নাসের হোসেন নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

নাসের : হাংরি আন্দোলনের শুরু ১৯৬১ । প্রথম ইশতাহার আপনি প্রকাশ করেন । চারজনে শুরু করেছিলেন ; তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া ), শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর আপনি নিজে । কিন্তু সমীরদার অনেক লেখাতে পড়েছি, হাংরি বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক আগে থেকেই আপনি ও সমীরদা এ-ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিলেন । সমীরদা চাইছিলেন উপযুক্ত সময়ে আলোচনাটা শুরু করতে । ঠিক কোন সাল থেকে এ-ব্যাপারে আপনার ও সমীরদার কথাবার্তা শুরু হয়েছিল ? আপনি তখন কলেজে অর্থনীতির ছাত্র । আপনার স্পেশাল পেপার ছিল ইনডিয়ান ইকোনমিক্স । এটা কি ১৯৫৯ সাল ? সমীরদা ও আপনার মধ্যে এই সময়ই প্রথম হাংরি সম্পর্কিত আলোনা শুরু হয়েছিল ? সেই সময়ে সাহিত্য পরিস্হিতি ও রাজনৈতিক পরিবেশ ঠিক কীরকম ছিল ? একটু বিস্তৃত করে যদি বলেন, ভালো হয় ।

মলয় : হ্যাঁ, সান্মানিক স্নাতকে আমি মার্কসবাদে আগ্রহী হই । দাদা মার্কসবাদে আগ্রহী হয়েছিলেন পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থাকার সময়ে, আমার ছোটোমামার প্রভাবে । তবে আমরা দুজনেই বইপড়ুয়া মার্কসবাদী ছিলুম । ওই দেশগুলোয় যা ঘটছিল তাতে আমাদের অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ; আর তিরিশ বছরে পশ্চিমবাংলায় যা ঘটালেন মার্কসবাদীরা, আমাদের ভাবনাকে বলা চলে প্রফেটিক ।

সময়টা ১৯৫৭-৫৮ হবে । না, স্নাতকোত্তরে আমার স্পেশাল পেপার ছিল MONEY, জানি না এই শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ আছে কিনা । ইনডিয়ান ইকোনমিক্সও একটা পেপার ছিল যাতে আমি সবচেয়ে বেশী মার্কস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড করেছিলুম ।

দাদার চাকুরিস্হল ধানবাদে দাদার কবি-বন্ধু দীপক মজুমদারের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তিনি আমাকে ‘ইতিহাসের দর্শন’ পড়তে বলেছিলেন । আমি বিষয়টা নিয়ে একটা গদ্য তৈরি করেছিলুম যেটা দাদা ওনার বন্ধু বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে সম্পাদনা করতে দিয়েছিলেন । পরে এই লেখাটা ”বিংশ শতাব্দী” পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল ।

নানা বিষয় নিয়ে দাদার সঙ্গে আলোচনা চলত । ক্রমশ আমরা বাঙালির সংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনা করতে থাকি আর সেখান থেকে সাহিত্য আলোচনায় । বস্তুত হাংরি আন্দোলনের তাত্বিক আইডিয়াটা ওই ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই ‘দি ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ থেকে পেয়েছিলুম । দার্শনিক বনেদ আর হাংরি শব্দটা সম্পর্কে আমরা দুজনে একমত হবার পর ১৯৬১ সালে দেবী রায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাটনা এলে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা ফাইনালাইজ হয় । শক্তিদার পড়াশুনা বিশেষ চিল না বলে আমাদের একটা প্রাথমিক দোনামনা ছিল, কিন্তু আমাদের মধ্যে তিনিই অধিকতর পরিচিত ছিলেন ।

সে-সময়ের সাহিত্যিক পরিবেশকে বলা যায় অনেকটা ক্লোজড ডোর ধরনের মানদণ্ড বা ক্যানন নির্দেশিত । লক্ষ করলে দেখবে হাংরি আন্দোলনেই প্রথম কবিতার ডিসকোর্সের গুরুত্বের কথা বলা হল, যে কারণে তার পর থেকে প্রতিটি দশক নিজের ডিসকোর্স উপস্হাপন করে চলেছে , যাতে তাদের ভাঙনরেখাকে স্পষ্ট করে তোলা যায় । রবীন্দ্রনাথের পর যে আধুনিকতাবাদীরা আমাদের সামনে উদয় হলেন, তাঁরা, কী বলব, উন্নাসিক শব্দটা ব্যবহার যুৎসই হবে । সম্ভবত ইংরেজি শিক্ষার গোমর । রবীন্দ্রনাথকে যেকোনো কবি অ্যাপ্রোচ করতে পারতেন, তিনি খোলাখুলি মতামত দিতেন । কিন্তু তাঁর পরে যাঁরা এলেন, তাঁরা ব্লকেড খাড়া করার সাহিতভিক উন্নাসিকতা নিয়ে এলেন, যেন ওনারাই নান্দনিক সংস্কৃতির মালিক । এই জিনিস চালু করে গিয়েছিল ইংরেজরা, যে-কারণে আমাদের দেশের প্রান্তিক সমাজের সাহিত্য একেবারে মুছে গেছে, এমনকি সেসব বইপত্র-পুঁথি-পাঁচালি আর পাওয়া যায় না ।

রাজনৈতিক পরিবেশকে বলা যায় ভয়াবহ । দাঙ্গা আর দেশভাগের পর উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবাংলার যে উনিশ শতকি রেনেসঁসি বনেদ ছিল তা ধ্বংস হয়ে গিয়েচিল ; উদ্বাস্তুরা চাইছিলেন রিরুটিং যা করতে গিয়ে তাঁদের প্রাক-দেশভাগ মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার প্রয়াস করতে হচ্ছিল । এই সময় একদল সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছিল যাঁরা স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ বা এই স্বাধীনতা মিথ্যা, আর ট্রামে-বাসে বোমা মারামারি পোড়ানো ইত্যাদি কাজে মন দিয়েছিলেন । মজার ব্যাপার হল, এঁরাই পরে মসনদ দখল করে দিব্বি আয়েস করেছেন । সেই যে সর্বব্যাপী অধঃপতন শুরু হল তা নিয়ে এলো সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য । এই বাঁকবদলের কধাই বলেছিলেন স্পেংলার । ফলে হাংরি আন্দোলন ছিল অবশ্যম্ভাবী । আমরা না করলে, অন্যেরা, যারা ওই জৈবিক মোচড়টা টের পেয়েছিল তারা নিশ্চয় করত । কেউ না কেউ করতই । সময়-পরিসরের খেলাটা কেমন দ্যাখো । ওই সময়েই বিধান রায় মারা গিয়ে মসনদে বসলেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন । আর বামপন্হীরা আন্দামানকে একটা বাংলাদেশ হয়ে উঠতে দিল না ।

নাসের : হাংরি আন্দোলন মামলায় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন দেবী রায় । তাঁর নাম দেখেই কি আপনারা হারাধন ধাড়ার নাম রেখেছিলেন দেবী রায় ? দেবীদার সঙ্গে ঠিক কী ভাবে সন্মিলনটা গড়ে উঠেছিল ? আমরা আপনাদের সখ্যের ব্যাপারটা এবং হাংরি সম্পর্কিত কর্মোন্মাদনার জায়গাটা জানতে চাইছি । যতটা স্মৃতির ভেতরে যাওয়া যায় যাবেন ।

মলয়: না হে । আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর মকদ্দমাটা দায়ের হয়েছিল ১৯৬৪ সালে । পুলিশের দপ্তরে কে কী তা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ ছিল না । আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে দেবী রায় সম্ভবত প্রথম নিম্নবর্গের কবি এবং স্বাভাবিক কারণেই তার পদবি যে অন্তরায় হবে তা তুমি কবিতা, ধ্রুপদী, একক, উত্তরসূরী, কৃত্তিবাস, শতভিষা পত্রিকাগুলোর পাতা ওল্টালেই টের পাবে । ওই পত্রিকাগুলোর সম্পাদক কাদের লেখা বাদ দিতেন তা নিয়ে একটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা অত্যন্ত জরুরি । তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে সাহিত্যিক ক্যাননগুলো সামাজিক-রাজনীতির ক্ষেত্রে কী ভাবে প্রয়োগ হতো । দেবী রায় এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তন করেছিলেন । তবে, আমাদের বিরুদ্ধে মকদ্দমা দায়ের হবার সময়ে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার দেবী রায়কে কলকাতার তৎকালীন কর্তারা বুঝিয়েছিলেন যে কবি দেবী রায়ের নামটা তাঁর নকল । ডিসি ডিডির সৌভাগ্য যে হাংরি আন্দোলনের জন্য তাঁর নামটা ভবিষ্যতে সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখ করা হবে, নয়তো তিনি নকশাল দমনকারী ক্যালিগুলা হয়েই থেকে যেতেন ।

একটা কথা তুমি বলো আমায় । বিনয় মজুমদারকে অকাদেমি পুরস্কার দিতে এত দেরি হল কেন ? ওনার আগে যাদের দেয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগ লেখক-কবিদের তো আমরা ইতিমধ্যে ভুলেগেছি । তাও হেলা-ফেলা করে দেয়া হল, কেন ? তিনি কি সামাজিক-রাজনীতির শিকার হলেন, নাকি পুরস্কারদাতা কবিদের ভয় ছিল যে বিনয় ওনাদের অতিক্রম করে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করেছেন ? পাঁচ লাখি আনন্দ পুরস্কারও বিনয়ের প্রাপ্য ছিল না কী ? উনি ডিজার্ভ করতেন, আর ওনার প্রয়োজনও ছিল । ওনার সম্পর্কে কারা লেখালিখি শুরু করলেন, কারা ফিল্মের স্মৃতিতে তুলে রাখলেন ওনাকে ? যাকগে, কী আর হবে এসব আলোচনায় !

দেবী রায়কে আমি খুঁজে পাই একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দপতরে । আমার শৈশব কেটেছে ছোটোলোকদের পাযা ইমলিতলায়, আর দেবীর বাড়ি গিয়ে দেখলুম হাওড়ার ইমলিতলা । ধাড়া পদবিও আমাকে প্রভাবিত করেছিল, কেননা আমি জানতুম যে এই ধরনের প্রান্তিক লেখক লর্ড ম্যাকলের দয়ায় বাংলা সাহিত্যে তখনও পর্যন্ত ডিবার্ড । শক্তিদাও ওই সময়ে একটা বস্তিতে থাকতেন । সুবিমল বসাক যোগ না দেয়া পর্যন্ত কলকাতায় প্রধান কাজটা দেবীই করত । প্রথম ইংরেজি বুলেটিনগুলো আমি ইংরেজিতে ছাপিয়ে দেবীকে পাঠাতুম আর দেবী সেগুলো বিলি করে ঝড় তুলত । সুবিমল যোগ দেবার পর একটা সুবিধে হল যে ও সেই সময়ে ইনকাম ট্যাক্স দপতরে ছিল আর বিশেষ কাজকর্ম ছিল না । আর সে-সময়ে স্টেনসিল করার সুবিধা ছিল । সুবিমল স্টেনসিলে ড্রইং এঁকে রেগুলার বুলেতিন বের করত, তাতে নম্বর-টম্বর দেয়া ধাকত না । এই স্টেনসিলে আঁকা ড্রইং  সে-সময়ের প্রেক্ষিতে আক্রমণাত্মক ছিল । তিনটে ড্রইং আমার মনে আছে । একটায় একজনের দেহ জুড়ে কাঁঠালগাছে কাঁঠালের মতন স্তন ঝোলানো, ইন্দ্রকে যেমন অভিশাপ দেয়া হয়েছিল তার সারা গায়ে যোনি গজাবে, পরে ইন্দ্র সেটা মুকুব করিয়ে যোনির বদলে চোখ করিয়ে নেন । আরেকটা ছিল আপাতদৃষ্টিতে ফুলদানি যা আদপে একজোড়া নারী-পুরুষের সঙ্গম । একটা ছিল নারী-পুরুষের পায়ের পাতা যা দেখে টের পাওবা যায় তারা কোন কাজে লিপ্ত । ওই ম্যাকলেপুত্রদের আবহে এই ধরনের বুলেটিন কেমন উথালপাথাল ঘটিয়ে থাকবে তা এখন বোঝা মুশকিল ।

কোনো-কোনো আলোচক দেখি নিজেরাই হাংরি বুলেটিনের নম্বর দিয়ে নিচ্ছেন, অমুকটা অত নম্বর, তমুকটা তত নম্বর উত্যাদি । কত বুলেটিন যে বিনা নম্বরে বা উল্টো-পাল্টা নম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল তার হিসেব আমরা নিজেরাই রাখিনি । আসলে হাংরি ব্যাপারটাকে বুঝে উঠতে পারেননি তাঁরা ।

তারপর ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ বাক্যটা কাগজের মুখোশে ছাপিয়ে বিলি, জন্তু দেব দেবী রাক্ষস ইত্যাদি । দেবীর অবদান ছাড়া এটা ঘটানো যেত না । কলকাতাকে তোলপাড় করে দিয়েচিল, তার কারণ সবাই তো মুখোশ পরে বসেছিল ; এখনও আছে অবশ্য, আরও ভয়ংকর দানবীয় মুখোশ । ইউ টিউবে দেখলুম , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরিফকে বলছেন যে হাংরিরা সবাইকে বলত মুখোশ পরে নাও । আরে ! আমরা বলেছিলুম , মুখোশ খুলে ফেলুন । পরে নিন বলিনি । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে উনি এত বেশি প্যারানয়েড ছিলেন যে আসল ব্যাপারটাকেও গোলমাল করে ফেলতেন ।

সন্দীপনদা একটা অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন দেবী রায়কে, যার টেক্সটের ভেতরে আরও অনেককে লেখা চিঠি ছিল ; এটা ওনার একটা গদ্য যা উনি হাংরি বুলেটিন বা পত্রিকায় ছাপাবার জন্য দিয়েছিলেন । দেবী রায়ের বাড়ি সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা দিয়ে এসেছিলেন । চিঠিটা উনি অন্যান্যদেরও পাঠিয়েছিলেন, প্রত্যেকের নাম বিভিন্ন রঙিন পেনসিল দিয়ে আনডারলাইন করা, যার যেমন চরিত্র তাকে তেমন রঙ দিয়েছিলেন । সুনীলদা চিঠিটা পেয়ে চটে গিয়েছিলেন, ওনার হাংরি প্যারানয়ার দরুণ । সন্দীঈপনদাকে আমেরিকা থেকে লেখা ওনার চিঠিতে উষ্মার তাপ টের পাবে । চিঠিটা দেবী রায়কে সম্বোধন করে লেখা । কিন্তু সুনীলদা সন্দীপনকে উত্তর দেবার সময়ে উল্লেখ করেছেন হারাধন ধাড়ার নাম । স্পষ্ট যে ব্রা্হ্মণ সম্পাদকের অবচেতনে কাজ করেছে এই বোধ যে নিম্নবর্গের লোকেরা সাহিত্যের আসরে কাজ করার যোগ্য নন ।

আমার মকদ্দমার সময়ে গিন্সবার্গ আমার সমর্থনে অনেককে চিঠি দিচ্ছিলেন বলে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অনেকে গিন্সবার্গকে আমার বিরুদ্ধে নানা কথা লিখছিলেন— এসব আমি জানতে পারলুম গিন্সবার্গ অছি পরিষদের কর্তা বিল মর্গানের কাছ থেকে, যিনি নাকতলায় আমার বাসায় এসেছেন আর গিন্সবার্গের লেখা চিঠির সংকলন প্রকাশ করেছেন ।

আমরা কয়েকজন একত্রিত হতুম কোথাও ; সাধারণত কলকাতার বাইরে যেতেই ভালবাসত সবাই । তাই বলে কোনো সভাঘর ধরণের ব্যাপার ছিল না । অর্থাৎ সবাই মিলে কোথাও একত্রিত হইনি কখনও । একটা ব্যাপার পেছন ফিরে ভাবলে মজার মনে হয় । নিজের লেখাটা কিন্তু সকলেই লুকিয়ে লিখত আর ছাপাবার আগে এনে হাজির করত । সুভাষ ওর ”আমার চাবি” বইয়ের গদ্যগুলো ওর রুমমেট শৈলেশ্বরের সামনে বসেও লিখত না । লিখত গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে একটা বারে বসে, সম্ভবত অ্যাম্বার নাম ছিল বারটার । আমি সেখানে পৌঁছে দেখতুম যে ওর লেখা কমপ্লিট । তারপর মদ খাওয়াবার খরচ আমাকে বইতে হতো ।

নব্বুই দশকে যখন কলকাতায় এলুম তখন দেখি যে সুভাষ কমবয়সী চ্যাংড়াদের নিয়ে দল গড়ে ফেলেছে । তারা ওর সমালোচনা করার বদলে তোল্লাই দিয়ে ওর গদ্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে । এক চ্যাংড়া আমায় একদিন বলল, ”না হয় ধরেই নিলাম যে হাংরি মামলা হয়েছিল, কিন্তু তা কেবল আপনার বিরুদ্ধে হয়েছিল তার তো প্রমাণ নেই।” বুঝলুম যে সুভাষ একখানা গল্প বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে আমার অবর্তমানে । স্কাউন্ড্রেল চ্যালাটা এটাও জানত না যে কারা-কারা রাজসাক্ষী হয়েছিল, পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল । তখন আমি ‘হাংরি কিম্বদন্তি’ বইটা বের করলুম যাতে আসল ব্যাপারটা পাঠকরা জানতে পারেন ।

অবনী ধরের গল্প বলি তোমায় । স্কুলের গণ্ডী পেরোয়নি বলে আমাদের সঙ্গে সেরকমভাবে মিশতে পারত না । বাবা আরেক বোষ্টমিকে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন । অবনী স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই চলে গেল জাহাজে খালাসির কাজ করতে । মা একলা হয়ে গিয়েছিলেন বলে ফিরে এসে হেন কাজ নেই যা করেনি ; কয়লা বেচা থেকে ঠেলাগাড়ি চালানো । কলকাতায় বস্তিতে থাকত । তারপর অশোকনগরে উদ্বাস্তুদের বরাদ্দ বাসা পেল । বিয়ে করল । সংসার চলত মূলত স্ত্রীর মামুলি চাকরির মাইনেতে । ছেলে আর মেয়ে হল । তাদের স্কুল-কলেজে পড়িয়ে বিয়ে দিল । ছেলে আলাদা হয়ে গেল । অবনী আর ওর স্ত্রী ফের ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান । ওর গদ্যগুলো পড়ে না থাকলে পড়ে দেখো, একেবারে অন্য ফ্লেভারের লেখা । নেশা করত না । আমি কলকাতায় এসে শর্মী পাণ্ডেকে বলে ওর সবকটা গদ্য দিয়ে একটা বই প্রকাশ করিয়েছি , কেননা ওর লেখাপত্র হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল । হাংরি আন্দোলনকারী ছিল অথচ কেউ ওকে গুরুত্ব দিল না, বিশেষ করে ওর কাছের হাংরিরা ।

নাসের : এ-বছরে ‘হাওয়া ৪৯’ ( জুলাই ২০১৩ ) পত্রিকায় অদ্রীশ বিশ্বাসের একটা চিঠি বেরিয়েছে, যা পড়ে বোঝা যায় যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থাকাকালীন হাংরির সামগ্রী ও ক্রিয়াকলাপ উনি পছন্দ করছেন না । যদিও বন্ধুসুলভ একটা নমনীয়তাও ছিল এ-ব্যাপারে । সেই মর্মে অদ্রীশের ওই চিঠি । এ-ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন ।

মলয়: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আমেরিকায় তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে ; নানা পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, এমনকি আমেরিকা-ইউরোপেও । তিনি বেশ কয়েক জায়গায় লিখেছিলেন যে তাঁকে বাদ দেবার জন্য ও তাঁর ও কৃত্তিবাস-এর বিরোধীতা করার জন্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে । এত জ্ঞানী-গুণি হয়ে কী করে অমন আবেগে বয়ে গেলেন বিশ্লেষণ করা কঠিন । ওই চিঠির সঙ্গে অদ্রীশ দাদাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা চিঠির কপি, যা সুনীল লিখেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে, তা পাঠিয়েছিলেন । অদ্রীশ ওই চিঠিটায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে । সুনীলদা আমাকেই আক্রমণ করে গেছেন সুযোগ পেলেই , হাংরি আন্দোলনের কারণে । পরে যারা হাংরি আন্দোলন রিভাইভ করার চেষ্টা করল, তাদের আক্রমণ করলেন না । তার মানে ওনার মনে হয়ে থাকবে যে যারা রিভাইভ করতে চাইল তারা আগের আগ্নেয়গিরি নয় ; তা নিছক পাহাড়টিলা ।

চিঠিতে সুনীল সন্দীপনকে বলছেন হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করতে । তিনি সন্দীপনের কাছে জবাবদিহি চেয়েছেন যে কেন সন্দীপন মলয়কে পছন্দ করছেন, যখন কিনা মলয়ের মধ্যে সত্যিকার কোনো লেখকের ব্যাপার নেই । চিঠিটার অনেকটা জুড়ে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, কী বলব, বিষোদগার ! কৃত্তিবাস থেকে যাঁরা হাংরি আন্দোনে এসেছিলেন তাঁদের আমেরিকা থেকে চিঠি লিখে-লিখে বলছিলেন বেরিয়ে যেতে । তারপর তাঁরা বেরিয়ে গিয়ে যখন কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হলেন, তখন সুনীল তুরুপের তাসটি ফেললেন আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে, আর সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকালের জন্য বিশ্বাসঘাতক হিসাবে বদনাম করে দিলেন সন্দীপন, শক্তি, উৎপলকে ।

তিনি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে কফিহাউসে গেলে সন্দীপন-শক্তি তাঁকে চেপে ধরেন । ফলে কয়েক দিন পর তিনি দাদাকে চিঠি লিখে জানান যে কোর্টে তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন । দেশ পত্রিকায় যেমন বাজে বইকেও ভালো বলেন, তেমনই কোর্টে কবিতাটির গুণগান করেছেন, আসলে আমার কবিতাটা পড়ে তাঁর গা রি-রি করে উঠেছিল, এবং মলয় একেবারে কবিতা লিখতে জানে না, ইত্যাদি ।

সুনীল একদিকে আমার কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ প্রকাশ করছেন, আবার একই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধতাও করে গেলেন । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমি তাঁর বাড়ি গিয়েছিলুম । তখনই টের পাই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম নেতা হিসাবে দেখানো হয়েছে বলে তাঁর ক্রোধটা আমার ওপর পড়েছে । সুনীলদা আমার কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে পৃথিবীর কোন সাহিত্য আন্দোলন নেতার নাম ঘোষণা করে আরম্ভ হয়েছে তুমি আমাকে দেখাও । বলেছিলেন, নিজে আরম্ভ করেছ তো নেতা হিসাবে নিজের নাম দিলে না কেন ।

তিনি সেদিন বহু কথা বলেছিলেন যা আমি ‘রাহুকেতু’ নামে একটা উপন্যাসে লেখা আরম্ভ করেছি, ছোটোভাই রাহুল আর বড়ভাই অনিকেতদের ওই সময়টা নিয়ে লিখছি, কেননা অনেক ব্যাপার স্মৃতিকথায় লিখলে নোংরা হয়ে যেতে পারে । আমাকে তিনি প্রচুর চিঠি লিখতেন, হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার আগে । শক্তিদা, সন্দীপনদা, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখতেন । সুনীলদার মনে হয়ে থাকবে যে কেন আমি তাঁকে না জানিয়ে আন্দোলন আরম্ভ করে দিলুম, যখন কিনা সাহিত্যের আসরে তিনিই আমাকে নিয়ে এসেছেন । দাদাকে কিন্তু তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়ে কোনো চিঠি লেখেননি । সেসব চিঠিপত্র আর তাঁর ফরাসি প্রেমিকার ফোটো লালবাজার পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করার সময়ে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গিয়েছিল ।  তবু, মনে হয়, দাদার সম্পর্কেও তাঁর ক্ষোভ ছিল, হাংরি আন্দোলন আর তারপর অধুনান্তিক বাঁকবদল ঘটাবার জন্য । দাদাকে কত চিঠি লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই, দাদার প্রতিটি কর্মস্হলে গেছেন, একা বা বন্ধুদের নিয়ে বা স্ত্রীকে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে, কিন্তু সংকলন বের করার সময়ে দাদাকে ভুলে যেতেন ; স্মৃতিকথা ‘অর্ধেক জীবন’ বইতে দাদার আর চাইবাসার তেমন উল্লেখই নেই, অথচ বেশ কয়েকটা উপন্যাস তো চাইবাসার ঘটনাবলী নিয়ে ।

শক্তিদা দাদার শালি শীলার প্রেমে পড়েছিলেন আর প্রায় দুবছর ছিলেন দাদার নিমডির চালায় । শক্তিদাকে নিয়ে সমীর সেনগুপ্ত একটা ফিল্ম করার জন্য চাইবাসা গেলেন আর উল্টোপাল্টা পাড়ায় ফিল্ম তুলে নিয়ে এলেন ; দাদার সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন মনে করলেন না । আজব দেশের গজব গল্প !

হ্যাঁ, সুনীলদা আমাকে স্নেহ করতেন । আমার পক্ষে সেকারণেই তাঁকে অশ্রদ্ধা করা অসম্ভব । শক্তিদা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনিও দাদার কাছে আমার খোঁজ করতেন । একবার তো কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে আমার মৃত্যু সংবাদ পড়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন । তাঁকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে । তাঁকে আমরা নেতৃত্বের আসনে বসালুম, আর তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেছেন তা একটি সংবাদপত্র মালিককে জানাবার জন্য হাংরি আন্দোলনকারীদের মারধরের চেষ্টা করলেন একদিন কফিহাউসের সামনে । কাদের তিনি সঙ্গে এনেছিলেন জানো ? নাম শুনলে অবাক হবে । তাঁরাই বা কেন যে রাজি হয়েছিলেন জানি না ; তাঁদের তো কারো কাছে কিছু প্রমাণ করার ছিল না । তবে শক্তিদার বেশ কিছু কবিতা আমাকে টানে, যদিও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে শক্তির কবিতা সত্যেন দত্তের সরলীকরণ ।

পরে সুনীলদা কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা দেবার জন্য একবার এক তরুণের হাতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তার নাম সম্ভবত রূপক চক্রবর্তী । আর আরেকবার চিঠি পাঠিয়েছিলেন ডাকে । আমার মনে হয় সুনীলদা চিঠিগুলো কাকে লেখা হচ্ছে তা না দেখেই সই করে দিতেন । তরুণ কবিরা নিজেরাই কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপাবার জন্য অমন চিঠি তৈরি করে থাকবেন । নয়তো সুনীলদা ইচ্ছে করলেই আমাকে ফোন করতে পারতেন ।

আসলে আমেরিকায় বসে এখানকার খবরাখবর পেয়ে তাঁর মনে হচ্ছিল যে কলকাতায় সাহিত্যজগতে উথালপাথাল হচ্ছে আর উনি তাতে অংশ নিতে পারছেন না । তাই অমন নিসপিসে চিঠিচাপাটি লিখছিলেন । হাংরি আন্দোলনের পরেই কিন্তু ওনার কবিতার ধারা পুরোপুরি পালটে যায় ;  উনি তো সেই পঞ্চাশের শুরু থেকেই কবিতা লিখছিলেন । তখনকার কবিতার পাশে ওনার ষাটের কবিতাগুলো পড়ে দেখলে টের পাবে ।

নাসের : ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫, এই পর্যন্ত আপনি বলেন হাংরি আন্দোলনের মূল কার্যকর সময় । কিন্তু আমরা দেখেছি তার পরেও তো অনেকে বিভিন্ন সময়ে হাংরি আন্দোলনের অঙ্গীভূত করেছেন নিজেদের । যেমন অরুণেশ ঘোষ তো প্রায় ১৯৬৮-৬৯ সালে নিজেকে হাংরি ঘোষণা করেছেন । শৈলেশ্বর ঘোষ, অরুণ বণিক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তো বেরিয়ে গিয়েছিলেন । একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, হাংরি দর্শনের দ্বারা একবার যারা সংক্রামিত হয়েছেন সেটা তাঁদের সারা জীবনই বহন করতে হয়েছে । তাঁদের লেখার মধ্যে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গেছে । এ নিয়ে আপনার কাছে কিছু শুনতে চাইছি । পারলে একটু বেশি করেই বলুন , যাতে অনেক কথাই বেরিয়ে আসতে পারে যা আমাদের সেভাবে কিংবা একেবারেই জানা ছিল না ।

মলয় : আমি বলেছিলুম যে ১৯৬৫ সালে আন্দোলোন ফুরিয়ে যায় । ১৯৬৫ সালে সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে এজাহার দিয়েছিল যে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তারা এই আন্দোলনে বিশ্বাসী নয় ; এই আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করছে আর ভবিষ্যতে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না । ওই দিনই জানা যায় যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী ্তে রাজি হয়েছেন । আমার কেস আরম্ভ হলে দেবী, সুবিমল, ত্রিদিব-আলো, ফালগুনী ছাড়া সবাই কলকাতা থেকে কেটে পড়েছিল ।

এই ধরনের হীন কাজের পর কেউ যদি গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আবার নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে তো তুমি তাদের কী বলবে ? পত্রিকা বের করলেই কি আন্দোলন হল ? আন্দোলনের কর্মকাণ্ড কই ? এটা ঠিক যে ১৯৬৯ সালে সুভাষ, শৈলেশ্বর, বাসুদেব মিলে ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা পত্রিকা বের করে, কিন্তু তখনও নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করতে পারছিল না তারা, রাজসাক্ষী হয়ে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য চারিদিকে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল বলে । সাহস থাকলে আর সৎ হলে তো আবার হাংরি বুলেটিন বের করলেই পারত । তবে, হাংরি আন্দোলন তো আর কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি নয়, তাই যার ইচ্ছে নিজেকে হারি থেকে নাকচ করে আবার জন্ম নিতে পারে । বিট্রে করেছিল বলে ঘোষভাইদের মধ্যে নিজেদের হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা জাহির করার আদেখলাপনা চাগিয়ে উঠেছিল । শুনেছি সেসব কথা পাবলিককে জানাতে যতটা পারে ইতিহাসকে বিকৃত করে গেছে । ইত্তম দাশ ষাটের আন্দোলনগুলো নিয়ে একটা তথ্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন বলে ঘোষভাইরা উত্তম সম্পর্কেও অপমানজনক কথা বলত ।

শঙ্খ ঘোষও তাঁর ‘শব্দ ও সত্য’ বইতে ওই নামের প্রবন্ধে ইতিহাসকে ঝাপসা করেছেন । বইখানার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘ঘোলাটে শব্দ ও ঝাপসা সত্য’ । পড়েছ কি বইটা ?  ১৯৭১ সালে লেখা বইতে উনি জানতেনই না যে তার আগে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী হাংরি মামলায় আমার কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল !

ক্ষুধার্ত শব্দটা হাংরির প্রতিশব্দ হতে পারে না । আর্ত আবার কেন ? খিদেকে হীন মনে করার তো কারণ নেই । তুমি তো ছোটোবেলা থেকে বলছ, মা খিদে পেয়েছে । তাছাড়া পেটের খিদে বলে তো শেষ করা হচ্ছে না । খিদে পাওয়াটা তো আনন্দের । নিজেদের ভিকিরি লেবেল মারার আন্দোলন তো ছিল না হাংরি । কত রকমের যে খাবার হয় তা একবার কয়েকটা দেশ ঘুরলেই টের পাবে ; কত রকমের খিদে হয় তা জানতে পারবে । কেবল পেটের খিদে নয়, নানা ধরনের খিদে আর তা মেটাবার এলাহি কাণ্ড ।

অরুণেশ ঘোষ নিজেকে হাংরি ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালে, ১৯৬৮-৬৯ সালে নয় । তাঁর সঙ্গে আমার কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, তুমি শুনে অবাক হবে, তিনি কেন জানি না আমাকে এড়িয়ে যেতেন । অরুণ বণিক হাংরি থেকে বেরিয়ে যাননি, তিনি খুন হয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে । আর যারা ক্ষুধার্ত লেখালিখি করছিল তাদের মধ্যে সুভাষ কুণ্ডু, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন চক্রবর্তী, রবিউল, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর মুখোপাধ্যায়, জামালউদ্দীন, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া,  রবীন্দ্র মল্লিক, নিত্য মালাকার, সেলিম মুস্তফা প্রমুখকে আমি চিনি না । চিনি কেবল বিকাশ সরকার, সমীরণ ঘোষ, অলোক গোস্বামীকে । সন্দীপন যদিও সাক্ষ্যে আর এজাহারে বলেছিলেন উনি হাংরি আন্দোনে ছিলেন না, কিন্তু ১৯৭৫ সালে পেংগুইন বুকস যখন ”নিউ রাইটিং ইন ইনডিয়া” প্রকাশ করল, তাতে তিনি আত্মপরিচয় দেবার সময়ে লিখলেন যে  He was also responsible for starting the Hungryalist movement in Bengali, along with Shakti Chattopadhyay the poet and Utpal Basu, a writer now living in London.  সে-সময়ে সন্দীপনদা বোধহয় উৎপলকুমার বসুকে কবি বলে মনে করতেন না । বা ওই আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে একখানা চাল দিয়েছিলেন উৎপলকুমার বসুকে হেনস্হা করার জন্য । কিংবা হয়ত সত্যিই শক্তির গীতিময়তা ওনাকে আপ্লুত করত — কবিতায় উনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ করতেন না ।

সবাই হাংরি স্পিরিট ক্যারি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না । সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত সিপিএম দলে যোগ দিয়ে কার্ড হোল্ডার হবার পর ওরা ফিজল আউট করে গিয়েছিল ; ওদের পরের লেখাগুলো পড়লেই টের পাবে । সিপিএম তো ছিল খুংখার প্রতিষ্ঠান ; হাংরি হয়ে কোন তর্কে যোগ দিল তাতে ? কোনো প্রশ্ন তুলল না অবিচার-অত্যাচার সম্পর্কে, যা গ্রামে-গঞ্জে ঘটছিল সে-সময়ে ? শৈলেশ্বরও ছিল সিপিএম-এর ইসকুল মাস্টার সংগঠনে, অথচ নতুন সরকার মসনদে বসতেই ভিড়ল সেকানে । তিরিশ বছর ধরে যে নারকীয় অবস্হা কায়েম ছিল, বিশেষ করে আশির দশকের ”বামপন্হী ফ্যাসিবাদ”, সে-ব্যাপারে ছিল স্পিকটি-নট । তুলনামূলকভাবে অরুণেশ ছিলেন সৎ । বামপন্হীদের সম্পর্কে সহানুভূতি থাকলেও তাদের ছেড়ে কথা বলেননি । সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কারনেজের পর একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন ক্ষোভ ক্রোধ দুঃখ যাতনাবোধ মেলে ধরে । আমি অবশ্য বর্তমান মসনদের হয়ে কথা বলছি না ।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সুনীলদা-শক্তিদা-সন্দীপনদা সবাই ছিলেন কংগ্রেসি । বামপন্হীরা মসনদে বসতেই তাঁরা রাতারাতি হয়ে গেলেন দরবারি । সন্দীপনদা তো লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্যাঙাত হয়ে পেছন-পেছন ঘরছেন দেখেছি । অলোক গোস্বামী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, রবিউল এনারা হাংরিতে যোগ দেবার আগে যেমন লিখতেন, পরেও তাই । বিকাশ সরকার নিজের আলাদা কবিতা-শরীর গড়ে ফেলেছেন ”যুগশঙ্খ” পত্রিকায় যোগ দেবার পর ।

কিছুকাল আগে একটা ফিল্ম এসেছিল, ”বাইশে শ্রাবণ” নামে । তাতে গৌতম ঘোষ একজন হাংরি কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন । হাংরি ব্যাপারটাকে একটা গাঁজার মোড়কে উপস্হিত করেছিল ফিল্মটা । আমরা কেউ লেখা চাপাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতুম না । আমাদের উত্তরপাড়ার খণ্ডহর অমন ঘিঞ্জি ছিল না । সে-সময়ে বইমেলা নামের মেলা বসত না । বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক অংশে আগুন ধরানো হয়েছে দেখালেও না হয় সহ্য করা যেতে পারত । অনেকে, বাংলাদেশি পাঠকরাও,  বলেছিল, আপনি প্রতিবাদ করছেন না কেন । আমি ওই একই উত্তর দিতুম । হাংরি আন্দোলন তো আমার প্রায়ভেট প্রপার্টি নয় । ফিল্মটা যখন রিলিজ হয়েছিল তখন রাজসাক্ষীদের উল্লেখ ছিল । যারা শুরু করেছিল তাতে শৈলেশ্বর ঘোষের নাম ছিল না । শৈলেশ্বর পঞ্চাশ দশকের এক কবিকে ধরে পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিল যাতে রাজসাক্ষীরূপে ওকে উল্লেখ না করা হয় । দেবী রায়ের কোনো উল্লেখ না করা সত্ত্বেও ও গিয়ে ধরাধরি করেনি । হাংরি মকদ্দমায় দেবী কিন্তু কোনো এজাহারও দেয়নি ঘোষভাইদের মতন ।

সুনীলদা মারা যেতে হাংরি আন্দোলন নিয়ে কমরেড বিমান বসু যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা শুনেছিলে বা পড়েছিলে ? তা আমি কেনই বা তার প্রতিবাদ করব ? ওটা ওনার ইনটারপ্রিটেশন । ছাত্র-ছাত্রীরা এম ফিল করছে হাংরি আন্দোলন নিয়ে, এমনকি হিন্দিতেও তার প্রভাব নিয়ে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে । কোথায় কে কী লিখছেন তা তো আমি জানি না । জেনেই বা কী করব ! যার যা ইচ্ছে লিখুন । শতকে-শতকে লিখতে থাকুন ।

নাসের : ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশিত হওয়ামাত্র দর্পন, জলসা, জনতা ইত্যাদি হালকামেধা পত্রিকাসহ অমৃত, দৈনিক বসুমতী, দৈনিক যুগান্তরের মতন বহুগ্রাহ্য পত্রিকার পাশাপাশি ভাষা-সাহিত্যের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক হাংরি, অ্যাংরি, বিট, তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে এমনভাবে উল্লেখ করতেন, যেন এই তিনটি হচ্ছে একই প্রকার অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন । এই ঘটনাটি বা বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে জানতে চাইছি আমরা ।

মলয় : হ্যাঁ । জনতা, দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ-ওসকানো খবর ছাপা হতো, কার্টুন বেরোত । ওদের দপতরে গিয়ে একটু জ্ঞান পরিবেশন করার পর ওরা অমন সংবাদ ছাপানো বন্ধ করে । একটা জিনিস জেনে গিয়েচিলুম যে বেশির ভাগ সাংবাদিক আর সম্পাদকের তেমন পড়াশুনা নেই, আর তাদের কুপোকাৎ করা সহজ । যুগান্তর সংবাদপত্রে কিন্তু কৃষ্ণ ধর দুটো প্রধান সম্পাদকীয় লিখেছিলেন আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে । দর্পণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ ; তা দর্পণ-এ লেখা হল হাংরি আন্দোলন বিদেশি প্রভাবিত । ওনার বরানগরের ফ্ল্যাটে উনি ডেকেছিলেন রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাওয়াবার জন্য । আমি তৈরি হয়েই গিয়েছিলুম ভারতে আলুর আগমনের ইতিহাস নিয়ে ; তখন উনি মুচকি হাসি দিয়ে বুঝতে পারেন যে ওনাকে কোন দিকে তেনে নিয়ে যাচ্ছি । বহু আলোচক অমন আলুর দম খেয়েছেন আঙুল চুষে-চুষে আর আমাদের বলেছেন আমরা বিদেশিদের দ্বারা প্রভাবিত ।

অনেক কাগজে লেখা হচ্ছিল আমরা নাকি আত্মপ্রচার ক্ষ্যাপা । অথচ যারা তা বলছিল, পরে জানতে পারলুম যে তারা যে যার পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটো ইত্যাদি সংরক্ষণ করার ব্যবস্হা করে চলেচে । ফোটোও তোলাচ্ছে পোজ মেরে । বিমল কর সারা বাড়ি নিজের ফোটো দিয়ে সাজিয়েভ রেখেছিলেন, এমনকি ওপরতলায় যাবার সিঁড়িতেও ।

আরে ! তুমি সে-সব কেন করছ ভায়া ? মরার পর যাতে তোমার প্রচারটা তোমার হয়ে অন্যেরা করে দ্যায় ! ভাঁওতাবাজির চূড়ান্ত । ঘাড় নামিয়ে সম্বর্ধনা কেন নিচ্ছ ? যাতে তোমার প্রচার ছড়ায় । আমরা নিউজমেকার হতে চাইনি । আমরা চেয়েছিলুম সমাজে আঘাত দিতে । আমি আমার পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্রের সেফ ডিপজিট ভল্ট খুলে রেখে যাচ্ছি না ; এমনকি আমি আমার নিজের লেখা বইপত্রও আলমারিতে সাজিয়ে রাখি না । রাখিই না । তবে মকদ্দমার সময়ে উকিলদের সাহায্যের জন্য যাবতীয় কাটিংসের একটা ফাইল তৈরি করেছিলুম সেটা সুবিমলের কাছ থেকে সুভাষ ঘোষ হাতিয়ে নিয়ে আর ফেরত দ্যায়নি ।

এটা সত্যিই ইডিয়টিক যে চোখ বুজে অনেকে লিখে দিচ্ছিল যে হাংরি, বিট আর অ্যাংরিদের আন্দোলন একই ব্যাপার । কোনো রচনা কৌম-নিরপেক্ষ হতে পারে না ।  বাঙালি একটা বিশেষ কৌম, সেটাকে অস্বীকার করাটা বাঙালিকে অপমান করা । দেখবে যে বিদেশে গিয়েও বাঙালি তার বাঙালিত্ব থেকে বেরোতে পারেনি , চেষ্টা করেও ; যখন কিনা সেই দেশে ভূমিষ্ঠ তাদের সন্তানসন্ততি মুক্ত হয়ে গেছে বাঙালিত্ব থেকে আর তা তাদের বাবা-মাকে সারা জীবন কুরে ভখেতে থাকে ।

সমস্যা ছিল ওই সাংবাদিক-আলোচকদের শিক্ষা-প্রণালীতে । তাঁদের চিন্তাধারার প্রধান অন্তরায় ছিল সীমিত বিষয়ের বিশেষজ্ঞতা, মানে, কেবল বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন । তাঁরা মাল্টিডিসিপ্লিনারি দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে পারতেন না ; ফলে ব্যক্তি-একক ও তার সমষ্টিকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণ তো আর কেবল সাহিত্য দিয়ে হয় না । তাঁরা ছিলেন খণ্ডবাদী, যা আধুনিকতাবাদের চারিয়ে-দেয়া বিষের অন্যতম ।

নাসের : হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউনসিল, পলিটব্যুরো বা সম্পাদকের দপতর ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না; যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পাদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকা দপতরটি নতুন বাড়িতে উঠে যেত । হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারনাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে-কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী ও সাহিত্যিকরা ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল । এই ব্যাপারটি একটু বড়ো পরিসরে বলুন ।

মলয়: হ্যাঁ। আমাদের কোনো কেন্দ্র ছিল না । কেন্দ্র মানেই তো ক্ষমতাপ্রতাপ জাহির করার ঘাঁটি । যে পত্রিকাগুলোর নাম করলে সেগুলোর সম্পাদকের হাতে একটা করে লক্ষ্মণের লেজার বিম রেখা টানার বৈজ্ঞানিক ছড়ি থাকত ; তার বাইরে কারা আর ভেতরে কারা সেটা সম্পাদক মশায় নিজের সুপার আই কিউ দিয়ে মাপতেন । সে-সব পটপিকার সম্পাদকেরা নিজেদের গড়া ক্যানন অনুযায়ী সাহিত্যকে চালিত করে গেছেন । তাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে একরৈখিক মনে করে একটি লাইন বরাবর হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন । আমরা বললুম কলমের স্বাধীনতার কথা, যার যেমন ইচ্ছে লেখার কথা । ষাটের পর দভাখো । যে যেমন ইচ্ছে লিখছেন । কেউ আর পরোয়া করে না কে কী বলল, না বলল । আর এখন তো ইনটারনেট হয়ে কবি-লেখকরা অজস্র পাঠক-পাঠিকা পাচ্ছেন । ছড়িদারদের এলাকা সীমিত কেবল কমার্শিয়াল গ্লসির বাজারে ।

হাংরি বুলেটিন প্রথম কয়েকটা আমি লিখেছিলুম দেবীর হাওড়ার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যাতে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন । কেননা দাদা চাইবাসায়, আমি পাটনায় আর শক্তিদার কোনো পাকা ঠাঁই ছিল না । অনেকে যোগ দেবার পর যেমন ইচ্ছে বুলেটিন বের করার স্বাধীনতা ছিল । যেহেতু ফালি কাগজে বের করা হতো, তাই পকেটের রেস্ততে চাপ পড়ত না । অবশ্য খরচটা আমি বা দাদা করতুম । চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হবার ফলে মকদ্দমার সময়ে হাংরি বুলেটিনের খরচ যোগানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার পক্ষে । আর বাদবাকি সবাই তো কেটে পড়ল আমাকে চার্জশিট দেবার পর ।

ইংরেজিতে কবেকটা বুলেতিন বের করার ফলে ভারতের অন্য ভাষাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়ে গিয়েছিল । সে-সব ভাষার সাহিত্যিকরা পত্রপত্রিকায় লিখছিলেন আমাদের নিয়ে । ইংরেজিতে বেরভ করার কারণে কলকাতার সাহিত্যকর্তারা অনেকে গোঁসাঘরে হাত-পা ছুঁড়তেন । কিন্তু মামলা আরম্ভ হবার পরই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে কত জরুরি ছিল ওই কয়েকটা ইংরেজি বুলেটিন ।

নেপালের অ্যাকাডেমি কর্তা আমাদের ডেকে নিবে গিয়েছিলেন । আমি, দাদা, কাঞ্চন, করুণা, সুবিমল, অনিল আমরা সবাই কয়েকমাস ছিলুম ঠমেল নামে একটা পাড়ায় । খড়ের বিছানা । যত ইচ্ছে চরস ফোঁকো, নেপালি দিশি মদ খাও, মোষের কাঁচা মাংস খাও, হিপিনিদের সঙ্গে প্রেম করো, আর কবিতা পাঠ করো, নিজের ভাষায়, কেউ তা হিন্দিতে অনুবাদ করে দিত, আর তারপর সেটা নেপালিতে অনুবাদ করে শোনাত কোনো তরুণ নেপালি কবি । দাদা নেপালি ভাষায় একটা আংরি সংকলন বের করেছিল ।

কাঠমাণ্ডুতে যে বাড়িটায় আমরা থাকতুম তা বিরাট একখানা চালাঘরের কলোনি, মাঝখানে প্রায় একশো বর্গ মিটার উঠোন, আর তার চারিধারে তিন তলা চালাঘরে ভাড়াটে , হিপি-হিপিনিই বেশি । কাঠের পাকানো সিঁড়ি, রাত হলেই অন্ধকার, নেশার ধোঁয়ায় ধোঁয়া । উঠতে গিয়ে প্রায়ই ভুলে অন্যের ঘরে বা কোনো মদের ঠেকে ঢুকে পড়তুম ।

করুণা একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তার লিভটুগেদার পার্টনার হয়ে গেল কাঠমাণ্ডু গিয়ে । কী করে ও এসব পারত ভাবলে অবাক হতে হয় । দোহারা যুবতীটি একটা আর্ট গ্যালারির মালিক ছিল । করুণার আর অনিলের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল । করুণার যে পেইনটিংগুলো বিক্রি হয়নি সেগুলোকে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিতে বললেন ওর কৃষ্ণাঙ্গী সঙ্গিনী । করুণা, যাকে বলে অম্লানবদনে ,হাসতে-হাসতে আগুন ধরিয়ে দিল । অনিল বলেছিল, প্রতিরাতে শোবার খেসারত দিচ্ছে । আগুন ঘিরে হিপি-হিপিনির সে কি নাচ, হ্যাশিশ টেনে ।

নাসের : আমরা জেনেছি যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন, সে-সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরির নেতৃত্ব দেবেন পরিকল্পনা হয়েছিল । শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্হের বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘শয়তানের মুখ’ এবং সমীর রায়চৌধুরীর ‘জানোয়ার’ । পরে সুনীলদা তাঁর বইটির নাম পালটে রেখেছিলেন ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ । এই ঘটনাটি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যতটা সম্ভব জানান ।

মলয় : না । কার কাছে শুনেছ জানি না । শক্তিদা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েচিলেন ১৯৬৫ সালে যখন সুনীলদা হাংরির ওপর পুরোপুরি খাপ্পা । পেলে আমায় চিবিয়ে খেয়ে ফ্যালেন । ওনার রাগ এই জন্যই ছিল যে তাঁকে না জানিয়ে আমি হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করে দিয়েছিলুম । সুনীলদা আমার বইটা প্রকাশ করার কথা যখন ভাবছেন তখনও তিনি হাংরির ঝড়ের তেজ টের পাননি । এদেশে-বিদেশে নানা ভাষায় হাংরি নিয়ে লেখা আরম্ভ হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । আমেরিকা থেকে আমাকে আর সন্দীপনদাকে লেখা ওনার ১৯৬৪ সালের চিঠি দুটো পড়লেই তা স্পষ্ট হবে ।

সুনীলদাকে জানানোর কথা আমি শক্তিদাকে বলেছিলুম । উনি বলেছিলেন যে, জানালেই হবেখন, তাড়াহুড়োর কী আছে ; আগে আওয়াজটা উঠুক । সন্দীপনদা বলেছিলেন, তুমি কি ফুটবল টিম গঠন করছ যে ক্যাপ্টেন দরকার ! সুনীলদা বোধহয় ওনাদের কোনঠাসা করে দিয়েছিলেন, আর  কলকাতার সাংস্কৃতিক-রাজনীতির খুনোখুনির সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলুম না । একটা চিঠিতে সন্দীপনদা আমাকে লিখেছিলেন যে কৃত্তিবাস ওনার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছে । সন্দীপনদা এত বেশি কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন যে বাধ্য হয়ে ‘আজকাল’ পত্রিকার ঘাঁটিতে নাম লেখান । যে গদ্য উনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তারপর আর পুরস্কারের জন্য সুনীলদার কাছে গিয়ে হাত কচলাবার প্রয়োজন ছিল না । আনন্দবাজারে ঢুকে সুনীলদা পুরোপুরি পালটে গিয়েছিলেন । আমেরিকায় গিয়ে উনি বাজারের ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলেন । শন্দীপনদাকে লেখা চিঠিতে সাত কোটি ক্রেতার কথা লিখেছিলেন; তারপর তো সে বাজার বাইশ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেল । তাদের জন্য এক ধরনের ঝরঝরে গদ্য বানিয়ে ফেললেন, যা তরতর করে পড়া যায়, আর তা লেখাও যায় হু-হু করে ।

অসট্রেলিয়ার একটা ওয়েবসাইট ওনাকে বলেছিল ‘ক্যামেলিয়ন’, আর যে মহিলা তা লিখেছিলেন, তিনি সাতটি পরিবারের একটির সদস্য যারা সুনীলদাকে অসট্রেলিয়া যাবার-থাকার খরচ দিয়েছিল ।

তোমার মনে নেই হয়তো, তুমি তখন সাহিত্যে আসোনি, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে ( পঞ্চদশ সংকলন ) সুনীলদা কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ”অকাদেমি পুরস্কার । যারা পুরস্কার দেয় আর যারা পুরস্কার পায় তাদের হাস্যকর ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করার লোক নাই । পুরস্কার পায় কারা ? যারা তথাকথিত জীবনে নিরুদ্বেগ — যাদের অর্থসম্পদ  এবং প্রতিভা যথাক্রমে প্রচুর আছে এবং সামান্যতম নেই এবং যাদের হাত সব সময়েই অপরের পদধুলি নিয়ে-নিয়ে নোংরা হয়ে থাকে । কোনোম শিল্পীই পুরস্কার প্রত্যাশী নয় । পুরস্কার একমাত্র নেওয়া সম্ভব ঈশ্বর অথবা শয়তানের হাত থেকে — ভোটে জেতা মানুষের কাছে কোন শিল্পী পুরস্কার নেবে ?”

সুনীলদার মৃত্যুর পর বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে লেখা হল যে উনি হাংরি আন্দোলনকারী ছিলেন । কেন ? কে বা কারা তাঁর জীবদ্দশায় প্রচার করে গেছে যে তিনি হাংরি আন্দোলনে ছিলেন ? উনি তো সারা পৃথিবী ঘুরেছেন । আমার একটা সন্দেহ আছে, তা আর তোমায় বলছি না । উপন্যাসের জন্যে কিছু নিজের স্টকে রাখি ।

নাসের : প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হাংরি কবি-লেককদের যে-কাজকে অনেকে বলেছিলেন লজ্জাকর, যৌনতার বাড়াবাড়ি, মানসিক নোংরামি, সামাজিক বিদ্রোহ বা রাজনৈতিক প্রতিরোধ, পরবর্তীকালে অনুরূপ পাঠবস্তুতে ছেয়ে গেছে বাংলা সাহিত্য, এমনকি কমার্শিয়াল সাহিত্য । কিন্তু একটি বিশেষ আন্দোলনকে সেই আন্দোলনের সময়কার প্রেক্ষাপটে যাচাই করতে হবে ।  ছয়ের দশকে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া সমাজবর্গটির মূল্যবোধের দখলে ছিল বঙ্গসংস্কৃতি । স্বাভাবিক কারণেই হাংরি সাহিত্যের থিম, আঙ্গিক, কাঠামো, বিষয় ও ইথসকে অনেকের মনে হয়েছিল কুৎসিত, বেসুরো, দুর্বোধ্য, নোংরা, লজ্জাকর, অনৈতিক আর সমাজবিরোধী । হাংরির সাহিত্যপ্রয়াস তার আবির্ভাবের কিছু বছর পর থেকেই দেখা গেছে ধীরে-ধীরে গৃহীত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের সমগ্র কর্মকাণ্ডের মধ্যে । এই ব্যাপারটার আপনি কী ব্যাখ্যা দেবেন ? বিভিন্ন উদাহরণ ও ঘটনা চিহ্ণিত করে যদি কিছু বলেন, আমরা উপকৃত হব । হাংরি স্পিরিট পুরোটাই কি সঞ্চারিত হয়েছে ?

মলয়: আমার মনে হয় এই ব্যাপারটা পৃথিবীর সব কয়টা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঘটেছে । ডাডা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কতরকমের কথা বলা হয়েছিল । এখন তো বিজ্ঞাপনের জগতও ডাডাদের নকল করে বাজার মাৎ করার খেলা খেলছে । আন্দোলন সব সময়েই নিজের সময় আর চিন্তাপরিসর থেকে অনেক এগিয়ে থাকে । বিজ্ঞাপনগুলো দেখলেই টের পাবে লজ্জা ব্যাপারটা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত , যৌনতা নিয়ে পাঠকরা আর চিন্তিত নন । বাংলা ফিল্মের নায়িকাদের দ্যাখো, বেশিরভাগই তো হাফল্যাংটো, এবং তা আর যৌন আবেগ উদ্রেক করে না । দর্শকরা সিটি মারে নায়কের বাহাদুরি দেখে, ফাটাকেষ্টর কেরামতি দেখে ; হাফল্যাংটো নায়িকাদের দেখে নয় । তবে এটাকে হাংরি স্পিরিট বলা ভুল হবে । এটা মূলত মার্কেট ম্যানিপুলেশানের প্রক্রিয়া । আমি বরং ঋতুপর্ণ ঘোষের কাজে হাংরি স্পিরিট ছিল বলব ।

নাসের : ‘পিজিন’ এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ আঠারো-উনিশ শতকে বোঝাত ইংরেজি ও চৈনিক মিশ্রিত অশুদ্ধ ভাষা; বিশ শতকে তা হয় ইউরোপীয় ও উপনিবেশের ভাষার সংকরায়ণ, যে গদ্যবিন্যাসে দক্ষতা অর্জনের জন্য সালমান রুশডি, অরুন্ধতী রায়, বেন ওকরি, আমা আটা আইডু, এলেচি আমাদি, জামাইকা কিনকেইড, নিল বিসুনদাথ প্রমুখ উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখকগণ আজ জগদ্বিখ্যাত । প্রসঙ্গত, পিজিন ইংলিশ শব্দবন্ধটি স্যার ফ্রানসিস বেকন ১৬০৫ সালে লেখা তাঁর ‘দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং’ বইতে সর্বপ্রধম প্রয়োগ করেন । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর চেতনায় যে দ্বিধাটি এখানে প্রকট তা হল গুরু ও চণ্ডালের অথবা শিষ্ট ও অশিষ্ট ভাষার মিশ্রণ সংক্রান্ত, যে দ্বিধা হাংরি আন্দোলনকারীদের আরম্ভসূত্রেই ছিল না । অর্থাৎ ব্যাকরণের দেয়ালও ভাঙা হয়েছিল আন্দোলনে । এই পিজিন সাহিত্য এবং হাংরি আন্দোলনের রচনা নিয়ে বেশ কিছু কথা আপনার কাছে শুনতে চাইছি ।

মলয় : হাংরি বুলেটিন কয়েকটা ইংরেজিতে বের করা হয়েছিল, আর তার দরুণ ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল । পরে ইউরোপ-আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনে সেগুলো ছাপা হয় । ওই ইংরেজি বুলেটিনের কারণেই হাংরি আন্দোলনের কথা চাউর হতে পারল, তা অনেকেরই পছন্দ হয়নি সে-সময়ে । তাই কী আর করা । তাঁরা আক্রমণ করে বসলেন ওই বুলেটিনগুলোর ইংরেজিকে । ইতিমধ্যে যে প্রাক্তন উপনিবেশের লেখকরা যে যার দেশের গুরুচণ্ডালী ইংরেজিতে লেখালিখি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন পৃথিবীজুড়ে, সে-খবর কলকাতায় বোধহয় তখনও পৌঁছোয়নি । ওই যে, একটু আগে বললুম না, যে, তখনকার পত্রিকাগুলো নিম্নর্বের ডিসকোর্সকে গ্রহণ করতে পারছিল না । ব্রাহ্মণ সম্পাদকরা পিছড়াবর্গের লেখা অনুমোদন করার জন্য নিজেদের উন্মুক্ত করতে পারেননি । কত ধরনের পদবি আছে বঙ্গসমাজে, অথচ তাদের কেন দেখা মেলেনি সে-সময়কার পত্রিকাগুলোয় ?

সুবিমল বসাকের গল্প-উপন্যাসগুলো পড়লে আমি কী বলতে চাইছি স্পষ্ট হবে । এই যে বাদবাংলা বা বহির্বঙ্গ নামের পরিসরটা আজ দেখতে পাও, তা ওই ডিসকোর্সের কারণে । সুবিমল ওর টেক্সটে বাঙালদের ভাষা, বহির্বঙ্গের বাঙালির বাংলা, কলকাতার হিন্দিভাষীদের কথায় বাংলার অনুপ্রবেশ নিয়ে অনেক কাজ করেছে । তাছাড়া ও যে কবিতাগুলো লিখেছে তাতেও এনেছে গুরুবিরোধী চণ্ডালের বাকজগত । বহু পাঠক জানেন না যে ওর কবিতার বইও আছে কয়েকটা ।

নাসের : আপনি লিখেছেন, ”হাংরি আন্দোলন মামলায় প্রায় তিন বছর চাকরি থেকে সাসপেণ্ডেড ছিলুম বলে বেশ ফ্রি ছিলুম । বন্ধুরা বললেই বেরিয়ে পড়া যেত । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, দেবী রায়, কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়,  রাজকমল চৌধুরী, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, কারোর না কারোর সঙ্গে বা কয়েকজনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তুম হাংরি মজাদারির লোভে, দাদার কর্মস্হল কিংবা দিঘা, বহরমপুর, খাগড়া, মেখলিগঞ্জ, গোসাবা, দিল্লি, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর, কানপুর, বেনারস, কাঠমাণ্ডু । স্রেফ একটা গামছা নিয়ে । ফালগুনী যেতে চাইত পাটনার কাছাকাছি খগোল, মনের, আরা, কোইলওয়র, হাজিপুর এইসব জায়গায়, খেত-টাটকা পাতা ফোঁকার উদ্দেশ্যে, পোস্ত-খোসার শরবত খাবার বা ভাঙের পকৌড়ি খাবার জন্যে, যাতে ইমোশানাল হাই পাওয়া যায়।”  ফালগুনী রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও তাঁর লেখাপত্র সম্পর্কে শুনতে চাই আপনার কাছে । বহরমপুরে ও কাঠমাণ্ডুতে কী ভাবে কাটিয়েছিলেন সেই গল্পগুলো একটু বলুন ।

মলয় : অনেক জায়গায় গেছি সে-সময়ে । একবার সুবো আচার্যের বাড়ি বিষ্ণুপুরে গিয়েছিলুম । গাঁজা ফোঁকা হল । সুবো বলল, চলো এখান থেকে কিছুদূরে একটা নদী আছে । নদীর নাম মনে নেই । ত্রিদিব বলল, চলো পার হওয়া যাক। সুবিমলও ছিল । আমরা চারজনে জামাপ্যান্ট খুলে বাণ্ডিল বানিয়ে মাথায় তুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হেঁটে পার হলুম নদী । কোথাও কেউ নেই । সবুজ চরাচর । তারপর গাছতলায় বসে আবার ফোঁকা হল । প্রেমে পড়ার গল্প হল । নতুন কী লেখালিখি করা যায় তার আলোচনা হল ।

খাগড়ার কাছে কোনো গ্রামে সুবিমলের মাসি বা মাইমা থাকতেন । রাতে আমাদের শুতে দিয়েছিলেন মশারি টাঙিয়ে মেঝেয় । ভোরের দিকে দেখি, মশারির চালে একটা সাপ । ফণা তুলে । বিছানায় মাথার কাছে পাকানো হাংরি বুলেটিন ছিল, কেননা তখন কলকাতার প্রেসগুলোতে গিয়ে-গিয়ে অগ্রজরা বা প্রতিষ্ঠানের এজেন্টরা প্রেস মালিকদের ভয় পাইয়ে এমন অবস্হা তৈরি করেছিল যে আমরা বহরমপুরে সিগনাস প্রিন্টিং কোঅপারেটিভে বই-পত্রিকা ছাপাতুম; ওনারাই রিপন স্ট্রিটে একজনের হাতে পাঠিয়ে দিতেন । বুলেটিনের ছড়ি দিয়ে সাপটাকে মশারির চাল থেকে বাইরে ফেলে দিলুম ।

তুমি তো বহরমপুরেই থাকো, সিগনাস এখনও আছে নিশ্চয়ই, কেননা একবার অফিসের কাজে গেলে ওনারা আমায় ডেকে দেখিয়েছিলেন কোন ট্রেডল মেশিনে হাংরি-বই-বুলেটিন ছাপানো হতো । আমাদের চেঁচামেচি শুনে সুবিমলের মাসিমা সাপটাকে দেখতেভ পেলেন একটা গর্তে ঢুকতে । তারপর যা করলেন তা অবাক-করা কাণ্ড । সাপটাযেখানে ঢুকেছিল সেখান থেকে চিনির একটা রেখা টেনে নিয়ে গেলেন কাঠপিঁপড়ের ঝাঁকের কাছে বেশ দূরে । দুপুরে খাবার সময়ে ডেকে দেখালেন পিঁপড়েগুলো সাপটার কী অবস্হা করেছে ।

রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে গিয়েছিলুম ওর গ্রাম মাহিষিতে । সেখানে ছিন্নমস্তার মন্দিরে মোষ বলি হতো আর আসপাশের গ্রাম থেকে লোকে আসত কাটা মাংসের প্রসাদ নিতে । তারপর গায়ে মোষের রক্ত মেখে সোমরস মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ । সারাদিনে বহু মোষ বলি হতো । লোকে বলত প্রতিমার মাথার ওপর ফুল রাখলে সে-ফুল যদি না পড়ে যায় তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হবে । রাজকমল যতবার ফুল রেখেছিল ফুল পড়ে গিয়েছিল । ও সে-সময়ে প্রেম করছিল ওর দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মীয়ার সঙ্গে । এক বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল ওর । যখন মারা গেল রাজকমল তখন ওর প্রথম বউই অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্হা করেছিল । রাজকমলও ফালগুনীর মতন অত্যধিক নেশার কারণে আত্মধ্বংসের দিকে চলে গিয়েছিল । হিন্দি কবিতার জগতে যেমন রাজকমল তেমনই কিংবদন্তি বাংলায় ফালগুনী রায় ।

কাঠমাণ্ডুতে পারিজাত নামে এক মহিলা কবি আমাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়ি, পাহাড়ি পথে যেতে হয়েছিল । শিলিগুড়ি শহরে ওনার মূর্তি আছে । বসেছিলেন মৎস্যকুমারীর মতন পা এলিয়ে, পায়ের ওপর শাল চাপা । প্রচুর নেপালি দিশি মদ খাওয়ালেন, পেতলের বাটি করে । কবিতা পাঠ হল । আমি বলে ফেললুম যে আপনাকে এই মৎস্যকুমারীর ঢঙে বসে থাকতে দেখে প্রণয় নিবেদন করার ইচ্ছে হচ্ছে । উনি বললেন, করুন, একটু দাঁড়ান, পায়ের ওপর থেকে শালটা সরিয়ে আমার লেজের আঁশ দেখাই । শাল সরালেন । আমরা স্তম্ভিত । ওনার পায়ে ছোটোবেলা থেকে পোলিও ছিল বলে তার গ্রোথ হয়নি । পরে উনি অনেকবার কলকাতায় সুবিমলের বাসায় আতিথ্য নিয়েছেন । হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে ওনারা নেপালে আরম্ভ করেছিলেন ‘রালফা আন্দোলন’ ।

অনিল, করুণা, কাঞ্চন থাকত বেনারসে । করুণা বলল, চলে এসো, অঢেল হিপিনি আর হ্যাশিশ আর পাকিস্তানি গর্দা নামের গাঁজা ফুলের গুঁড়ো । তুমি আমার উপন্যাস ”অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” পড়ে, কিছুটা আইডিয়া হবে । তখন তো পৃথিবী অন্যরকম ছিল । হিপিরা অ্যামস্টারডম থেকে রওনা দিয়ে টার্কি ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তানের হিপি ট্রেইল দিয়ে পৌঁছত বেনারসে, আর সঙ্গে আনত সেসব দেশের মাদক । আমি একদিন যাবতীয় মিশ্রণ খেয়ে ডিগবাজি খেয়েছিলুম ফুটপাতে । করুণা ফালুদা খাইয়ে জ্ঞান ফেরাতে দেখি কাঞ্চনের বাড়িতে গ্যারাজের ওপরের ঘরে শুয়ে আছি ।

তখনকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলে নানা জেলায় দাদার পোস্টিং হতো আর আমরা হিপিদল এলে তাদের নিয়ে যেতুম ডালটনগঞ্জ দুমকা চাইবাসা হাজারিবাগ ইত্যাদি জায়গায় । সেসময়ে যেমন কে সি দাশের গরম রসগোল্লা খাওয়াতুম ইপিদের, তেমনই দাদা ওদের খাওয়াত গরম মহুয়ার মদ, রিয়্যালি, গরম টাটকা তৈরি মদ । দুমকাতে বোধহয়, দোল খেলা হয়েছিল মদ খেয়ে । তারপর ডালটনগঞ্জে হরিণের মাংস আর গরম-গরম মহুয়ার মদ, চা খাবার মতন করে । বেশিরভাগ হিপির কাছে ব্যাপারগুলো অ্যাডভেঞ্চার ঠেকত ।

নাসের : আপনার দুটি পদ্যনাটিকা হচ্ছে ”ভালোবাসার উৎসব” ও ”যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” । ”ভালোবাসার উৎসব”-এ  সাতজন যুবতীকে দেখতে পেয়েছি, তাঁরা হলেন, কুলসুম বানু, নন্দিতা সিনহা, ভূবনমোহিনী রাণা, চিত্রাঙ্গদা বসু, ক্যারল নোভাক, অবন্তিকা রায়, সীমন্তিনী সেনগুপ্ত । এছাড়া আন্যান্য চরিত্রও রয়েছে । আমরা এই সাত যুবতী সম্পর্কে জানতে আগ্রহী । অসুবিধা না থাকলে ওঁদের সম্পর্কে একটু বলুন । ”যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” কাব্যনাটকে দেবযানী, যিনি ১৮ শতকের যুবতী, তিনি বলছেন, ”নারী হয়ে নারী থাকা সবচে কঠিন”। এই বক্তব্যটিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ? একটু বিস্তারিত বলুন ।

মলয়: এছাড়া আরও দুটো কাব্যনাটক লিখেছি, ”ভরসন্ধ্যা” আর ”সুর্পনখা-বাল্মিকী সংবাদ”, সেগুলোকেও হাইপাররিয়াল বলা যায় । দ্বিতীয়টায় সুর্পনখা বাল্মিকীকে অনুরোধ করছে যে তাকে রামায়ণ থেকে মহাভারতে যেতে দেয়া হোক । রামায়ণের কবি পাখিরা প্রেম করতে পারল না বলে সেই আঘাতে কবি হয়ে উঠলেন, কিন্তু তাঁর রামায়ণে কাউকে প্রেম করতে দিলেন না, সুর্পনখাকে তো নয়ই ; উর্মিলাকে চোদ্দ বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন যাতে না সে অন্য কারোর প্রেমে পড়ে । সীতার চারিধারে লক্ষ্মণের লেজার-বিম লাইন টানলেন, ইত্যাদি, যখন কিনা মহাভারতে কবি নিজেই শুরু করেছেন প্রেমকর্ম দিয়ে, সকলেই বারবার প্রেম করার সুযোগ পেয়েচে ।

তুমি যাদের কথা জানতে চাইছ, সেই যুবতীরা কারা তা তো কাব্যনাট্যে স্পষ্ট করে দিয়েছি, সংলাপের মাধ্যমে । তুমি কি জানতে চাইছ, এনারা আমার জীবন থেকে নেয়া কিনা । উত্তর দেয়া কঠিন । প্রথম জনের কথা বলি যাঁর নাম কুলসুম বানু, ইমলিতলার শিয়া পরিবারের মেয়ে । এই পরিবারটি ওয়াজেদ আলি শাহ-এর পতনের পর লখনউ থেকে পালিয়ে এসেছিল । অত্যন্ত গরিব হয়ে গিয়েছিল ওরা । বিড়ি তৈরি করে, হাঁস-মুরগির ডিম বেচে চলত ওদের সংসার । শায়রি করতে ভালোবাসতেন ; আমার যৌনতার উন্মেষ ঘটান । ওনাকে নিয়ে লেখা আমার কবিতা আছে কয়েকটা । আমি কুলসুম আপা বলে ডাকতুম । শেষজন শ্রীমন্তিনী, ইনি আমার কবিতার প্রেমিকা, আমার কবিতাকে প্রিডেটর পুরুষ বলে মনে করেন, বলেন যে আমার কবিতা ওনার দেহেও কাজ করে, ওনাকে জাপটে পিষে ফেলতে চায় । কী বলব ? আমার পাঠিকার সংখ্যা পাঠকের চেয়ে বেশি, কিন্তু কেউই এভাবে আমাকে অতিক্রম করে আমার কবিতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা কখনও বলেননি । ওয়ানডারফুল পাঠক-প্রেমিকা ।

ভূবনমোহিনী ছিলেন আমার সহপাঠিনী ; চুমু খাবার সময়ে কোনো তরুণীর মুখ থেকে যে মদের গন্ধ বেরোতে পারে তা ভূবনের ঠোঁটে ঠোঁট রাখার আগে আমার কল্পনায় ছিল না । যদিও ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় শৈশব কেটেছে, সেদিন বুঝতে পেরেছিলুম যে অবচেতনে মধ্যবিত্তের পোকা থেকে গেছে । উনি ছিলেন নেপালের রাণা পরিবারের মেয়ে আর ওনাদের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো রুপোর ভাঁড়ে জঁর নামের নেপালি মদ খাইয়ে, বলেছিলেন উনি । প্রতিপত্তিশালী সামন্ত পরিবারের মেয়ে । ফণীশ্বরনাথ রেণু, হিন্দি সাহিত্যিক, যিনি রাণাদের বিরুদ্ধে নেপালে সশস্ত্র লড়াইতে অংশ নিয়েছিলেন, ওনাকে ঘটনাটা বলতে, উনি বলেছিলেন যে মেয়েটির পরিবার জানতে পারলে তোমায় জ্যান্ত পুঁতে দেবে ।

অন্যান্যদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না, কেননা তাঁদের সন্তানসন্ততিরা পছন্দ করবেন না ।

ক্যারল নোভাকের ভেতরে রয়েছেন কয়েকজন হিপিনি, যাদের তুমি পাবে আমার কবিতায় আর ”অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ।

দেবযানী ১৮ শতকে যা ছিলেন এই শতকে তাঁর জৈবিক অবস্হানের বিশেষ হেরফের হয়নি । ফলে আস্তিত্বিক নারীত্ব থেকে গেছে যেখানে ছিল সেখানেই । বাঙালি নারীকে ”নারী” সংজ্ঞার ভেতরে আবদ্ধ করে রেখে দেয়া হয়েছে । ওই সংজ্ঞাকে রিডিফাইন করা কয়েক শতকেও সম্ভব হয়নি । পোশাক ইত্যাদি কেবল পালটেছে । সংজ্ঞার চারিধারে যে লেজার-বিমের সীমা তা ভাঙেনি । পুরুষের ক্ষেত্রে তা অবিরাম রিডিফাইন হয়ে চলেছে । নারীকে লড়তে হচ্ছে নিজেরই স্হিতির সীমার সঙ্গে । এই সীমা জেনডার ডাইরেকটেড হলেও ভ্যাজাইনা-সেন্ট্রিক নয় ।

নাসের : আমেরিকার ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির ইরাজি বিভাগের গবেষক মারিনা রেজা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি রচনা করেছেন ভারতে এসে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে । গবেষণাপত্রটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষ্যটি  আমি বাংলায় আনুবাদ করেছি, যা ‘হাওয়া ৪৯’ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এটা এক আশ্চর্য গবেষণাপত্র— নানান দিক থেকে আলো ফেলে পুরো ব্যাপারটাকে দেখাতে চেয়েছেন তিনি । তাঁর রচনাটি ইনটারনেট থেকে গৃহীত হয়েছিল । এই রচনায় পাটনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া গঙ্গা নদী এবং তারই অনুষঙ্গে জলপ্রবাহের প্রবহমানতা কী ভাবে আপনাকে সময়-অভিযানে নিয়ে গেছে, সে-কথা, ও সেই অনুভব প্রসঙ্গে বলুন আমাদের । আসলে আমরা আপনার জীবনের সেই সময়টাকে ধরতে চাইছি ।

মলয়: মারিনা রেজা এখন মারিনা ডি হেলার হয়েছেন । মারিনার গবেষণা প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি । হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করার জন্যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বলেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ।  সেই অধ্যাপিকা মারিনাকে লেখেন যে কলকাতায় এসে তিনি যেন এ-ব্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । মারিনা ইনটারনেট ঘেঁটে আমাদের নাম খুঁজে পান আর ইউ টিউব মারফত আমাকে ইমেল করেন, আর তাঁকে বিপথগামী করে দেবার ঘটনাটা জানান । ব্যাপারখানা বোঝো । পঞ্চাশ বছর পরও একই কার্যকলাপ ঘটে চলেছে । ডেবোরা বেকারকে তো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি ; ফলে তিনি ”দি ব্লু হ্যান্ড” বইতে গল্প বানিয়েছেন । তবে ডেবোরা বেকারের বইম পড়লে টের পাওয়া যায় যে এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন চেয়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের নেতাকে অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে স্কলারশিপটা দেয়া হোক । শক্তিদা মাতলামির জন্য এমন ছবি গড়ে তুলেছিলেন যে তাঁর হাত থেকে স্কলারশিপটা ফসকে যায় ।

( সাক্ষাৎকারের উত্তরগুলি কয়েকদিনে কলকাতায় গ্রথিত ; ৭ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট ২০১৩ , বাগুইআটি, কলকাতায় । প্রকাশিত হয়েছে ”চন্দ্রগ্রহণ” পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ সংখ্যায় । )

নাসের হোসেন

নাসের হোসেন

About কিছু লেখাপত্র

পড়ুন এবং পড়ান ।
This entry was posted in কৃত্তিবাস পত্রিকা, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা, বিশ্বাসঘাতকতা, শিল্পীর কন্ঠরোধ, হাংরি আন্দোলন and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

1 Responses to নাসের হোসেন নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

  1. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেছেন:

    কিছু জানা ছিল, অনেক নতুন তথ্য জানলাম। অশেষ ভালোলাগা।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান