসিক শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকত, যা তার মধ্যে সক্রিয় রাখত এই বোধ যে, সে পোকা-মাকড় জন্তু-জানোয়ার নয় । কিন্তু ইউরোপীয় মননবিশ্বে নির্মিত নাগরিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার পারিবারি আর ভৌগলিক স্মৃতি থেকে । আজকের বিশ্বের বহু সমস্যার বীজ ওই উত্তরঔপনিবেশিক স্মৃতিবিপর্যয়, এবং নব্য-সাম্রাজ্যবাদি এনট্রপি । সাহিত্যিক হিসেবে পারিবারিক শেকড়ের স্মৃতিচর্চার মাধ্যমে আমি গভীর বাঙালিত্বে প্রবেশ করি, যা মুর্শিদাবাদ, গৌড়, সরকার সাত গা্ঁ, তাম্রলিপ্তে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আদি বাঙালিত্বের স্পেস তৈরি করে । আমার লেখালিখিতে এই স্পেস হাংরি আন্দোলনের সময় থেকে মোটিভ ফোর্স রূপে আছে । হাংরি বুলেটিন, যেটা আমার জেনারেশনের >কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র নামে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা মহারাজ প্রতাপাদিত্যকে উৎসর্গ করেছিলুম । পোস্টমডার্ন ভাবনা ও সমাজ বিশ্লেষণে আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর আগ্রহ, এই বিশেষ স্পেসটির সূত্রে । প্রথম যিনি ১৯৩৪ সালে পোস্টমডার্ন শব্দটি প্রয়োগ করেন, নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস, তা করেছিলেন প্রক্তন উপনিবেশের মানুষগুলোর স্মৃতি বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে । মুম্বাইতে থাকতে, আর্জেন্টিনার এক তরুণ কবিগোষ্ঠী আমার সম্পর্কে একটি স্প্যানিশ ওয়েবসাইট খুলেছেন খবর পেয়ে, ১৯৮৯ সালে নেট সার্ফিং করতে বসে ফেদেরিকো দ্য ওনিস সম্পর্কে জানতে পারি ।

প্রশ্ন: তোমাকে নিয়ে, তোমার নাম উল্লেখ করে বহু ওয়েবসাইট আছে । বইপত্র তবু কিছুদিন থাকে । কিন্তু ওয়েবসাইট যে থাকবে না, মুছে যাবে, তা কি পীড়িত করে না তোমায়? ইন্টারনেটের কারণে চিঠিপত্র সংগ্রহে রাখাটাও তো সম্ভব নয় । সাহিত্যের যে সাময়িক অবিনশ্বরতা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল । তোমায় হন্ট করে না ?

উত্তর: ওয়েবসাইটগুলোয় যে আমি আছি তা জানতে পারি নেট সার্ফিং শিখতে গিয়ে । আমার সম্পর্কে কে কী লিখেছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চিঠি বা হাংরি বুলেটিন রেখেছে, কোন গ্রন্হে আমার কবিতা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, সে সব জানার আহ্লাদ আছে । অনেকে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে মাঝে মধ্যে কবিতা সংকলিত করেন, তাতে আমার কবিতাও থাকে, যদিও তা কয়েকমাসের জন্যে । অনেকে ই-মেল করে গল্প বা কবিতা পড়ার জন্যে পাঠান । আমার তো বাড়িতে ব্যবস্হা নেই, সাইবার কাফেতে ঢুঁ মারতে হয় । আঙুলে ব্যথার জন্যে অসুবিধে হয় । এ ঠায় বসে থাকাও কষ্টকর । অবিরাম পরিবর্তনরত একটা ব্যাপারের মধ্যে আছি, তার মৌজমস্তি উপভোগ করি । কলকাতার সাহিত্যিকি নোংরামির বাইরে বেশ স্বস্তিদায়ক অবস্হান । সাহিত্যিক অবিনশ্বরতা ব্যাপারটা ফালতু । তরুণ কবি-লেখকরা দেখি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর পড়েন না , অথচ তিনি, ঢাকার আব্দুল হালিম বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন । বেঁচে থাকতেই তো দেখছি আমার নামের ইমেজ আমার লেখাপত্রকে ছাপিয়ে যাচ্ছে । মগজের দেয়ালে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো, মিশরের পিরামিড, রোমের কলোসেয়াম, মাম্মালাপুরমের মন্দির, কুমহারারে সম্রাট অশোকের প্রাসাদের পাথরটুকরো ইত্যাদির ছবি টাঙিয়ে রাখলে অযথা দুশ্চিন্তার দুর্ভোগ থেকে মুক্ত থাকা যায় । বড়জ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কাজ করতেন বলে আমি স্কুলে পড়ার সময় ছুটির দিনগুলো সেখানেই কাটাতুম । তাই সময় ও সময়হীনতার ধারণা তখন থেকে গড়ে ওঠে । মুছে যাওয়াটা সেহেতু হন্ট করে না ।

প্রশ্ন: তুমি কি নিজেকে হিন্দু বলে মনে করো? হিন্দুদের দেবী-দেবতা, ইষ্টদেবতা আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করো? হিন্দুর উৎসবে অংশ নাও? হিন্দুরা যদি অন্য ধর্মের লোকেদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, যেমন কাশ্মিরি পণ্ডিত রা, তাহলে কি ইন্সটিংক্টলি রিঅ্যাক্ট করো? মরে গেলে ডাক্তারি ছাত্রদের জন্যে তোমার দেহ দান করে দেবে? তুমি কি চাইবে গঙ্গার ধারে, তোমার বাপ-ঠাকুর্দার বসতবাটি উত্তরপাড়ায় তোমার শেষকৃত্য হোক? নশ্বর শবের মাধ্যমে কি ইমেজকে পূর্ণতা দিয়ে যেতে চাও, যেমনটা রাজনীতিক-সাহিত্যিক-শীল্পীরা করেন? বয়েস তো হয়ে গেল, এখনও পর্যন্ত নিজের মৃত্যুকে গ্লোরিফাই করে কবিতা লেখোনি তো?

উত্তর: হ্যাঁ, আমি একজন হিন্দু । এই জন্যে যে আমি চাই মরে গেলে আমার দেহ পোড়ানো হোক । সবাই জন্মসূত্রে হিন্দু হয় । আমি মৃত্যু সূত্রে । পারিবারিক ইষ্ট দেবতা, সাবর্ণচৌধুরী হবার সুবাদে, কালীঘাটের কালী আর শ্যামরায়, যাঁদের থেকে, ঠাকুমার আমল থেকে, ঠাকুমার মানসিকতা ও দাপটের কারণে, আমার আগের প্রজন্ম মুক্ত হয়ে গিয়েছিল । বাবাকে কখনও কোনো মন্দিরে যেতে দেখিনি, যদিও উনি পৈতে পরা, গায়ত্রীমন্ত্র, খাবার সময়ে গণ্ডুষ ইত্যাদি সম্পর্কে গোঁড়া ছিলেন, পাঁজি-পুঁথি মানতেন না । মা সেসব কিচ্ছু মানতেন না, এমনকি অন্য ধর্মের মেয়ে বিয়ে করার ওপন পারমিশান দিয়ে রেখেছিলেন উনি । আমার সাবজেক্ট পোজিশানের বহুত্বের উৎস আমার শৈশবের পাড়াগুলো তো বটেই, আমার বাবা-মা, জেঠিমা-জ্যাঠা, কাকিমা-কাকার মতাদর্শের বৈভিন্ন্যের অবদানও তাতে আছে । আমার বয়ঃসন্ধির যৌনউন্মেষ হয়েছিল একজন শিয়া মুসলমান তরুণির সংসর্গে, এবং কবিতার জগতে প্রবেশও । এ-ব্যাপারে আমার একটা কবিতা আছে, প্রথম প্রেম: ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ শিরোনামে । প্রাথমিক স্তরে পড়েছি ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে, তখন প্রতিদিন চার্চে যেতে হত । তারপর ব্রাহ্ম স্কুলে । আমার মস্তিষ্কে ঈশ্বর বিশ্বাসের ওই বীজ অংঙ্কুরিত হতে পারেনি । চেষ্টা করেও না । ডুবজলে যেটুকু প্রশাস-এর অতনু, আর নামগন্ধ উপন্যাসে অরিন্দম এবং যিশু বিশ্বাস চরিত্রগুলোয় আমি এই মনস্হিতি আর্টিকুলেত করার চেষ্টা করেছি । দুটি স্কুলেই হিন্দু উৎসব নিষিদ্ধ ছিল । পাড়ার প্রধান উৎসব ছিল দোলখেলা, যাতে অংশ নিতুম, এখন বয়সের কারণে নিই না । গণহত্যা শুনলেই গাগুলোয়, টিভিতে দেখলেই বন্ধ করে দিতে হয় । পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশানের সামনেই দুজনকে থেঁতলে দেয়ালে গেঁথে দিতে, সঙ্গে-সঙ্গে সরবিট্রেট রাখতে হল জিভের তলায় । ইন্সটিংক্ট এখন এই স্তরে । তবে পাকিস্তান রাষট্রটিকে আমি ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করি । তাদের জণভেই হিন্দিত্ব নামক দানবটি পয়দা হবার সুযোগ পেয়েছে । রাষ্ট্রধর্ম কনসেপ্টটাই দুর্বৃত্তসুলভ । রাষ্ট্রের আবার ধর্ম হয় নাকি? তাহলে তো পথঘাট-লাউকুমড়ো কাক-কোকিলেরো ধর্ম থাকবে । দেহ দান করার ব্যাপারটা নিছক নৌটঙ্কি । গুদামের চেলাকাঠের ডাঁইয়ের মতন মর্গগুলোয় বেওয়ারিশ লাশের পাহাড় জমে থাকে । এসকেপিস্টরা আর যে প্রাক্তন উদ্বাস্তুরা পশ্চিম বাংলার মাটিতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে অনিচ্ছুক তাঁরা, ওটা করেন । মরার সময়ে মুম্বাইতে থাকলে চোখদুটো কারোর কাজে লাগবে । উত্তরপাড়ার যে-ঘাটে সাবর্ণচৌধুরীদের শেষকৃত্য হত, সেখানে বহুকাল আগে শবদাহ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে । বেস্ট হবে কিউ না দিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকতে পারা । মৃত্যুকে গ্লোরিফাই করার সাহিত্যিক ক্যাননটা উপনিবেশগুলোয় এনেছে ইঊরোপ । যার শব পোড়ানো হবে, তার এপিটাফ লেখার মতন ইডিয়টিক ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই । মৃতদেহ ঘিরে ফিউনারাল সং গাওয়াটাও বাঙালির সাংস্কৃতিক আচরণ নয় । মৃত্যুর পর স্মরণসভা ব্যাপারটাও আমার অভিপ্রেত নয় । আমি অমন স্মরণসভাগুলো এঢ়িয়ে যাই । লক্ষ-লক্ষ বাঙালির মতন আমিও সাধারণ স্বাভাবিক অবলুপ্তি চাই । আপাতত দুর্গাপুজোর নবমীর দিন বড়বাড়ি আর আটচালায় নানা এলাকা থেকে এসে সাবর্ণচৌধুরীদের যে জমায়েট হয়, ১৬১০ থেকে হয়ে আসছে, তাতে অংশ নেয়া আর খাওয়ায় সীমিত হয়ে গেছে ধর্মকর্ম।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Malay Roychoudhury interviewed by Nishtha Pandey

    Malay Roychoudhury interviewed by Nishtha Pandey

Nishtha : In your own words, can you explain briefly why the movement ended? Were the reasons purely political?

Malay : People thought that the movement ended after I left Kolkata in 1967 consequent upon my exoneration at High Court and my getting a job in Agricultural Refinance & Development Corporation, Lucknow. I was from a Patna slum called Imlitala and did not have any knowledge of agriculture and rural life. I had to gain knowledge by reading about rural life. The movement was continued by other members but they did not give publicity to their magazine “Khudharto ” as I did by distributing leaflets and pamphlets which reached readers quickly ; nobody had to pay. Leaflets/pamphlets  had a greater reach as some of them were in English as well. “Khudarto” was in Bengali and Kolkata Centric. In fact seven issues of “Khudharto’ were published as an anthology by Sahitya Academy. Unfortunately those who published “Khudharto ” took a decision to have only a few writer friends as contributors. I used to increase the number of participants which included writers, poets, dramatists, cartoonists and painters. The movement took roots in North Bengal and Tripura in 1975-1980 but then again they were not publicized. Politics played a role as far as the then West Bengal government wanted to stifle our voice, arrested us and charged me for my poem Stark Electric Jesus. When my elder brother returned to Kolkata and started a literary magazine called HAOWA39, and I got transferred to Kolkata, interest among younger generation writers about our movement received attention. I was requested to write about the movement by a magazine of Bangladesh which was republished in Kolkata by a publisher and published again by another publisher with lots of photographs. After Maitreyee Bhattacharjee Choudhury wrote The Hungryalists published by Penguin Random House, the movement again got an Indian attention.

Nishtha : Performing poetry was a big part of the Hungry Movement, it aimed at raising people from their passive state. Is there a particular performance that is striking to you, or stands out more than the others?

Malay : There were a few of them. One was at the cemetery of Michael Madgusudan Dutt, limited to us only, though Tridib Mitra and his girlfriend Alo Mitra had distributed cards of the event among writers and poets. The one which attracted a crowd was at Howrah station when I stood upon a bench at platform number one and read the Bengali version of Stark Electric Jesus loudly. Tridib Mitra read his poem Hatyakand. Third was at country liquor den Khalasitola on Jibananda Das’s birthday when Abani Dhar got up on a table and sang a song ; he had worked as a ship mate for some time. This became news in the next day’s newspapers and literary magazines. The incident has also been included in the book ‘A Poet Apart’ by Klinton B Seely, on Jibananda Das’s life and poetry.

Nishtha : The Hungry Movement was a combination of the literary and the political when at its peak. How did this come about? Did one aspect stem from the other or were both of them intertwined from the beginning?

Malay : Both of them were intertwined from the very beginning as Hungry Generation manifestos were issued not only on literature but also on politics and religion etc. The then daily ‘Jugantar’ wrote its main editorial on consecutive days about our political manifestos. Our poems, short stories and drama had political overtones. Politics came automatically as the movement itself was a reaction to the plight of refugees at the Sealdah railway station. 

Nishtha : Caste equality was an important fight that was led by the Hungryalists. Can it be the sole reason why the movement always garnered unwanted attention from the literary elite of Bengal, and eventually from the state?

Malay : I do not think so. Elitist literary magazines did not publish under-caste works. We wondered loudly as to why they were excluded from Buddhadeva Basu, Sushil Roy, Sunil Gangopadhyay’s poetry magazines. Haradhan Dhara had to change his name to Debi Roy, since Dhara means cultivator caste, so was Sambhu Rakshit. Sunil Gangopadhyay ridiculed Haradan Dhara in letters to his friends. Actually the then Establishment was dominated by upper castes. It is the elites who requested Kolkata Police to take action against our movement. 

Nishtha : Do you think the movement’s delicate position in a postcolonial country, in post-independent Bengal, affected the fate of the movement, particularly the end, compared to let’s say the Beats in America?

Malay : The Beats came from rich families. Very rich families, when you think of Ginsberg, Kerouac, Burroughs. We were paupers compared to them. Saileswar Ghosh, Subhash Ghosh, Basudev Dasgupta, Pradip Choudhuri came from refugee families. Haradhan Dhara had to work as an errand boy at a tea stall ; his mother collected garbage from vegetable markets. Falguni Ray did nothing.  came from a slum. We did not get publishers for our books for more than two decades.

Nishtha: Do you think the friendship with Allen Ginsberg propelled the Hungry Movement in any way? Did his visit act as a catalyst for the movement?

Malay : Yes it did. Not in India but in America. In India prominent Hindi, Gujarati and Marathi writers wrote about our movement in the papers/magazines of their languages. Allen Ginsberg sent our manifestos and bulletins to Lawrence Ferlinghetti who published them in four issues of his City Lights Journal. This attracted other editors and writers of various little magazines in the USA, Latin America, Europe, Turkey and Arab world.  Research is being done in those activities by academicians now. You may find them in academia.edu. But his visit can not be termed as a catalyst. Our movement started in November 1961 and Ginsberg came in 1962. He met my elder brother Samir in 1962 and came to meet me at Patna in April 1962. My photographer father was annoyed with Ginsberg when he found out that Ginsberg was taking photos of lepers, beggars, destitutes, half-naked sadhus. He eventually made money by printing them in India Journals and Exhibiting them in various studios. He was, like other foreigners, an Orientalist.

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজ্বল দত্ত

ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার  মুখোমুখি মলয় রায়চৌধুরী 

( ” বারাকপুর স্টেশন ” কবিতা পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায়   মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজ্জ্বল দত্ত। সাক্ষাৎকার সহায়তা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রাজদীপ ভট্টাচার্য) 

সজ্জ্বল দত্ত: মলয়দা , বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনি এই সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়েছেন এজন্য আমরা যারপরনাই উল্লসিত। শুরুতেই আপনার ছোটবেলার কথা, জন্ম, পারিপার্শ্বিক এবং বাল্যশিক্ষার বিষয়ে আমাদের যদি একটু জানান।

মলয় রায়চৌধুরী : প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ধন্যবাদ । কিন্তু প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার কোনো বই পড়ে করা হয়নি । আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ের চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রতিভাসের, নাম ‘ছোটোলোকের জীবন’ । আমি জন্মেছিলুম পাটনায় সরকারি হাসপাতালে ১৯৩৯ সালে । আমরা থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা মহাদলিত আর গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা বস্তিতে । বাবা ছিলেন কুড়িজনের পরিবারের প্রধান রোজগেরে । পরে বড়োজেঠা পাটনা মিউজিয়ামে মূর্তি আর পেইনটিঙ ঝাড়পোঁছের ক্লাস ফোরের চাকরি পান । শিক্ষা পাটনাতেই, রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে। সেখানকার গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম।

সজ্জ্বল :  বাংলা সাহিত্য ও কবিতার প্রতি আপনার ভাব-ভালোবাসার শুরুয়াত হল কীভাবে?

মলয় : আমার পড়াশোনা পাটনায় হলেও, দাদা সমীর রায়চৌধুরীর চরিত্র পাড়ার প্রভাবে খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে ওনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । দাদা পাটনায় আসার সময়ে প্রচুর বাংলা বই আনতেন । আমি তিরিশের দশকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই । পাশাপাশি ইংরেজি কবিদেরও পড়া আরম্ভ করি, যাদের কবিতাপাঠ ম্যাকলে সাহেবের চাপে স্কুল আর কলেজের পাঠ্যে ঢুকেছিল । ১৯৫৯ নাগাদ বাবা একটা সুদৃশ্য ডায়েরি দিয়েছিলেন, তাতেই কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলুম ।

সজ্জ্বল :  আপনার দাদা আপনার সাহিত্যচর্চায় কতটা প্রভাবিত করেছেন আপনাকে?

মলয় : দাদা পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক প্রভাবে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিলেন । আমার বিপরীত । উনি ছিলেন সোফিসটিকেটেড । আমি মিশতুম পাটনার লুচ্চা-লাফাঙ্গাদের সঙ্গে। ইমলিতলায় ছোটোবেলাতেই শুয়োরের মাংস, ইঁদুর পোড়া আর তাড়ি খেয়ে ভিন্ন ধরণের জীবনে ইনিশিয়েশন হয়েছিল । ইমলিতলার বন্ধুরা আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল । দোলখেলার সময়ে পাড়ার মহিলারা যৌনতার ইনহিবিশিন বাদ দিয়ে মেতে উঠতেন রঙ খেলায় । আমার প্রথম বন্ধুনি ছিলেন কুলসুম আপা নামের এক কিশোরী, যিনি আমার সঙ্গে গালিব আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজের পরিচয় করান । ওনার সম্পর্কে মন খুলে লিখেছি বাল্যস্মৃতিতে । একজন যুবতীর যোনি উনিই প্রথম প্রত্যক্ষ আর অনুভব করতে দিয়েছিলেন।

সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলন বিষয়ে অবহিত নন যে পাঠক তাঁদের কথা ভেবে আপনাদের আন্দোলনের পশ্চাদপট এবং শুরুর দিনগুলির কথা সংক্ষেপে  একবার আমাদের জানান ।  

মলয় : হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ৯৯% বাঙালি পাঠক অবহিত নন। পাঠক কেন, তরুণ কবি-সাহিত্যিকরাও জানেন না। অনেকে তো আমার নামই শোনেনি । তাই তাঁদের কথা আর ভাবি না । 

সজ্জ্বল : ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহুপাঠকের ভেতরে অবধারিতভাবে উঠে আসবেই  মলয় দা, আপনার কবিতা কি আদৌ বুভুক্ষুদের কথা বলে নাকি অহৈতুকী যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?

মলয় : কী আর বলি ? আমার লেখাপত্র তো পড়ো না । পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম । আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল । আমি ক্ষুধা শব্দটা ব্যবহার করিনি । চিরকাল হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি । ‘হাংরি’ শব্দটা প্রথমে পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের ‘In Swore Hungry Time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম হলো: 

“কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।”

এই হাঙ্গার  শুধু আক্ষরিক অর্থেই হাঙ্গার ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের হাঙ্গার, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষার হাঙ্গার। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছিল যে কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে আমি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চেয়েছিলুম। এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যৎবাণী বলে মনে হবে ।

সজ্জ্বল :খুব সত্যি কথা , এ’ বিষয়ে আপনিও নিশ্চয়ই অবগত আছেন , হাংরি আন্দোলনের অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করতেন যে আপনিই এই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন! আপনার কী বক্তব্য ? 

মলয় : আমি আর ছুরি মারব কেমন করে ? আমার বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল ৩৫ মাস। বন্ধুরা বেশির ভাগ রাজসাক্ষী হয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশে বয়ান দিয়েছিল আর কেটে পড়েছিল । সাক্ষী হবার জন্য আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকাও পেয়েছিল । এইসমস্ত বন্ধুদের ঘৃণ্য মনে হয়েছিল। হাইকোর্টে মামলা জেতার পর ঘেন্নায় আমি এদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম । সৌভাগ্যবশত পাটনায়  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর চাকরি ছেড়ে এআরডিসিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের চাকরি পেয়ে লখনউ চলে যাই । নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে টের পাই যে চাষবাস, পশুপালন, জলসেচ, গ্রামজীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না । এই সমস্ত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হয়েছিল । সাহিত্যের বই পড়া আপনা থেকেই পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলুম । তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার ফলে এখন আমার পেনশন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওনের চেয়েও কম ।

সজ্জ্বল : রমানাথ রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বিষয়ে আপনার কি মত?

মলয় : রমানাথ রায় তো কবিতা লিখতেন না ! শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখেছি। নেটে পাবে প্রবন্ধটা ।

সজ্জ্বল : কবিতা রচনায় বেশি মনোযোগ না দিলেও আসলে রমানাথ রায়ের কিছু ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্পনির্ভর কবিতার কথা বলতে চেয়েছিলাম । যেমন – ‘ রাস্তায় রাস্তায় ‘ , ‘ চালের বদলে ‘ , ‘ আমার বুক ‘ ইত্যাদি । যাইহোক আপনার উত্তরে বুঝতে পারছি এগুলো আপনার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি । থাক সে প্রসঙ্গ । রমানাথ রায়ের কথা যখন উঠলোই , এই অবসরে বরং আপনার কাছ থেকে একটু জেনে নেওয়া যাক হাংরি আন্দোলনেরই প্রায় সমসাময়িক রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ দের ‘ শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন ‘  সম্পর্কে । হাংরি আন্দোলনের ঠিক পাশাপাশি এই আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী ? আরো একটু নির্দিষ্ট বিন্দুতেই আসা যাক । ধরুন আপনার সম্পাদিত পত্রিকা ‘জেব্রা ‘র সঙ্গে সেইসময় শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ‘ এই দশক ‘ এর দৃষ্টিভঙ্গী ও লেখা নির্বাচনে ঠিক কী ধরনের মিল-অমিল আপনি চিহ্নিত করবেন ?

মলয় : শাস্ত্রবিরোধিরা গল্প লেখায় প্রশংসনীয় কাজ করেছেন সেসময়ে । হাংরি আন্দোলনে কেবল সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত গল্প বা ফিকশানাল ন্যারেটিভ লিখতো । সুবিমল লিখেছে বাঙাল বুলিতে আর ডায়াসপোরিক বাংলায় । সুভাষ ঘোষ লিখেছে ক্রিপটিক ডিকশানে । কেবল বাসুদেব দাশগুপ্ত যে ধরণের গল্প লিখেছে তার সঙ্গে শাস্ত্রবিরোধিদের তুলনা করা যায় । আমি, ফালগুনী, অরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার অনেক পরে ফিকশান লেখা আরম্ভ করি । জেব্রার মোটে দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, শাস্ত্রবিরোধিদের বহু পত্রিকা আর বই প্রকাশিত হয়েছিল । 

সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা গভীরতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী  কবি কে বা কে কে? কার কার নাম করবেন ? 

মলয় : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত । আমি এনাদের সবায়ের সম্পর্কে লিখেছি । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার মূল্যায়ন আমিই প্রথম করেছিলুম, কিন্তু উনি যতোদিন বেঁচেছিলেন আমাকে গালমন্দ করে গেছেন, এমনকী নিজের মেয়েকেও বলে গিয়েছিলেন যে উনি মারা যাবার পর ওনার মেয়ে যেন তা বজায় রাখেন । হয়তো ওনার নাতিও বড়ো হয়ে তা বজায় রাখবে ।

সজ্জ্বল : খুব স্পষ্ট এবং খোলাখুলিভাবে জানতে চাইছি মলয়দা , হাংরি আন্দোলনের ভাষাতেই জানতে চাইছি , জীবনের এই প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে আপনি কী মনে করেন ? তরুণ হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরীর ” প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” তদানীন্তন থেকে প্রবহমান বাংলা কবিতায় আদৌ কিছু কী ‘ছিঁড়তে’ পেরেছিল , বা পারল ? 

মলয় : এটা বাঁকবদলের কবিতা । অনেকে বুঝতে পারেনি ‘ছুতার’ শব্দটা কিসের দ্যোতক ! এই কবিতার প্রভাবে বাংলা কবিতার শব্দভাঁড়ারে অভূতপূর্ব সব বদল ঘটে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শব্দভাঁড়ারকে বর্জন করার ফতোয়া ছিল কবিতাটা । দানিয়েলা কাপেলো আর শীতল চৌধুরী এই কবিতাটার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাংলা কবিতায় কেমন প্রভাব ফেলেছে । দানিয়েলার বিশ্লেষণ পাবে অ্যাকাডেমিয়ার সাইটে । শীতল চৌধুরীর প্রবন্ধটা নেট সার্চ করলেই পাবে।

সজ্জ্বল দত্ত : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ শয়তানের মুখ ‘ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে । কৃত্তিবাসের কর্ণধার যিনি ছিলেন তার সঙ্গে তখন আপনার সম্পর্কের রসায়ন যাইই থাক , পরবর্তীকালে তার গোটা জীবনের সাহিত্য কর্মকাণ্ড এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা ও প্রকাশনীর সাহিত্যধারার ওপর বড় করে আলো ফেললে পরে কখনো কি আপনার মনে হয়নি যে আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি আপনার  আদর্শগত জায়গার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করা কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ?

মলয় : কৃত্তিবাস তখনও মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হয়নি । সুনীল তখনও পত্রিকাটা কৃত্তিবাসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আনন্দ বাগচীর থেকে ছিনিয়ে নেননি । আনন্দবাজারে সুনীল ঢোকার পর কৃত্তিবাস পালটি খেয়ে যায় । আমার ‘রাহুকেতু’ আর ‘চাইবাসা আবিষ্কার’ উপন্যাস পড়লে ব্যাপারটা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে । আমার স্কুলে পড়ার সময় থেকে সুনীল আমাদের পাটনার আর উত্তরপাড়ার বাড়িতে আসতেন । সুনীল যখন বেকার তখন দাদা কৃত্তিবাস চালাবার খরচ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বইতে পাবে । সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’ দাদা ছাপিয়েছিলেন ‘সাহিত্য প্রকাশক’ নামে প্রকাশনার নাম দিয়ে। তাই বইটা কৃত্তিবাস থেকে বেরিয়েছিল বলে আমার অবস্হানের কোনো বদল ঘটেনি । সুনীল অবশ্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমার আর দাদার কাছে কবিতা চাননি ।

সজ্জ্বল : এটা কিন্তু আজ সর্বস্তরেরই সাহিত্যপাঠক বিদিত একটি সত্য যে হাংরি আন্দোলন তাৎক্ষণিক একটা হৈচৈ পাঠকমহলে তৈরী করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত এই সাহিত্যআন্দোলন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং  সমাজমানসে দীর্ঘ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি । এর কারণ কী বলে মনে করেন ? অন্ত:সারশূন্যতা ?

মলয় : তোমার বোধহয় জানা নেই যে এই আন্দোলন নিয়ে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় আর বিদেশি ভাষায় গবেষণা হয়েছে আর এখনও হচ্ছে । এখনও পিএইচডি আর এমফিল করছেন অনেকে । ইতালি থেকে দানিয়েলা কাপেলো এসে তথ্য সংগ্রহ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডক্টরেট করেছেন জার্মানি থেকে । ওনার গবেষণার বইটা ইংরেজিতে প্রকাশের তোড়জোড় চলছে । উনি ফালগুনী রায় সম্পর্কে বাংলায় যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেটা আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি । সম্প্রতি  ইংরেজিতে পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা বই বেরিয়েছে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে । রাহুল দাশগুপ্ত আর বৈদ্যনাথ মিশ্র দুজনে একটা ইংরেজি সংকলন প্রকাশ করেছেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকা নিয়ে জুলিয়েট রেনল্ডস ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ’ নামে একটা বই লিখেছেন ২০১৮ সালে । জনমানস বলতে তুমি বোধহয় কফিহাউসের আড্ডাবাজদের বোঝাতে চেয়েছো ।

সজ্জ্বল : ঠিক তা নয় । একটু আগেই এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বললেন “এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হবে” । আপনার ওই বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন যদি আপনার কবিতা তথা সমগ্র হাংরিকবিতা হয়, তবে এখনকার পশ্চিমবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘Gungshalik school of poetry’ কে সরিয়ে ‘আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও’ কিংবা ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়’ –এর মতো লাইনের কবিতাধারা পুরোপুরি বা অংশতঃ কোনোভাবেই কি ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিম কবিতা হয়ে উঠতে পারতো না ? ঠিক যেমন ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের রোম্যান্টিক কবিতাধারাকে ঠেলে সরিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এজরা পাউণ্ড , এলিয়ট , ইয়েটস্ – দের modern movement কবিতাধারার মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠতে পেরেছিল , colonial literature ধারাকে পরবর্তীতে ঠেলে সরিয়ে আফ্রিকায় চিনুয়া আচেবে বা যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকায় সলমন রুশদি ও গার্সিয়া মার্কেজরা তাদের post colonial literary movement কে অনেকখানি মেইনস্ট্রিম করে যেতে পেরেছিল ? … জনমানসে প্রভাব বলতে হাংরি সম্পর্কে এটাই জিজ্ঞাস্য ।

মলয় : কবিতার মেইনস্ট্রিম সরকার আর অকাদেমির সমর্থন ছাড়া হয় না । এখন কবিতার মেইনস্ট্রিম মানে চটিচাটার দল । তবে, তার বাইরে আমাদের প্রভাব লক্ষণীয়, অন্তত ফেসবুক আর ব্লগজিনগুলোতে নজরে পড়ে । ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের লিফলেট আর লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের তুলনা করা উচিত নয় । আমার তো প্রকাশকই জোটে না । গাঙচিল নামে এক প্রকাশনার কর্ণধার বললেন, “আপনার বই কেন ছাপবো ? আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোবে না” । মেইনস্ট্রিম ফিকশান হতে হলে, যে বিদেশিদের নাম তুমি করলে, বড়ো প্রকাশনা দরকার, অনুবাদক দরকার, রিভিউকার দরকার । হাংরি আন্দোলনের কারোরই সেসব জোটেনি । বাংলা থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ না হলে ওনাদের মতন নজরে পড়া অসম্ভব । ইংরেজিতে অনুবাদের পরও রিভিউকারদের নজরে পড়া দরকার, নেটওয়র্কিঙ দরকার । শঙ্কর, সুনীল প্রমুখের বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু বিদেশে আলোচিত হয়নি । 

সজ্জ্বল : একবিংশ শতকের লেখক-কবিদের উপর হাংরি প্রভাব কতটা পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মলয় : এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । এসব গবেষকরা বলবেন ।

সজ্জ্বল : ঠিক দু’বছর আগে হাংরি পরবর্তী বাংলা কবিতার আর এক আন্দোলন ” শতজল ঝর্ণার ধ্বনি “র অন্যতম প্রধান মুখ কবি দেবদাস আচার্য এই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকাতেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন ” প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নয় , সঠিক শব্দটা বোধহয় হওয়া উচিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ” । আপনি এই দুই শব্দের মধ্যে কোনটা পছন্দ করবেন? 

মলয় : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । উনি বোধহয় প্রতিষ্ঠান বলতে সংবাদপত্রের কথা বলতে চেয়েছেন । প্রতিষ্ঠান বলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে, অর্থনৈতিক কঙগ্লোমারেটদেরও বোঝায় । আমি ফেসবুকে এই পোস্টটা দিয়েছিলুম, দেখেছো কিনা জানি না : “গৃহবধূর চটি মারার সাবাশি বিষয়ক: –সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য রাজনৈতিক চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।” বিরোধিতা না করলে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র নামের ডিকটেটরশিপে পরিণত হবে ।

সজ্জ্বল : আপনার সাহিত্য জীবনের প্রায় গোটাটাই বাংলার বাইরে কেটেছে। ২০১৩ সাল নাগাদ একবার কোলকাতায় এসে কিছুদিন এখানে থাকার চেষ্টা করেও অবশেষে ফিরে গিয়েছেন। সাহিত্য জগতে আজীবন নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আপনাকে কোথাও হতাশ করে? নাকি তা শাপে বর হয়েছে?

মলয় : না । কলকাতায় যতোদিন পিসেমশায় ছিলেন ততোদিন মাঝে-মাঝে গেছি । পিসেমশায় আত্মহত্যা করার পর পিসিমা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোতরঙ চলে গেলেন । কলকাতায় তো কোনও আত্মীয় স্বজন ছিল না তাই আদিবাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খণ্ডহরে গিয়ে থাকতে হতো। উত্তরপাড়ায় ইলেকট্রিসিটি আর জলের কল ছিল না, ঠাকুমার হবিষ্যি খেতে হতো, নয়তো মুড়ি-মুড়কি, সেসময়ে খাবার হোটেল ছিল না উত্তরপাড়ায় । ১৯৮৮ সালে নাকতলায় একটা ফ্ল্যাট কেনার পর নিয়মিত থেকেছি । ১৯৯৫ সালে কলকাতা অফিসে বিভাগীয় আধিকারিক হয়ে গিয়েছিলুম । ওই সময়েই দাদা হাওয়া-৪৯ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । ১৯৮৮ এর আগে বারুইপুরে উত্তম দাশের বাড়িতে গিয়ে থাকতুম । ১৯৮৫ নাগাদ উত্তম আমার বেশ কয়েকটা বই প্রকাশ করেছিলেন । আমি আর উত্তম সন্ধ্যাবেলায় কেদার ভাদুড়ির ঘরে মদ খেয়ে নাচার আড্ডা জমাতুম । ওদের কাজের মাসি খুব ভালো মাছ রাঁধতে পারতেন । আসলে আমি সাহিত্যসভা বা কফিহাউসে যাতায়াত করিনি বলে তোমার মনে হচ্ছে কলকাতায় থাকিনি । কলকাতায় চাকরি করার সময়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে চষে ফেলেছিলুম । নামগন্ধ আর নখদন্ত উপন্যাসে সেসব অভিজ্ঞতা পাবে । নামগন্ধ উপন্যাসে আলুচাষের রাজনীতি আর নখদন্ত উপন্যাসে পাট চাষের রাজনীতি নিয়ে লিখেছি ।

সজ্জ্বল : হাংরি লেখালেখির বাইরে যে বাংলা সাহিত্য সেখানে সাহিত্যিক হিসেবে আপনার পছন্দের মানুষ কারা?

মলয় : অনেক, অনেক, অনেক । বিশেষ করে তরুণদের লেখা আমার ভালো লাগে ।

সজ্জ্বল : একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক মলয় রায়চৌধুরীকে কীভাবে মনে রাখবে বলে আপনি মনে করেন ?

মলয় : মনে রাখার দরকার তো নেই ! দুশো-তিনশো বছর আগের কবিদের অনেককেই কেউ মনে রাখেনি, অনুসন্ধানী গবেষকরা ছাড়া ।

সজ্জ্বল : সম্প্রতি জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ আমাদের বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য খানিকটা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এমত পরিস্থিতিতে মলয় রায়চৌধুরীর ঈশ্বরভাবনা জানতে ইচ্ছে করে। 

মলয় : হিন্দুধর্মে ঈশ্বর বলে কিছু নেই । ওটা এসেছে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আর ব্রাহ্মরা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। হিন্দুদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই পূজ্য । তাই আমাদের আছেন দেবী-দেবতারা । আমি কোনো কালে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনি, গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরী ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য হয়েও । জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের বিস্ময় আর জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে ; ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই ।

সজ্জ্বল : মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আপনার চেতনায় মৃত্যু কীভাবে ধরা দেয়?

মলয় : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবার দরকার নেই । বরং অসুখে পড়লে হাসপাতালের আর দাহ করার খরচ কেমন করে মেটানো হবে সেটাই চিন্তার। 

সজ্জ্বল : দীর্ঘ বিরাশি / তিরাশি বছরের ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয় আজ? কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে হয়? জীবনকে বদলে নিতে ইচ্ছে করে? 

মলয় : হ্যাঁ। বাবাকে মুম্বাই নিয়ে আসিনি বলে রিগ্রেট হয় । এখানে ওনার ভালো চিকিৎসা করাতে পারতুম । ইন ফ্যাক্ট, আমরা বুড়ো-বুড়ি মুম্বাই চলে এসেছি চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার জন্য ।

সজ্জ্বল : এই প্রজন্মের নবীন কবিকে পোড় খাওয়া বরিষ্ট কবি মলয় রায়চৌধুরী কী উপদেশ দিতে চাইবেন?

মলয় : বিন্দাস লিখে যাও । কে কী বলছে ভাবার দরকার নেই ।

সজ্জ্বল : ভালো থাকবেন মলয় দা। পত্রিকার পক্ষ থেকে আরও একবার ধন্যবাদ এবং নমস্কার জানাই।

মলয় : তুমিও ভালো থেকো, সুস্হ থেকো আর আমার অন্তত একটা উপন্যাস পোড়ো, বন্ধুদের পড়িও । তোমরা তো আমার কোনো বই পড়োনি বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের পত্রিকাও দীর্ঘ জীবন লাভ করুক।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান