মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল ত্রিবেদী

উৎপল : খুব সংক্ষেপে হাংরি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন ।

মলয় : ১৯৬০ সালে সাধারণভাবে ভারতের এবং বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার উত্তর-ঔপনিবেশিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনেটিক অবস্হা যা হয়েছিল, দেশভাগের অজস্র ঘরভাঙা মানুষদের দেখতে-দেখতে এবং সেই সময়ের বাংলা কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়েছিল একটা সম্পূর্ণ ওলোট-পালোট দরককার । ১৯৬১ সালে অক্টোবরে আমি, দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আমার বন্ধু হারাধন ধাড়া ( দেবী রায় ) সবাই মিলে হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনা করি । ১৯৬১ সালের পয়লা নভেম্বর পাটনা থেকে আমি ইংরেজিতে একটা বুলেটিন ছাপিয়ে দেবী রায়কে পাঠাই ; উনি কলকাতায় বিলি করার পরই তুমুল চর্চা আরম্ভ হয় এবং ক্রমে প্রায় তিরিশ জন আন্দোলনে যোগ দেন । প্রথম বুলেটিন ইংরেজিতে ছাপাতে হয়েছিল, তার কারণ পাটনায় বাংলা প্রেসগুলো কেবল উপনয়ন, বিয়ে আর শ্রাদ্ধর কার্ড ছাপতো । হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম জিওফ্রে চসারের ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকে আর দার্শনিক বনেদটা পেয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের সংস্কৃতি বিষবক বিশ্লেষণ থেকে ।

উৎপল : কোন তাড়না থেকে আপনার কবিতার জগত এবং হাংরি আন্দোলন নিয়ে জড়িয়ে পড়া ?

মলয় : কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলুম ১৯৫৯-৬০ নাগাস । দাদা সিটি কলেজে পড়তেন এবং তিরিশের দশকের কবিদের আর কল্লোলের লেখকদের বই এনে দিতেন । উনি মামার বাড়ি পাণিহাটিতে থাকতেন এবং ছোটোমামার মার্কসবাদী ভাবনা-চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন । পরে বিহারের জাতপাতের প্রেক্ষিতে ওনার মনে হয়রছি যে বাস্তব সমাজের সঙ্গে তা খাপ খাচ্ছে না । ১৯৬০ সালে আমি এই মর্মে “মার্কসবাদের উত্তরাধিকার” নামে একটা বই লিখেছিলুম, যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । ১৯৬৩ সালে আমার কাব্যগ্রন্হ “শয়তানের মুখ” কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । তোমার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের উত্তর আগেই দিয়েছি ।

উৎপল : ১৯৬৪ সাল । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ লেখার পর আপনার নামে আদালতে মামলা হলো । বাংলা সাহিত্যে বোধহয় এই প্রথম কোনও কবিকে অশ্লীলতার দায়ে প্রকাশ্যে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এই যে শুধু কবিতার জন্য জেল খাটা, একের পর এক মামলায় রাষ্ট্র আপনাকে নাজেহাল করে দেয়া — এই মুহূর্তে সেই বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন ?

মলয় : একটা ব্যাপার বেঝতে পেরেছিলুম যে যাবতীয় লড়াই একজনকে একাই লড়তে হয় । সুবিমল বসাক ছাড়া আর কারোর সঙযোগীতা তখন পাইনি । এখন এটা নিয়ে বিশেষ ভাবি না ; তবে শৈলেশ্বর ঘোষ আর ওনার শিষ্য সব্যসাচী সেন যেভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে চলেছেন, তাতে বিরক্ত বোধ করি । আর এনাদের দুজনকে উৎসাহ জুগিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, দে’জ থেকে বিকৃত ইতিহাস প্রকাশ করিয়ে, তাতে তাঁরও লেখা আছে, আরও অনেকের লেখা আছে যারা হাংরি আন্দোলনে ছিল না । অথচ ওই বই থেকে যারা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল তাদের সবাইকে বাদ দেয়া হয়েছে ।

উৎপল : সমীর রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে আরও কুড়িটা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে” — পরবর্তীতে কোন আন্দোলনে হাংরির প্রভাব আছে বলে আপনার মনে হয় ?

মলয় : নিম সাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, অপরসাহিত্য, নতুন-কবিতা, কংক্রিট কবিতা, ভাষাবদলের সাহিত্য, অধুনান্তিক সাহিত্য, উত্তরআধুনিক সাহিত্য — এরকম বেশ কয়েকটা, সবগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না ।

উৎপল : বর্তমান সমাজ ব্যবস্হায় হাংরি আন্দোলনের প্রভাব কি ফুরিয়েছে ?

মলয় : হাংরি আন্দোলন ছিল একটা ক্রোনোট্রপিকাল ( সময়/পরিসর ) ঘটনা । আন্দোলন তার কাজ করে গেছে । ত্রিপুরা, উত্তরবঙ্গতেও কবিরা সেসময়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন । যেমন সুররিয়ালিজম, ডাডাবাদ, ইমেজিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম ইত্যাদি আন্দোলন কবেই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তারা এখনও ভেতরে-ভেতরে কাজ করে চলেছে । তারা যখন আবির্ভূত হয়েছিল, তখন তাদের বিশেষ প্রয়োজন ছিল । তেমনিই হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল ওই সময়ে ।

উৎপল : আন্দোলনের একপর্যায়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী হন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবী রায় প্রমুখ পিছুটান দেন এবং আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অপপ্রচার চালান । আপনি এ বিষয়গুলো কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন ?

মলয় : শক্তি রাজসাক্ষী ছিলেন না, আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন, যেমন ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু । আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ, যা ওরা চেপে গিয়ে বহুকাল আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছে । আমেরিকা থেকে সন্দীপনকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি থেকে জানা গেছে যে সুনীল ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়েছে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীকে ভেঙে ফেলার জন্য । এটা বোকার মতন কথাবার্তা । উনি বিদেশে বসে বোধহয় ভাবছিলেন কলকাতায় সবাই লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে, ওনার জন্যে খুদকুঁড়োও থাকবে না । আমার কেস যখন আদালতে চলছে, উনি কেসের সাবজুডিস অবস্হায় কৃত্তিবাস পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন । আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি থেকে এখন জানা গেছে যে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পুলিশের নির্দেশে । দেবী রায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, ছাড়া পান, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ওনার ক্রোধের কারণ মামলার কারণে চাকরি চলে যাবার ভয় । উনি সেসময়ে বস্তিতে থাকতেন, গরিব পরিবারের লোক, বলেছিলেন যে চাকরি চলে গেলে আত্মহত্যা করতে হবে । অপপ্রচার তো এখনও বজায় আছে । কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না । আমি তো নিজের যেমন ইচ্ছে দিব্বি লেখালিখি করে যাচ্ছি । এই ধরণের নোংরা ব্যাপার পৃথিবীর সব সাহিত্যসমাজে হয়ে এসেছে আর চলছে । আমাদের এখানে পণ্যসাহিত্যের আনন্দবাজারি কারবারের কারণে তা পচে পোকাধরা লাশ হয়ে গেছে ।

উৎপল : বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সেসময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন বলে সমালোচনা করেন । এই কারণে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,  সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী ?

মলয় : না, না, সন্দীপন আন্দোল ছাড়েন পুলিশের হুমকির কারণে । ওনাকে, শক্তিকে, উৎপলকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিয়েচিল পুলিশ । আনন্দবাজারের মাধ্যমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও চাপ দিচ্ছিলেন ওনাদের । উৎপলের তো যোগমায়া দেবী কলেজে লেকচারারের চাকরিও চলে গিয়েছিল ; তারপর অ্যালেন গিন্সবার্গের সুপারিশে লণ্ডনের একটা স্কুলে চাকরি পান । সতীন্দ্র ভৌমিক হাংরি আন্দোলনে ছিলেন না । উনি ‘এষণা’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন । ১৯৬৩ সালে সেই পত্রিকায় শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা পড়ে আমি দেবী রায়ের মাধ্যমে শৈলেশ্বরকে হাংরি আন্দোলনে এনেছিলুম । শৈলেশ্বরের সঙ্গে একই ঘরে থাকতো । আর ডাডাবাদের প্রভাব সম্পর্কে বলি, আগে যে সমস্ত আন্দোলন বা লেখালিখি হয়ে গেছে তাদের প্রভাব পরের লেখালিখিতে থাকবেই ।

উৎপল : অচলায়তন ভাঙার যে শ্লোগান দিয়ে হাংরি আন্দোলন শুরু করেছিলেন, আপনার কি মনে হয় তা স্তিমিত হয়ে গেছে অথবা আজও চলছে ?

মলয় : সিপিএম সরকার আসার পর প্রমোদ দাশগুপ্ত সারা পশ্চিমবাংলায় যে স্ট্যালিনিস্ট নেটওয়র্ক গড়ে তুলেছিলেন, যেটা পরিশ্রম না করেই পরের সরকার পেয়ে গেছে, তারা তো অচলায়তনের পাইক-বরকন্দাজের রক্তচোষার দিগ্বিজয় আরম্ভ করে দিয়েছিল । বিধবা মায়ের মুখে ছেলের রক্তমাখাভাত গুঁজে দিয়েছে, পেট্রল ঢেলে সাধু-সন্ন্যাসীদের পুড়িয়েছে, জিপগাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে মহিলা অফিসারদের গণধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে, গ্রামবাসীদের খুন করে বা জ্যান্ত মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছে । ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে ফেলেছিল সাহিত্যিকরা ; সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত সুযোগ বুঝে সিপিএমে ঢুকে পড়েছিল । আমি এই ভয়াবহ অবস্হা সম্পর্কে আমার “পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন” পুস্তিকায় বিশ্লেষণ করেছি । এখন বহু সাহসী যুবক-যুবতীদের দেখা পাই, যারা আমাদের পতাকা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ।

উৎপল : আপনি একজন অবস্হাপন্ন পরিবারের সন্তান । বাবা কাকা সরকারি চাকরি করতেন । তাঁদের দৃষ্টিতে ‘অশ্লীল’ কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন । সে সময়ে আপনার পপতি বাড়ির প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ?

মলয় : আমি অবস্হাপন্ন বাড়ির ছেলে কে বলল তোমায় ? বংশটা সাবর্ণ চৌধুরী বলে অনেকে মনে করেন অবস্হাপন্ন । সাবর্ণ চৌধুরীরা উত্তরপাড়ায় রিকশ চালাচ্ছে দেখতে পাবে তুমি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা পো” পোড়ো । ছোটোবেলায় আমরা থাকতুম পাটনা শহরের অন্ত্যজ বিহারি আর অত্যন্ত গরিব মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায় । পাড়ার নিবাসীরা ছিল চোর, ডাকাত, পকেটমার ইত্যাদি। দাদা যাতে না কুসঙ্গে পযে খারাপ হয়ে যায় তাই কলেজে পড়ার জন্য দাদাকে মামার বাড়ি পাণিহাটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । কুড়িজনের পরিবারে বাবা ছিলেন একমাত্র রোজগেরে । ওনার ফোটো তোলার আর ফোটো থেকে ছবি আঁকার দোকান ছিল পাটনা শহরে । পরে বড়ো জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে পেইনটিঙ আর মূর্তি ঝাড়পোঁছের চাকরি পেয়েছিলেন, ক্লাস ফোর স্টাফ । ছয় ভাই একবোনের পরিবারে জেঠা-কাকারা কোনও কাজ করতেন না । উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির ট্যাক্স আর ঠাকুমার খাইখরচও বাবাকে পাঠাতে হতো প্রতি মাসে ।আমাদের পোশাক আর জুতো কেবল পুজোর সময়ে কেনা হতো ।  দাদা খেলতে গিয়ে জুতো হারিয়ে আসতো আর সারা বছর খালি পায়ে স্কুলে যেতো । আমাদের বাড়ি চিল ফোটোগ্রফার-আর্টিস্টের । জেঠা কাজ করতেন মিউজিয়ামে । তাই শ্লীলতা সম্পর্কে মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতায় বাড়ির লোক ভুগতেন না । মামলার সময়ে কলকাতার আদালতে বাবা-জেঠা-পিসেমশায় আসতেন সাহস যোগাবার জন্যে ।

উৎপল : সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল কীভাবে নির্ধারিত হয় ? অশ্লীলতার মাপকাঠি আদৌ কি আছে ?

মলয় : ইংরেজরা আসার আগে আমাদের সাইত্যবোধে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ ছিল না । ধাকলে বাৎসায়ন, জয়দেব, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্র  আমাদেরভাষায় হতে পারতেন না, কবিয়ালদের আবির্ভাব হতো না । খাজুরাহো, কোণারক, পুরীর মন্দিরের স্হাপত্য হতো না । অলঙ্কারশাস্ত্রে প্রথম রসই তো আদিরস । সাম্রাজ্যবাদীরা এসে তাদের ভিকটোরীয় মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়ে গেছে ; তা থেকে বেরোবার আর উপায় নেই । এখন তো বিজেপির লোকেরা শ্লীল-অশ্লীলের বিচারক হয়ে দাঁড়িয়েছে । কোনো লেখায় ভাষার কাজ থাকলে, তা যদি পাঠককে উত্তেজিত করেও, তাকে অশ্লীল বলা চলে না ।

উৎপল : এ পর্যন্ত আপনার কাব্যগ্রন্হ, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা কতগুলো ?

মলয় : সত্তরটার মতো হবে । আমি বইপত্র সংগ্রহে রাখি না, তাই সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না । আমার সম্পর্কে পিএইচডি করেছেন বিষ্ণুচন্দ্র দে, উনি এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছেন ।

উৎপল : আপনি প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন যা নারীর, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলুন । সেটা কোন সময়ে ?

মলয় : সময়টা ১৯৫৪-৫৬ । নারী বলা ভুল হবে । তিনি ছিলেন স্কুলছাত্রী । তাঁর সমর্থনে মারপিট করতে গিয়ে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । কিন্তু ওনার পরিবার কোনোকিছু না জানিয়েই হঠাৎ পাটনা থেকে উধাও হয়ে যান। আমার উপন্যাস ‘রাহুকেতু’তে আমি লিখেছি এই বিষয়ে । গাঙচিল থেকে প্রকাশিতব্য আমার রচনাসংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে । ( গাঙচিল মলয়বাবুর রচনাবলী কোনও রহস্যজনক কারণে প্রকাশ করতে অস্বীকার করে )।

উৎপল : নতুন যারা লেখালিখির জগতে আসছে, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী ?

মলয় : যেমন ইচ্ছের তেমন লেখো, প্রচুর পড়াশুনো করো, একা থাকার চেষ্টা করো, ডায়েরি রাখো, আর অবশ্যই মনে কিছু এলেই তক্ষুনি লিখে রাখো, পরে প্রয়োগ করার জন্য ।

উৎপল : এই সময়ে বিশ্বকাব্যে বাংলা কবিতার স্হান কোথায় বলে মনে করেন ?

মলয় : পোয়েট্রি, প্যারিস রিভিউ, লণ্ডন ম্যাগাজিনের কবিতাগুলো পড়ে বুঝতে পারি, বাংলায় যা লেখা হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক কবিতার স্তরে । দুর্ভাগ্য যে অনুবাদ হয় না, যোগ্য অনুবাদক নেই । বিদেশে কবিতা একটা অ্যাবসট্র্যাক্ট আঙ্গিক নিয়েছে, বাংলা কবিতায় অ্যাবসট্র্যাক্ট কবিতা লেখার ধারা তো চলছে নানা কবিতার পাশাপাশি ।

উৎপল : হাংরি ইশতাহারের একটা পয়েন্ট ছিল, “আত্মআবিষ্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে”—এই নীতি আপনারা কতোটুকু মেনে চলেছেন ?

মলয় : সেসময়ে মনে হয়েছিল জীবনের কোনো একটা সময়ে আত্মআবিষ্কার সম্ভব । এখন বুঝতে পারি যে বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে জীবনে এতোপ্রশ্ন জমতে থাকে যে তার উত্তর দেয়া অসম্ভব । ফলে, আত্মআবিষ্কার শেষ হয় না, আরও কঠিন হয়ে উঠতে থাকে ।

উৎপল : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উগ্রপন্হীদের হাতে খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়, আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু প্রমুখ মুক্তমনা ব্লগারদের । ভারতেও গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবার্গিকে হত্যা করেছে কট্টর হিন্দুবাদীরা । সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন । আপনার কি মনে হয় না যে শেষ অবধি উগ্রপন্হা এই শতাব্দীর চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াবে ?

মলয় : হ্যাঁ, তাই মনে হয়, এবং তার ফলে একসময়ে কোনো দেশ আণবিক বোমা ব্যবহার করে ফেলবে, যার দরুন হয়তো বিশ্বযুদ্ধও বেধে যেতে পারে ।

উৎপল : কাশ্মীরের মানুষ ভারত রাষ্ট্রের শোষণ, অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে, লড়াই করছে রাষ্ট্রের সেনার সাথে । কাশ্মীরিরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে চায় । আপনি কাশ্মীরের এই আজাদির লড়াইকে কীভাবে দেখছেন ?

মলয় : আমি চাকুরিসূত্রে জম্মুকাশ্মীরে গেছি । হোটেলে পৌঁছোতেই দুজন কাশ্মীরি যুবক ভুল করে আমাকে সাংবাদিক ভেবে গাড়ি নিয়ে এসেছিল বারামুলা নিয়ে যাবার জন্য । পরে, জম্মু ফেরার যে বাসে বসেছিলুম, তার পেছন দিকে বোমা ফেটে আমার অধস্তন অফিসাররা আহত হয়েছিল । আর পি এফের লোকেরা আমাকে আপেল আর আখরোট নিয়ে মুম্বাই ফিরতে দেয়নি । বলেছিল, নিয়ে গেলে এদের সাহায্য করা হবে । তখনই অবস্হাটা ব্যক্তিগতভাবে আঁচ করতে পেরেছিলুম । কাশ্মীর একটা ছোট্ট জায়গা, জম্মু আর লাদাখ থেকে আলাদা, সুতরাং সেখানের লোকেদের স্বাধীনতা দেয়ার অসুবিধা হবার কথা নয় । কিন্তু ভারতে হিন্দুত্ব একটা কায়েমি স্বার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে ; ভারতীয় পুঁজিবাদের দোসর হয়ে গেছে । কাশ্মীর পাকিস্তানে ঢুকলেই সারা দেশে দেশভাগের সময়ের চেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা আরম্ভ হবে । পাকিস্তান আর ভারত একসঙ্গে বসে ওদের স্বাধীনতার আর ওদের ব্যাপারে নাক না গলাবার গ্যারেন্টি দিলে সুরাহা সম্ভব । জেনারাল মুশররফ নাকি এরকমই একটা পরিকল্পনা ফাইনাল করে ফেলেছিলেন বাজপেয়ির সঙ্গে আলোচনায় । সমস্যা হলো ভারতীয় এসট্যাবলিশমেন্ট পাকিস্তানের সরকারকে বিশ্বাস করে না ।

( ‘কবিতার দেশে’ পত্রিকার বৈশাখ ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত )

About কিছু লেখাপত্র

পড়ুন এবং পড়ান ।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান